ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

(৩১ আগস্টের পর) যে কারণে আমেরিকা ১৯৭১ সালে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভ্যুদয় প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানের ইসলামপন্থী সামরিক জান্তার পাশে দাঁড়িয়েছিল, একই কারণে আমেরিকা এখনও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে বাংলাদেশকে ‘মডারেট’ ইসলামী দেশ হিসেবে দেখতে চায়, যে দেশ পরিচালনার জন্য তারা উপযুক্ত মনে করে জামায়াত-বিএনপি জোটকে, আওয়ামী লীগকে নয়। যেভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার জনগণ ও গণমাধ্যমকে আমাদের পাশে পেয়েছিলাম, একইভাবে তাদের এখন আমাদের বলতে হবে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে এখানে জঙ্গী মৌলবাদের যে উত্থান ঘটবে তার হামলা ও আক্রমণ থেকে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বও নিরাপদ থাকবে না। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে মৌলবাদী অসাংবিধানিক শক্তিসমূহকে পৃষ্ঠপোষকতা থেকে আমেরিকাকে যদি বিরত রাখা না যায়, মানবসভ্যতার যাবতীয় অর্জন ধ্বংস হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা আর কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা এক নয়। ১৯২৮ সালে মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ধর্মনিরপেক্ষতাকে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে গিয়ে সকল ধর্মীয় দল, প্রতিষ্ঠান এমনকি সুফীদের মাজারও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মসজিদের সংখ্যা সীমিত করে আরবির বদলে তুর্কি ভাষায় আজান চালু করেছিলেন। আমেরিকার হস্তক্ষেপ ছাড়াও এ নিয়ে তুরস্কের ভেতরেও যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল, বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলে। কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল ফ্রান্সের অনুরূপ, যেখানে সরকার ও রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ছিল বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিনির্ভর, যেখানে রাষ্ট্র ধর্মের ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য করবে না, সকল ধর্মকে সমান মর্যাদা দেয়া হবে। মুসলিম বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে পশ্চিমা জগৎ কামাল আতাতুর্কের কট্টর মতবাদ সম্পর্কে যতটা জানে, বঙ্গবন্ধুর উদার মতবাদ সম্পর্কে সে তুলনায় কিছুই জানে না। জামায়াত যেমন বলে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা, আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টে জামাতের সুহৃদরাও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাই মনে করেন। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানীকরণের জন্য বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ’৭২-এর সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলার পাশাপাশি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’র ঘোষণা অকার্যকর করবার জন্য সংবিধানের উপরে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজনের পাশাপাশি প্রস্তাবনায় ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা...’ ইত্যাদি যুক্ত করেছিলেন বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ বানাবার জন্য। এর পাশাপাশি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সার্বভৌম জাতীয় সংসদের অধিকার খর্ব করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বিচারকদের হাতে অর্পণ করেছিলেন, যেমনটি রয়েছে পাকিস্তানে। ২০০৮ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি অবৈধ জিয়াউর রহমান কর্তৃক বাতিলকৃত সংবিধানের চার মূলনীতি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনঃস্থাপন করেছে। এরপর ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ’৭২-এর সংবিধান অনুযায়ী যখন সংসদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে, তখন এর বিরুদ্ধে একজন রিট করেছেন এবং সুপ্রীমকোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন। উচ্চতর আদালতের প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার এই রায়ের পর্যবেক্ষণে এমন সব কথা বলা হয়েছে যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে শুধু চ্যালেঞ্জ করা হয়নি, বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চেতনাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা, যা ’৭২-এর সংবিধানে উল্লেখ করার আগে তাঁর রচনাবলীতেও বারবার আলোচিত হয়েছে। যে কোন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হচ্ছে জনগণ, যা আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের (১) ও (২) ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এই