ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ‘ধরা’ খেয়েছেন

সরকার নির্ধারিত দামে কোরবানির চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সরকার নির্ধারিত দামে কোরবানির চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে না

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ঢাকাসহ দেশের কোথাও সরকার নির্ধারিত দামে কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনা হচ্ছে না। ন্যায্যদাম না পেয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বরাবরের মতো এবারও ‘ধরা’ খেয়েছেন। তবে বিভিন্ন অজুহাতে পানির দরে চামড়া কিনছেন ট্যানারি মালিকরা। আমদানিকৃত লবণ দেশে না আসায় অস্থির ছিল লবণের বাজার। লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় চামড়া সংরক্ষণে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এবার হাজারীবাগসংলগ্ন পোস্তা, গাবতলীর আমিন বাজার, ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় এবং বাড্ডার প্রধান সড়কে কাঁচা চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে সংগৃহীত বেশিরভাগ চামড়া পোস্তার আড়তগুলোতে পৌঁছে গেছে। সারাদেশ থেকে চামড়া আসবে আগামী তিনমাস পর্যন্ত। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর প্রায় ৮০টি ট্যানারিতে কাঁচা চামড়ার মজুত হচ্ছে। এসব ট্যানারি খুব শীঘ্রই কোরবানির চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে যাবে বলে জানা গেছে। এছাড়া চামড়া পাচার প্রতিরোধে বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সীমান্ত এলাকাগুলোতে টহল জোরদার করা হয়েছে। এদিকে, লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় পোস্তার আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা নির্ধারিত দামে প্রতিবর্গফুট ৫০-৫৫ টাকা দরে কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এক্ষেত্রে চামড়ার মান নিয়ে আড়তদাররা প্রশ্ন তুলেছেন। আনাড়ি কসাই দিয়ে চামড়া তোলায় অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে বলে অভিযোগ তাদের। ঈদের দিন শনিবার দুপুরের পর থেকে যখন পোস্তায় ট্রাকভর্তি চামড়া আসতে থাকে, তখন হঠাৎ করেই দাম পড়ে যায়। ওই সময় অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হা-হুতাশ করতে দেখা গেছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রাকভর্তি চামড়া নিয়ে পোস্তায় এসেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ী সেলিম মিয়া। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি জনকণ্ঠকে জানান, সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনে পোস্তায় তিনি ন্যায্যদাম পাচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত লোকসান দিয়ে তাকে কাঁচা চামড়া বেচে দিতে হয়েছে। পোস্তায় সরকার নির্ধারিত দাম ও চামড়া ফুট হিসেবে বিক্রি না করে আকার ভেদে ৩০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মৌসুমি বিক্রেতারা বলছেন, হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকরা এবার চামড়া কিনতে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সরকার ছাগলের চামড়ার জন্য প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা দাম নির্ধারণ করে দেয়ায় প্রতিটি চামড়ার জন্য ১০০ থেকে ১২০ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা পুরো চামড়ার জন্য ৩০ থেকে ৫০ টাকার বেশি দিতে চাইছেন না। বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হাজী টিপু সুলতান জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোর চামড়া এসে গেছে। কিন্তু লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ বছর চামড়া সংগ্রহণ ও সংরক্ষণে সঙ্কট তৈরি হতে পারে। লবণের অভাবে চামড়া পচে যেতে পারে। তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বেচাকেনা হচ্ছে। তবে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বেশি দামে চামড়া কিনেছেন। এর দায়ভার তাদেরই নিতে হবে। বাংলাদেশ লেদার এ্যান্ড লেদার গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আরিফ বলেন, হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় থাকায় এবার চামড়া কেনার চাহিদা কমে গেছে। ছোট ট্যানারিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছাগল বা ভেড়ার চামড়া ও গরুর মাথার চামড়া প্রক্রিয়া করার ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে হাজারীবাগে। ফলে এবার এ চামড়ার চাহিদা নেই। চামড়ার দাম ও চাহিদা কমে যাওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি আরও বলেন, হাজারীবাগে ছোট বড় প্রায় চার শ’ ট্যানারি ছিল। সেগুলো বন্ধ হয়ে সাভারে চালু হয়েছে মাত্র অর্ধশতাধিক ট্যানারি। এর মধ্যে মাত্র চার-পাঁচটি ট্যানারি আছে, যারা গরুর মাথার চামড়া ও ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। হাজারীবাগের ছোট ট্যানারিগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে গেছে। গত বছর দুই হাজার পিস চামড়া কিনেছিলাম। এবার কিনেছি মাত্র ৮০০ পিস। আজকের দিন মিলিয়ে হয়তো এক হাজার হবে। এবার কোরবানিও কম হয়েছে, পাশাপাশি চামড়ার দামও কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনেক ট্যানারির কাছে গতবছরের চামড়াও জমা আছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও চামড়ার দাম কম। আর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে লবণ লাগে। এবার লবণের দাম ছিল অনেক বেশি। এম এইচ লেদারের মালিক আব্দুল মালেক জানান, গত বছর তিনি ১৮ থেকে ২০ হাজার চামড়া কিনেছিলেন। এবার কিনেছেন মাত্র ৫ হাজার পিস। হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ করে দেয়ায় ব্যবসার এই মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানান মালেক। তিনি বলেন, আমরা সাভারে প্লট পাইনি। হাজারীবাগের সব মেশিনপত্র বন্ধ হয়ে আছে। তাই কাঁচা চামড়া কেনার দিকে বেশি গুরুত্ব দিইনি। ব্যবসা ধরে রাখার জন্য কিছু চামড়া কিনেছি। এখন হোয়াইট ব্লু ফিনিশিংসহ প্রয়োজনীয় কাজগুলো অর্ডার দিয়ে অন্যের কারখানায় করাব। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিল্প সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জানান, হাজারীবাগে ১৫৫টি ট্যানারি ছিল। সেগুলোর মধ্যে ৬৭টি সাভারে চালু হয়েছে। খুব শীঘ্রই আরও ১৫টি কারখানা চালু হতে পারবে। বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, গতবছর লক্ষ্যের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল। এবার লক্ষ্য পূরণ না হলেও কাছাকাছি পৌঁছাবে বলে তারা মনে করছেন। এবার গরুর ৫০ লাখ, মহিষের ৫ লাখসহ ছাগল-ভেড়া মিলিয়ে ৮০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ হবে বলে আশা করছেন এই ব্যবসায়ী নেতা। হাজারীবাগে কাঁচা চামড়ায় লবণ দেয়ার কাজটি করেছেন কেউ কেউ গ্যাস, বিদ্যুত পানি ও সংযোগ পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পর হাজারীবাগের কোন ট্যানারি এখন আর চালু নেই। তবে চামড়া শিল্পের সঙ্গে জড়িত কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হাজারীবাগে এবার কাঁচা চামড়ায় লবণ মিশ্রণের কাজটি করেছেন। এতে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন বাধা দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, আদালতের রায়ে হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশে বাধা দিতে বলা হয়নি। বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রশাসন চামড়ার প্রবেশ ঠেকিয়েছিল। কারখানা সরে যাওয়াতে চামড়া প্রবেশের বাধাও সরে গেছে। ট্যানারি সরে যাওয়ার পর হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশের বাধা তুলে নেয়া হয়েছে বলে হাজারীবাগ থানার ওসি মীর আলিমুজ্জামানও জানান। তবে তিনি বলেন, কাঁচা চামড়ায় লবণ দেয়ার কাজটি হাজারীবাগে করা যাবে। তবে চামড়া প্রক্রিয়ার অন্য কোন কাজ সেখানে করা যাবে না। কোরবানির পশুর বর্জ্যও রফতানি হবে কোরবানির পশুর কোন কিছুই এখন ফেলনা নয়। গরুর হাড়, শিং, চামড়া, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রনালি, চর্বি, রক্তের মতো বর্জ্যগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে প্রক্রিয়াজাত করা গেলে এগুলো যেমন লাগতে পারে জীবন সাজানোর কাজে, তেমনি জীবন বাঁচানোর কাজেও রয়েছে এগুলোর ব্যবহার। শুধু তাই নয়, এসব বর্জ্যরে অনেকই রফতানিযোগ্য, যা থেকে উপার্জিত হতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও। এসব পশুর বর্জ্যরে বড় বাজার হলো থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, চীন ও জাপান। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রচার নিশ্চিত করা গেলেই কোরবানির পশুর বর্জ্য হয়ে উঠতে পারে দেশের অর্থনীতির অন্যতম একটি খাত। ৫৫০ টাকার টাকার লবণ ১৪শ’ টাকা অতি মুনাফা করতে ৫৫০ টাকার লবণ এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪শ’ টাকা পর্যন্ত। ঢাকাসহ সারাদেশে এখন লবণের বাজার অস্থির। দাম যাতে না বাড়ে সেলক্ষ্যে সরকার ৫ লাখ টন লবণ আমদানির সুযোগ দেয়। কিন্তু ওই লবণ এখনও দেশে আনা সম্ভব হয়নি। আর এ কারণে বেড়ে গেছে লবণের দাম। ৭৫ কেজি লবণ প্রতিবস্তা ৫৫০-৬০০ টাকায় বিক্রি হলেও চাহিদা পুঁজি করে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪শ’ টাকা পর্যন্ত। লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় চামড়ার দাম পড়ে গেছে। বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, এবার চামড়ার দাম কম হওয়ায় পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত কোরবানির পশুর চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন ঢাকার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ঈদের পর গত দুই দিন ধরে রাজধানীর অলিগলি গিয়ে চামড়া কিনে আনার পর এখন পর্যন্ত সেগুলো বিক্রি করতে পারেননি তারা। পুরান ঢাকার পোস্তার কাঁচা চামড়ার আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিক্রেতাদের চামড়ায় লবণ লাগিয়ে দিতে হবে। এছাড়া মূল্যের সম্পূর্ণ টাকাও তারা নগদে দেবেন না। কেনার সময় অর্ধেক এবং বাকি টাকা সুবিধাজনক সময়ে পরিশোধ করতে চান তারা। এদিকে সময়মতো চামড়া বিক্রি করতে না পারলে তাতে পচন ধরবে। এত শর্ত মেনে চামড়া বিক্রির পর লোকসানের পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ রয়েছে, চামড়া ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকরা যৌথভাবে এবার চামড়ার বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছেন। নামমাত্র মূল্যে তারা চামড়া কেনার উদ্দেশ্যেই মাঠে নেমেছেন। চামড়া সংশ্লিষ্টরা বলেন, কারণে-অকারণে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দোষ দেয়া হয়। কিন্তু কেউ পৃষ্ঠপোষকতা করেন না। কোরবানির ঈদে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা মাঠপর্যায় থেকে চামড়া সংগ্রহ করে থাকেন।
×