ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

* দেড় লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ;###;* সংখ্যালঘু হিন্দুরাও রেহাই পাচ্ছে না;###;* আজ মিয়ানমার যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি;###;* পোড়ামাটি নীতির নিন্দায় সৌদিআরব, হুঁশিয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের

জ্বলছে রাখাইন ॥ এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

জ্বলছে রাখাইন ॥ এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে জঙ্গীবিরোধী অভিযানের নামে অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ওপর যে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে তা মর্মন্তুদ রাখাইন ট্র্যাজেডি হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। গত ২৫ আগস্ট গভীর রাত থেকে মিয়ানমারের সেনা, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর যে যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে তাতে জলস্থলে বা পাহাড় পর্বতে রোহিঙ্গাদের মৃতের সংখ্যা ৩ সহস্রাধিক ছাড়িয়ে গেছে। সাগর পথে টেকনাফে এ পর্যন্ত ৫টি নৌকাডুবির ঘটনা ভেসে আসা লাশ মিলেছে ৫৬। নিখোঁজ রয়েছে আরও অন্ততপক্ষে অর্ধ শতাধিক। মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশ নিয়ে চলমান পরিস্থিতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ মঙ্গলবার তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে যাচ্ছেন সেদেশে। দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির বিষয়টিও আলোচনায় আসবে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়েছে। এদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সীমান্ত রয়েছে তাতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ব্যাপকভাবে শিথিল রাখা হয়েছে। ইতোপূর্বে অনুপ্রবেশ রোধের কথা বলা হলেও মানবিক কারণে সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি ভাল আচরণ করার অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। ফলে এখন ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা চলে আসছে এদেশে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের আবেদন-নিবেদন উপেক্ষা করে মিয়ানমার বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর আচরণ অব্যাহত রেখেছে তা বর্তমান সভ্য দুনিয়ার ইতিহাসে নতুন ঘৃণ্যতম বর্বরতার ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, হেলিকপ্টার থেকে গান পাউডারে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, সহায় সম্পদ কেড়ে নেয়াসহ এমন কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা নেই যা সেখানে ঘটছে না। ফলে গত ১০ দিনে অর্থাৎ ২৫ আগস্ট গভীর রাতের পর থেকে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে দেড় লক্ষাধিক। টেকনাফ থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যন্ত সীমান্তের বিভিন্ন এলাকার জিরো পয়েন্টে সোমবার পর্যন্ত হাজার হাজার রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশুর মাতম চলছে। এরপরও রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান কোনভাবেই যেন থামছে না। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে মিয়ানমার বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর মরণ ছোবল হেনেছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা নর-নারী সেদেশের মংডু, রাচিদং, বুচিদংসহ বিভিন্ন শহর ও শহরতলী এলাকায় গৃহবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। খাদ্য, পানীয়র অভাবে ওসব রোহিঙ্গার অনেকেই এখন অনাহারে-অর্ধাহারে মৃত্যুপথে যাত্রী হয়ে আছে। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদেরও ওপর নেমে এসেছে বর্বরতার শেষ খড়গ। এ অবস্থায় জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে নানাভাবে রোহিঙ্গা নিধন থামিয়ে তাদের ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করা জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি দফায় দফায় আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু কোন আবেদনই যেন মিয়ানমার সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন পরিস্থিতি আসলেই জটিল। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের নামে কয়েকটি জঙ্গী সংগঠন মিয়ানমার বাহিনীর ওপর কয়েক দফায় হামলা চালিয়েছে। হত্যা করা হয়েছে মিয়ানমার বাহিনীর কয়েক সদস্যকে। লুট হয়েছে তাদের অস্ত্রশস্ত্র। এরপরে মিয়ানমার সরকার হেনেছে হিংস্র ছোবল। যে ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হয়ে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছে রাখাইন রাজ্য। গ্রামের পর গ্রাম, পাড়ার পর পাড়ার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। জ্বেলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে সবকিছু। গত শনিবার ঈদের দিনেও মিয়ানমার বাহিনীর হামলা অব্যাহত ছিল। পরদিন রবিবারও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। তবে