ধারা লঙ্ঘন করার জন্যই ২০১৩ সালে উচ্চতর আদালত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে এই দলটিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন। এই রাষ্ট্রে জনগণের সকল ক্ষমতার মালিকানার উৎস হচ্ছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত জাতীয় সংসদ। এই সংসদ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পীকার নির্বাচন করে। প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ এই তিন পদের অধিকারীদের অপসারণের ক্ষমতাও এই সংসদের। যে সংসদ দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও অপসারণের ক্ষমতা রাখে সেই সংসদ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সাংবিধানিক পদে আসীন কাউকে অপসারণ করতে পারবে না- এটা জনগণের মালিকানা অগ্রাহ্য করার শামিল। সংবিধানই বলছে প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন পদে যারা কর্মরত থাকেন তারা সবাই জনগণের সেবক, মালিক নন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন দেয়া হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদের অধিকারী আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বহুবার বলেছেন, তাঁরা রাষ্ট্র বা জনগণের মালিক নন, সেবক মাত্র। অথচ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এমন সব মন্তব্য করেছেন- যে বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বলেছেন, এটা মানতে হলে বাংলাদেশ আর পিপলস রিপাবলিক থাকে না, ‘জাজেস রিপাবলিক’ হয়ে যায়। আমরা প্রধান বিচারপতিকে স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই- আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বা ‘পিপলস রিপাবলিক’ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের মূল্যে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রধান অর্জন হচ্ছে ১০ মাসের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর একটি অনন্য সাধারণ সংবিধান রচনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর প্রধান সহযোগী যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের হত্যা করা হয়েছে ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের জন্য, তাঁদের প্রণীত সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানাবার জন্য। পাকিস্তানপন্থীদের এসব ষড়যন্ত্র অতীতে যেভাবে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধে পর্যুদস্ত হয়েছে, আগামীতেও হবে। ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’কে কেউ ইচ্ছে করলেই ‘জাজেস রিপাবলিক’, ‘মোল্লা রিপাবলিক’ বা ‘আর্মি রিপাবলিক’ বানাতে পারবে না। আমাদের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা একজন আত্মস্বীকৃত পাকিস্তানপ্রেমী। ’৭১-এর গণহত্যার অন্যতম লক্ষ্য হিন্দু বা অমুসলিম জনগোষ্ঠী হলেও রাজাকারদের তালিকায় কিছু হিন্দু নামধারীও ছিল। রাজা ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে আমৃত্যু পাকিস্তানেই ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার যখন বিচারপতি এস কে সিনহাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয় তখন আমরা সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম- জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের সাম্প্রদায়িক নিয়োগ নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য। জামায়াতিরা তখন আপত্তি করেছিল- ‘হিন্দুকে প্রধান বিচারপতি করা যাবে না’ বলে। আমরা তখন এর প্রতিবাদ করেছিলাম। আশা করেছিলাম তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে দুই পাকিস্তানপ্রেমী জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ কর্তৃক কলঙ্কিত সংবিধানের সাম্প্রদায়িক বিষয়গুলো বাতিলের উদ্যোগ নেবেন। সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বাতিল করে দেবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের জন্য গত বছর আমরা উচ্চতর আদালতে যে রিট করেছিলাম, কোন শুনানি ছাড়া দু’মিনিটে তা খারিজ করে দেয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ও আলবদর নেতা কামারুজ্জামানের মামলার আপিল শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দাবি করেছেন- ’৭১ সালে তিনি ‘শান্তি কমিটি’র সদস্য ছিলেনÑ জামায়াত, মুসলিম লীগাররা যে সংগঠনের জন্ম দিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধে সহযোগিতা জন্য। মি. সিনহার এই স্বীকারোক্তির পর আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলাম, এরপর তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কোন সাংবিধানিক পদে থাকতে পারেন না। তাঁর আদালতে শান্তি কমিটির অন্যতম প্রধান নেতা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিল, কিন্তু তা