ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথমদিন শেষে বাংলাদেশ ২৫৩/৬

মুশফিক-সাব্বিরের ব্যাটে স্বস্তি

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মুশফিক-সাব্বিরের ব্যাটে স্বস্তি

মোঃ মামুন রশীদ, চট্টগ্রাম থেকে ॥ সাগরিকায় দিনের শুরুতেই উত্তাল ঢেউ উঠেছিল ঘূর্ণি বলের ছোবলে। অস্ট্রেলিয়ার সাঁড়াশি স্পিন আক্রমণে কুঁকড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের টপঅর্ডার। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টের প্রথমদিন শেষে সাব্বির রহমান ও অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের অর্ধশতকে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে জমা হয়েছে ৬ উইকেটে ২৫৩ রান। অথচ অস্ট্রেলিয়ার ডানহাতি অফস্পিনার নাথান লিয়ন বাংলাদেশের টপঅর্ডার ৪ ব্যাটসম্যানকে এলবিডব্লিউ’র রেকর্ড গড়ে টালমাটাল করে দিয়েছিলেন। আগেই অনুমিত ছিল চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে স্পিন দাপট দেখাবে, সেই ঘূর্ণিবলের আঘাতেই মাত্র ১১৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বেসামাল বাংলাদেশকে রক্ষা করেন মুশফিক-সাব্বির। তাই শেষ পর্যন্ত স্বস্তি নিয়েই মাঠ ছেড়েছে বাংলাদেশ দল। মিরপুরের দুরন্ত তামিমকে নিজের বেড়ে ওঠা শহরের মাঠে শুরু থেকেই কেমন এক অস্বস্তি ভর করেছিল। যদিও আবার টস জিতে বাংলাদেশ ব্যাটিং করতে নেমেছিল। মিরপুরে টস জয়ের পর ম্যাচেও এসেছিল বিজয়। সাগরিকায় সেটা হওয়ার কারণে বাড়তি এক প্রশান্তি ও স্বস্তি ভর করেছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে ও বাংলাদেশ শিবিরে। যদিও সাগরিকায় গত দু’দিন এবং ম্যাচের দিনের ভোরেও বৃষ্টিশঙ্কা জাগিয়েছিল। কিন্তু ম্যাচ শুরুর তিন ঘণ্টা আগেই আলো ঝলমলে হয়ে ওঠে বন্দরনগরী। ঐতিহাসিক আরেকটি ম্যাচ। এর আগে তিনবার সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত সিরিজটাই জিতেছিল বাংলাদেশ দল। ২০০৫ ও ২০১৪ সালে জিম্বাবুইয়ে এবং ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেই কীর্তি দেখিয়েছিল টাইগাররা। এবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই তিনটি ঘটনার পুনরাবৃত্তির মোক্ষম সুযোগ মিরপুরে প্রথম টেস্ট জয়ের পর। সবকিছু পক্ষেই ঘটছিল যেন বাংলাদেশের। তবে বল গড়ানোর পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ব্যাট হাতে নামার পর শান্ত, সুস্থিরভাবেই খেলছিলেনÑ কিন্তু যেন কোথায় একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছিল। সেই অস্বস্তিটা আরও বেড়েছে দিনের সপ্তম ওভারেই একটি জীবন ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে। প্যাট কামিন্সের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন কিন্তু গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের হাত ফসকে মাটিতে পড়লো বলটিÑ আক্ষেপে মাটিতে পা ঠুকলেন স্টিভেন স্মিথ। কারণ মহামূল্যবান উইকেটটা এত দ্রুত লাভ করার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। তবে অসিদের আক্ষেপের আগুনটা লেলিহান করে তোলার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পেলেন না। তিন ওভার পরেই অফস্পিনার নাথান লিয়নের বলে লাইন মিস করে এলবিডব্লিউ হয়ে সাজঘরে ফিরেন অন্যতম এ পারফর্মার (৯)। ইমরুল কায়েস সেই আগের ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙ্গতে পারেননি, দলের বিপদ ঘনীভূত করেছেন তামিম সাজঘরে ফেরার মাত্র ৪ ওভার পরেই ৪ রান করে। লিয়ন ঘূর্ণির জোড়া আঘাতে কেঁপে ওঠা বাংলাদেশ দলের হাল নিতে উইকেটে আসেন দুই টেস্ট পর সুযোগ পাওয়া মুমিনুল হক, যার সর্বোচ্চ ১৮১ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস আছে সাগরিকায়। মিরপুরে স্পিনের দাপটে অসিদের মাথানত করে দেয়ার পর চট্টগ্রাম টেস্টে এক পেসার ও ৮ ব্যাটসম্যান ফর্মূলা নিয়ে দল সাজানোতেই বাংলাদেশের একাদশে অবশেষে সুযোগ পেয়েছেন এ টেস্ট স্পেশালিস্ট। ফলে এবারই প্রথম দেশের টেস্ট ইতিহাসে শীর্ষ চার ব্যাটসম্যানই বাঁহাতি