সোমবার বর্বরতার হার কিছুটা কমেছে বলে সীমান্তের ওপার থেকে খবর মিলেছে। রোহিঙ্গা বসতিগুলো জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। ইউএনএইচসিআর, আইওএম, রোহিঙ্গাবিরোধী প্রত্যাবাসন কমিটিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এমন সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক পরিসংখ্যানে মৃতের সংখ্যা বলা হচ্ছে তা একেবারে কম করে হলেও তিন সহস্রাধিক ছাড়িয়ে গেছে। সোমবার পর্যন্ত নাফ নদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫৬ জন রোহিঙ্গা নারী-শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। শুক্রবার ও রবিবার সকালে টেকনাফ হ্নীলা গোদামপাড়া, ওয়াব্রাং, মৌলভীবাজার ও খারাংখালী পয়েন্টে নাফনদী থেকে এসব মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। টেকনাফ থানার ওসি মাঈন উদ্দিন জানান, শুক্রবার সকালে শাহপরীর দ্বীপে ও নাফ নদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৮ নারী ও শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯ জন শিশু ও ১৩ জন নারী রয়েছে। গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ থেকে পৃথকভাবে ২৩ জন নারী ও শিশুর এবং রবিবার সকালে মা মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে মোট ৫৬ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হলো। এছাড়া রাখাইন রাজ্য থেকে এ পর্যন্ত ৫টি ইঞ্জিন নৌকাযোগে শতাধিক রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশু সাগর পথে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে ৫টি নৌকায় ডুবে গেছে। উদ্ধারকৃত ৫৬ জন ছাড়া অবশিষ্টরা নিখোঁজ রয়েছে। জোয়ার ভাটার টানে লাশ বাংলাদেশ ছাড়াও অন্যান্য স্থানেও পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পাশাপাশি সাগরের জীব জানোয়ারের পেটেও যাচ্ছে অনেকে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে সে দেশের সেনা বাহিনীর সহিংস ঘটনার পর সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে জলসীমানা অতিক্রম করে রোহিঙ্গারা নৌকা নিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সময় নৌ-ডুবির ঘটনাও ঘটে। ঈদ-উল আযহার দিন নতুন দুটি নৌকা ডুবির ঘটনায় মা ও মেয়ে নিহত ও ৪ শিশু নিখোঁজ থাকার খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় অজ্ঞান শিশু সুফাইরা বেগমকে (৮) উদ্ধার করে কুতুপালং এনজিও পরিচালিত এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মিয়ানমারের মংডু মাংগালার ফওখালীর সৈয়দ উল্লাহ (৬৩) জানিয়েছেন, ঈদের দিন সকালে ২টি নৌকায় ২৮ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেয়। কুমিরখালী অতিক্রম করার পর ২১ জন রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাটি ডুবে যায়। খোঁজাখুঁজির পর স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (৬০) এবং মেয়ে মিনারা আক্তারের (২২) মৃতদেহ পাওয়া গেলেও ৪ জন শিশু পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ ৪ জন শিশুর মধ্যে মৃত রমজান হাকিমের পুত্র মোঃ তুহাদ (৮), আসমত আরা (৬), জরিদা বেগম (৪) ৩ জনই একই পরিবারের অপর ১ জন নুরুল ইসলামের পুত্র নুর কাবা (৫)। এদিকে সীমান্তের ঘুমধুমের জিরো পয়েন্ট হতে গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা স্বামী স্ত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ি জলপাইতলী থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। নিহত দম্পতি মিয়ানমারের ডেকুবনিয়ার জাফরুল্লাহ এবং তার স্ত্রী আয়েশা বেগম। গত শনিবার আয়াত উল্লাহর পরিবার ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। মিয়ানমারকে যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারি ॥ রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা চালানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, দেশটির উচিত আন্তর্জাতিক আইন ও অঙ্গীকার অনুসরণ করে চলা ও নাগরিকদের আক্রমণ থেকে বিরত থাকা। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি এক বিবৃতিতে বলেন, মিয়ানমারের মানুষের জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে তবে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও হত্যা করা থেকে দেশটির সংযম দেখানো ও বিরত থাকা উচিত। নিকি হ্যালি আরও বলেছেন, বার্মা সেনাবাহিনীর উচিত সহিংসতা রোধে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা। নিরাপরাধ বেসামরিক ও সহায়তাকারী শ্রমিকদের ওপর আক্রমণ না চালানো এবং প্রয়োজনে তাদের সহায়তা প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা। বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বার্মার সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করার পর ৩ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছে। প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গার বসতবাড়িতে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ৫৮ হাজারেরও বেশি মানুষ। মিয়ানমার সরকারের মিথ্যাচার ॥ গত ২৫ আগস্ট রাত থেকে সংঘটিত সেনা তান্ডবে কতজন রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সদস্য হত্যার শিকার হয়েছে তা নিয়ে সে দেশের সরকারের তরফ থেকে মিথ্যাচার অব্যাহত রয়েছে। তাদের স্পষ্ট বক্তব্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে তারা বাঙালী এবং জঙ্গী। এছাড়া ওরা মিয়ানমারের নাগরিক নয় অনুপ্রবেশকারী। মোদির মিয়ানমার সফর ॥ মিয়ানমারে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর যখন বিপুল সংখ্যায় রোহিঙ্গারা সেদেশ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসছেন, ঠিক সে সময়েই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদি আজ রাষ্ট্রীয় সফরে মিয়ানমার যাচ্ছেন। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা ও মানবিকতার ইস্যু ছাড়াও রাখাইন অঞ্চলে যে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়েও আলোচনা হবার সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য, রাখাইনে সহিংসতার জের হিসেবে বহু রোহিঙ্গা ভারতেও অনুপ্রবেশ করেছে। লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অবরুদ্ধ ॥ বুচিদংয়ের তামীতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ঘেরাও করে অবরুদ্ধ করে রেখেছে সামরিক বাহিনী। সোমবার সকালে ওই এলাকাটি ঘিরে রণপাহারায় রয়েছে সেনা সদস্যরা। গত এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন রোহিঙ্গা পল্লীতে সৈন্যরা অগ্নিসংযোগ করে এবং হত্যাযজ্ঞ চালালে ওসব গ্রামের রোহিঙ্গারা তামীতে এসে জড়ো হয়েছিল। এদের সংখ্যা এক লাখ ৩০ হাজার হতে পারে বলে আনুমান করেছে রোহিঙ্গা নেতারা। তারা জানিয়েছে, অবরুদ্ধ রোহিঙ্গারা সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। তামী থেকে তাদের বের হয়ে যাওয়ার কোন পথ খোলা নেই। চারদিকে রয়েছে সৈন্য সমাবেশ। সপ্তাহখানেক অবস্থানের ফলে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শুধু পানি খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না আর স্বজন হারানো মা-বোনের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে বুচিদংয়ের পরিবেশ। সংখ্যালঘু হিন্দুরাও রেহাই পাচ্ছে না ॥ জীবন বাঁচাতে সীমান্ত সাঁতরে সোমবার পর্যন্ত এপারে আশ্রয় নিয়েছে ১৬০ পরিবারের ৪৯৭ হিন্দু নারী-পুরুষ ও শিশু। সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপরও চলছে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ। প্রাণের ভয়ে স্বদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে আরাকানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব সনাতন ধর্মাবলম্বীর সদস্যরা। এদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে উখিয়ার কুতুপালং হরি মন্দিরের পাশে মুরগির ফার্মে। ১৬০ পরিবারের ৪৯৭ জনের হিন্দু নারী-পুরুষ ও শিশু একটি পরিত্যক্ত মুরগির খামারে মানবেতর দিনযাপন করছে। এতে ১২৮ পুরুষ, ২০৯ জন নারী ও ১৬০ শিশু রয়েছে। জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে এ্যাডভোকেট রণজিত দাশ ও বাবুল শর্মা জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, সহায় সম্বলহীন এসব হিন্দু পরিবারগুলোর জন্য দ্রুত খাদ্যের ব্যবস্থা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ থেকে করা হলেও জীবন যাপনের অবস্থা অমানবিক। তবে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর দফতর থেকে প্রকাশিত বিবৃতি অনুযায়ী মিয়ানমারের বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করেছে, আরাকানে ছয়জন হিন্দুকে হত্যা করেছে আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রিত হিন্দু জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বলেছেন, বিপরীত কথা। রোহিঙ্গারা নয়, তাদের হত্যা করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী রাখাইনরা। রোহিঙ্গা শূন্য ২০ গ্রাম ॥ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক জান্তার নির্মম হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায় উদ্বেগ, নিন্দা, আহ্বান ও ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তা আমলে নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনী। বৌদ্ধ বিহারগুলোতে পুলিশ পাহারা জোরদার ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা অব্যাহত থাকায় এবং সীমান্তে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় উখিয়া ও রামুর বৌদ্ধবিহারগুলোতে পুলিশি পাহারা এবং টহল জোরদার করা হয়েছে। মিয়ানমার সেনা বাহিনীর আহ্বান ॥ মিয়ানমারে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরসা’র ক্যাডাররা সরকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। মিয়ানমার সরকার এক বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী রোহিঙ্গারা ২৪ পুলিশ চেকপোস্টে সমন্বিত হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে। সাম্প্রতিক ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের লক্ষ্যে রাখাইন রাজ্যে সেনা মোতায়েন শুরুর কয়েকদিনের মাথায় বৃহস্পতিবার রাতে (২৪ আগস্ট) পুলিশ চেকপোস্টে হামলা হয়। দাবি অনুযায়ী রাতভর সংঘর্ষে রোহিঙ্গা-পুলিশ-সেনাসদস্য মিলে অন্তত ১০৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানায় সেনাসূত্র। এই হামলার দায় স্বীকার করে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)। ওই হামলার পর থেকে রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযান জোরদার হয়। স্বাধীন আরাকানের দাবিতে লড়াইরত আরসাকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে রেখেছে মিয়ানমার সরকার। ৩২ দালালের সাজা ॥ টেকনাফে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করার দায়ে ৬ জন দালালকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৬ মাস করে সাজা দিয়েছে। রবিবার টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রণয় চাকমা পৃথকভাবে এ দ-াদেশ প্রদান করেন। নাফ নদে এপার-ওপারে গলিত লাশ ॥ টেকনাফের খারাংখালী প্যারাবনে ও মিয়ানমার অংশে রোহিঙ্গাদের গলিত লাশ দেখতে পেয়েছেন জেলেরা। এপারে হোয়াইক্যং খারাংখালীতে দেখা যায় এক রোহিঙ্গা পুরুষের গলিত লাশ। উক্ত স্থান থেকে শুক্রবার দুপুরে ১৮ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উক্ত স্থানে রবিবার সকালে ৪ জনের লাশ দেখা গিয়েছিল। আরাকান আর্মির দুই সদস্য আটক॥ বান্দরবানে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির ২ সদস্যসহ তিনজনকে আটক করেছে সেনাবাহিনী। রবিবার সকালে বান্দরবান-চিম্বুক সড়কের ওয়াইজংশন এলাকা থেকে আরাকান আর্মির (এএ) সদস্য ম্যাসোয়াই (২০), খয়লিথোয়াই (২১) ও মোটরসাইকেল চালক উঞোম মারমাকে (২১) আটক করা হয়। সেনাবাহিনীর সদর জোনের অধিনায়ক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জানান, আটকরা মোটরসাইকেলযোগে ওয়াইজংশন ক্যাম্প পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক হলে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি করা হয়। পরে তাদের কাছ থেকে নগদ সাড়ে ৯ লাখ টাকা, আরাকান আর্মির ব্যবহৃত সিল (কর্নেল পদবির), কয়েকটি মোবাইল সেট, মিয়ানমারের ডিকশনারি, একটি মোটরসাইকেলসহ সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়। তিনি জানান, আটকদের অধিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বান্দরবান সদরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে খয়লিথোয়াই মারমার বাবা চয়নই আরাকান আর্মির কর্মকর্তা ছিলেন। সংগঠন ছেড়ে দেয়ার পর তিনি বান্দরবান শহরের মধ্যমপাড়ায় বসবাস করতেন। তার ছেলে পরে একই সংগঠনে যোগ দেয় বলে জানা গেছে। গত শনিবার সকাল দশটায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কিছু লোক নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একটি দল রাখাইন রাজ্যের ঢেঁকিবনিয়া এলাকায় ঢুকে বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসায় অভিযান চালায়। এক পর্যায়ে রোহিঙ্গা নর-নারী শূন্য কয়েকটি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঈদের নামাজের সময় এমন ঘটনা ঘটায় অনেকেই নামাজ ছেড়েই ছোটাছুটি করতে থাকে। এ সময় রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ চলে আসে সীমান্তে জিরো পয়েন্টে। চাকমাকাটা, ফকিরপাড়া, বলিবাজার, আয়াংচর, কিয়াম্যং, জুম্বাই, নরিক্যং, শীলখালী, বালুখালী, বুচিদং, রাচিদং, কৈয়ারবিল, নাইনচং, নাইসাপ্রোসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে রোহিঙ্গার বাড়িতে বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে ॥ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে গত আট দিনে সহিংসতার কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ৭৩ হাজারে পৌঁছেছে। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাখাইন অঞ্চল থেকে যেভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে তা ভয়াবহ। এর আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যেভাবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা করা হচ্ছে তাকে রীতিমতো গণহত্যা বলে বর্ণনা করেছেন। তুরস্ক সরকার আরও বলেছে, এখনও প্রতিদিনই হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ পালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা বিষয়ক ইউরোপীয় সংস্থা॥ রোহিঙ্গা বিষয়ক ইউরোপীয় সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে সৈন্যদের আক্রমণে প্রায় তিন হাজার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে। সৌদি আরবের নিন্দা ॥ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করায় নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব। দেশটির বাদশা সালমানের পক্ষ থেকে এ নিন্দা আসেনি। এসেছে জাতিসংঘে সৌদি মিশনের টুইটার থেকে। এতে রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সাম্প্রতিক হামলার নিন্দা করা হয়েছে। আল আরাবিয়্যার’র খবরে এ তথ্য দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছেও সৌদি আরব তার উদ্বেগ জানিয়েছে এবং জাতিসংঘকে তার দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করা হয়েছে।
×