মানা হয়নি। গোলাম আযমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল, যার কিছুদিন পর এই যুদ্ধাপরাধী শাস্তি ভোগ না করে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। এরপর বিচারপতি সিনহা অন্যতম শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী সাকা চৌধুরীর মামলা চলাকালে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করে যে অসদাচরণ করেছেন আমরা তারও প্রতিবাদ করেছি। আমরা তখন জোরালো প্রতিবাদ না করলে সাঈদীর মামলার মতো সাকা চৌধুরীও যে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি পেতÑ এই মর্মে তখন ব্যাপক প্রচারণা চলছিল। প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণের কিছু শব্দ ও বাক্য পরিবর্তনের জন্য তারা রিভিউর আবেদন করবেন। আমরা মনে করি পর্যবেক্ষণের কিছু শব্দ বা বাক্য নয়, পুরো রায় সংশোধন করতে হবে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে এই রায় আমাদের সুপ্রীম কোর্টকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিপক্ষে পরিণত করতে চাইছে। প্রধান বিচারপতি সিনহা পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থাকে আমাদের চেয়ে উত্তম ও আদর্শস্থানীয় মনে করেনÑ যে দেশের সুপ্রীমকোর্ট বার বার অসাংবিধানিক ক্ষমতাদখলকে, সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়েছে। পাকিস্তানের সুপ্রীমকোর্ট এখনও মোল্লা, মিলিটারির তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করছে! ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মামলার শুনানিতে ’৭২-এর অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম তাদের বিশেষজ্ঞ মন্তব্য প্রদান সম্পর্কে বলেছেন, ’৭২-এর বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতা এক নয়। ’৭২-এর সংবিধান রচনায় তাঁদের অবদানের প্রতি যাবতীয় শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই- পাকিস্তানপ্রেমী দুই জেনারেল এই ‘বাস্তবতা’র কথা বলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর সংবিধানের উপর বার বার বলাৎকার করেছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের নজিরবিহীন রায় সম্পর্কে আমাদের সমালোচনার প্রধান কারণ হচ্ছে, ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায় গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত রাষ্ট্রের উপর জনগণের মালিকানা অস্বীকার করার পাশাপাশি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত ইতিহাস ও চেতনাকে সরাসরি আঘাত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিএনপি, জামায়াত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী তাবত রাজনৈতিক মহল থেকে এতকাল যা বলা হয়েছে এই রায় তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থানকে আইনি বৈধতা দিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান এবং কেন তিনি জাতির পিতা এ বিষয়ে অসাধারণ মন্তব্য করেছেন তুরস্কের মানবাধিকার নেত্রী মাদাম ভাসফিয়ে জামান। তুরস্কে মুস্তফা কামাল আতাতুর্ককে জাতির পিতা বলা হয়। ‘আতাতুর্ক’ শব্দের অর্থই হচ্ছে জাতির পিতা। তুরস্কে তার চরম প্রতিপক্ষ বর্তমানে যে দল (একেপি) ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে তারা কখনও বলেনি মুস্তফা কামাল ‘আতাতুর্ক’ বা জাতির পিতা নন। আমার প্রামাণ্যচিত্র ‘দি আল্টিমেট জিহাদ’-এ আতাতুর্কভক্ত মাদাম ভাসফিয়ে জামান বলেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে আতাতুর্কের চেয়েও বড় নেতা মনে করেন। তাঁর যুক্তি হচ্ছেÑ আতাতুর্ক মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন কিন্তু নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেননি। স্বাধীন তুরস্ক আতাতুর্কের জন্মের হাজার বছর আগেও ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি একটি নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন। ‘এ কারণেই তিনি জাতির পিতা। হাজার বার বলব তিনি জাতির পিতা।’ এ কথা আমার নয়, তুরস্কের একজন বর্ষীয়ান মানবাধিকার নেত্রীর। একইভাবে ভারতের বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বঙ্গবন্ধুকে তাদের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর চেয়ে বড় নেতা মনে করেন। এমনকি ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক ইন্দিরা গান্ধীও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, তিনি শুধু ইতিহাস সৃষ্টি করেননি, ভূগোলও সৃষ্টি করেছেন। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ করবার জন্য ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তাও বঙ্গবন্ধুকেই দায়ী করেছিল, অন্য কাউকে নয়। এ কথা আমরা বহুবার বলেছি- বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা কিংবা তাঁর অবিসংবাদী নেতৃত্ব অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা, যা একমাত্র পাকিস্তানীরা করতে পারে। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার মন্তব্যকে হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। এ বিষয়ে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক বলেছেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী রায়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করা হয়েছে তা মোটেই ঠিক হয়নি। এই রায় তো ডকুমেন্ট। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর যদি বিদেশ থেকে কেউ এসে এ রায় পড়ে তাহলে ভুল বার্তা পাবে। আগামী প্রজন্মও এ রায়ের মাধ্যমে ভুল বার্তা পাবে। তারা বলবে এই যে, রায়ে বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর একা নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়নি।’ (জনকণ্ঠ, ১৮ আগস্ট ২০১৭) মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এ ধরনের ছিনিমিনি খেলা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাবার চক্রান্তের অন্তর্গত। এ কারণে আমরা বর্তমান সরকারকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার অপরাধ আইন’ প্রণয়ন করতে বলেছি। বিচারপতি খায়রুল হক স্বাধীন বাংলাদেশে একমাত্র বিচারক যিনি তাঁর বিভিন্ন রায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার প্রতি দেশ ও জাতির দায়বদ্ধতার কথা বার বার বলেছেন, সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করে সামরিক সরকারের যাবতীয় সংবিধান সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। ষোড়শ সংশোধনীর আলোচ্য রায় সামরিক শাসকদের দুষ্কর্মকে বৈধতা দিতে চেয়েছে। বাংলাদেশের মূল সংবিধান থেকে রাষ্ট্রের উপর জনগণের মালিকানা সামরিক শাসকরাই হরণ করেছিল। ষোড়শ সংশোধনীর রায় সম্পর্কে সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক জাতির বিবেকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী অপশক্তি তাঁর বিরুদ্ধে এবং বিচারপতি সিনহার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক-সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানাবার জন্য সে দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’ তাদের এদেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে যে বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র করছে, তা এখনও অব্যাহত আছে। আমাদের বার বার বলার পরও ’৭১-এর গণহত্যার জন্য ‘জামায়াতে ইসলামী’, ‘রাজাকার’, ‘শান্তি কমিটি’, ‘আলবদর’, ‘আলশামস’ প্রভৃতির বিচার এখনও শুরু হয়নি। আমরা আবারও দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে ট্রাইব্যুনালে বিচার করে এসব সংগঠন নিষিদ্ধ করতে হবে। জাতীয় সংসদে নতুন একটি প্রস্তাব পাস করতে হবেÑ বাংলাদেশের কোন সাংবিধানিক পদে এবং প্রজাতন্ত্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে এসব অপরাধী সংগঠনের সঙ্গে কোনভাবে যুক্ত কোন ব্যক্তি থাকতে পারবেন না। সংবিধানের মূল ধারা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মূলভিত্তি হচ্ছেÑ রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে জনগণের মালিকানা। এটি অগ্রাহ্য করার জন্য যে যুক্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে একই যুক্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ও কার্যকারিতা হারায়। জনগণের ও রাষ্ট্রের সেবকদের বার বার মনে করিয়ে দিতে হবেÑ তারা এই প্রজাতন্ত্রের মালিক নন। জনগণকে বোঝাতে হবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের মূল্যে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে, জনগণের অধিকার নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর সংবিধান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার আমরা কাউকে দিইনি। বঙ্গবন্ধুর সংবিধান কার্যকর থাকলে বাংলাদেশে আজ ধর্মের নামে এত নির্যাতন, হানাহানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, রক্তপাত হতো না। বাংলাদেশের ৪৬ বছর এবং পাকিস্তানের ৭০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যাবতীয় গণহত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাসের জন্য দায়ী জামায়াতে ইসলামী, যা তারা করেছে ইসলামের দোহাই দিয়ে। বাংলাদেশ যদি একটি আধুনিক ও সভ্য রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়, যদি আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে চায়, যদি যুদ্ধ-জিহাদ বিধ্বস্ত বিশ্বে মানবকল্যাণ ও শান্তির আলোকবর্তিকা জ্বালাতে চায়, তাহলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করে রাজনীতি, সমাজ ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু ধারণ নয়, বাস্তবায়নের জন্য লড়ে যেতে হবে নিরন্তর। (সমাপ্ত)
×