হয়েছেন ব্যাটিং লাইনআপেÑ আর তাই ডানহাতি অফস্পিনার লিয়ন হয়েছেন দারুণ কার্যকর। অবশ্য গত সপ্তাহে মিরপুর টেস্টে চার বাঁহাতি টপঅর্ডার খেলেছেন তবে নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নেমেছিলেন তাইজুল ইসলাম। এরই প্রমাণ দিলেন একেবারে মধ্যাহ্ন বিরতির ঠিক আগে বাঁহাতি ওপেনার সৌম্য সরকারকেও এলবিডব্লিউ’র ফাঁদে ফেলে। ব্যর্থতার আগল ভেঙ্গে দারুণ পরিণত মস্তিষ্কে খেলছিলেন তিনি। তাকে ফিরতে হয়েছে ৩৩ রান করে। দলের ২১ রানে ২ উইকেট পতন ঘটার পর মনে হয়েছিল মিরপুরের চেয়ে ভালভাবে প্রথম সেশন শেষ করবে বাংলাদেশ। কিন্তু সৌম্যের উইকেট সেটা হতে দেয়নি। মিরপুর টেস্টে মাত্র ১০ রানে ৩ উইকেট হারিয়েছিল টাইগাররা। তৃতীয় উইকেটে অবশ্য দারুণ জমে উঠেছিল সৌম্য-মুমিনুলের জুটি। কিন্তু ৪৯ রান যোগ হওয়ার পর এই জুটিও ভেঙ্গে দেন লিয়ন। সৌম্য ফিরে যাওয়ার পরও দারুণ ছন্দ নিয়ে খেলছিলেন মুমিনুল। টানা দুই টেস্টের একাদশে খেলার সুযোগ না পাওয়া এ টপঅর্ডার এদিন চার নম্বরে নামেন। কিন্তু তিনিও লিয়নের স্পিনের কাছেই এলবিডব্লিউ হয়ে সাজঘরে ফেরেন ৩১ রান করার পর। চার টপঅর্ডারকে টানা এলবিডব্লিউ করার অনন্য নজির স্থাপন করেন লিয়ন। এরপর সাকিব আল হাসানের সঙ্গে যোগ দেন অধিনায়ক মুশফিক। দেখে শুনে সাবলীলভাবেই খেলছিলেন দু’জন। কিন্তু তাদের ছুটন্ত জুটিতে রাশ টেনে ধরেন আরেক স্পিনার এ্যাশটন এ্যাগার- ফিরিয়ে দেন সাকিবকে (২৪)। মাত্র ১১৭ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে চরম বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। সেখান থেকে নতুন করে দলকে টেনে তোলার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন মুশফিক-সাব্বির। এ জুটি অসিদের স্পিন আক্রমণকে অকার্যকর করে দেয়। উভয় দল এ ম্যাচে তিনজন স্পেশালিস্ট স্পিনার এবং একজন পেসার নিয়ে নেমেছিল। উভয়ে অর্ধশতক হাঁকান। ষষ্ঠ উইকেটে গড়ে ওঠে ১০৫ রানের জুটি। এই জুটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এটিই সেরা জুটির রেকর্ড। তাদের এমন ব্যাটিংয়ের কল্যাণেই চরম দুর্দশা কাটিয়ে ভালভাবে দিনটি শেষ করার রাস্তা পেয়ে যায় বাংলাদেশ দল। ক্যারিয়ারের ১৮তম অর্ধশতক হাঁকান মুশফিক। তবে তার আগেই হাফসেঞ্চুরি করেন সাব্বির। টানা ৮ ইনিংসে হাফসেঞ্চুরির দেখা না পাওয়া এ ব্যাটসম্যান দারুণ খেলছিলেন। কিন্তু লিয়ন তাকে শিকার করে ষোলোকলা পূর্ণ করেনÑ টানা তৃতীয় টেস্টে ৫ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব দেখান। সাব্বির দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার হন। তিনি ক্যারিয়ারের চতুর্থ অর্ধশতক হাঁকিয়ে ১১৩ বলে ৬ চার ও ১ ছক্কায় ৬৬ রান করে ফিরে যান। এটি তার ক্যারিয়ারসেরা ইনিংস। দিন শেষ হওয়ার মাত্র ৮ ওভার আগে তিনি সাজঘরে ফেরেন। তবে এরপর আর বিপদ ঘটতে দেননি মুশফিক-নাসির হোসেন। দিনটা শেষ করেছেন সুস্থির থেকে নির্বিঘেœ। তিন ইনিংস পর অর্ধশতক পাওয়া মুশফিক ১৪৯ বলে ৫ চারে ৬২ রান নিয়ে ব্যাট করছেন। তার সঙ্গে সপ্তম উইকেটে এখন পর্যন্ত ৩১ রান যোগ করা নাসির অপরাজিত থাকেন ১৯ রানে। এই ম্যাচে নামার আগে টেস্টে ১ হাজার রান পূর্ণ করার জন্য ৬ রান দরকার ছিল এ অলরাউন্ডারের। টেস্টে সেই মাইলফলক স্পর্শ করেছেন তিনি ১৪ নম্বর বাংলাদেশী হিসেবে। ৭০ রান দিয়ে ৫ উইকেট নেয়া লিয়নের ঘূর্ণিতে দিনের শুরুতে যে ঝঞ্ঝামুখর পরিস্থিতিতে হাপিত্যেশ করার মধ্যে ডুবেছিল টাইগাররা শেষ পর্যন্ত দিনের শেষটা হয়েছে ভালভাবেই। মিরপুরে ঐতিহাসিক বিজয়ের ম্যাচে প্রথমদিনেই মাত্র ২৬০ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল তারা। এবার তারচেয়েও বাজে কিছুর শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দিনশেষ করেও ৪ উইকেট হাতে রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ দল, রানও উঠেছে ২৫৩। কারণ দলে এবার ৮ ব্যাটসম্যান ফমূর্লা প্রয়োগ করেছে টিম ম্যানেজমেন্ট, এখনও ভালভাবে ব্যাট চালানোয় পারদর্শী মেহেদি হাসান মিরাজ আছেন। প্রথমদিন শেষে তাই স্বস্তিতেই বাংলাদেশ দল।
×