ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নোবেল শান্তি পুরস্কারই কি অশান্তির মূল?

প্রকাশিত: ০৩:২৩, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

নোবেল শান্তি পুরস্কারই কি অশান্তির মূল?

২০১৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের এক উপ-সম্পাদকীয় পড়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ে সেই উপ-সম্পাদকীয়ের লেখক লিখেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ওপর দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের বাণী প্রচার করছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আউং সান সুচি। লেখক মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশে দেশটির সেনাবাহিনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের দ্বারা চরমভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত রোহিঙ্গা মুসলমানদের শরণার্থী শিবিরের কথাই বলেছেন। মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্র কিছুদিন আগেই এক বিবৃতিতে মিয়ামনারে ‘এথনিক ক্লিনসিং’ বা সংখ্যালঘু-নিধনযজ্ঞ চলছে বলে মন্তব্য করেছিলেন এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী ও দেশটির ডি-ফ্যাক্টো কত্রী এতে গোস্্সা হয়ে বলেছিলেন, যা সাদা চোখে দেখা যায় তাই-ই সব সময় সত্য নয়, তার বাইরেও সত্য আছে। আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে সেই সত্য থেকে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে হবে। তিনি এও ইঙ্গিত করেন যে, প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে তার দেশে এ রকম অশান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং রোহিঙ্গাদের তিনি আসলে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেও স্বীকৃতি দিতে গরিমসি করেছেন তার বক্তব্যে। জাতিসংঘের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল মিয়ানমার সংলগ্ন বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং সেখানে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে যে রিপোর্টটি দেন, তা মূলত ভয়াবহ স্পর্শকাতর। কিন্তু দুঃখজনক হলো, সাবেক এই জাতিসংঘ মহাসচিবের রিপোর্টকে না মিয়ানমার সরকার গ্রহণ করেছে, না স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ^ মোড়ল হিসেবে যে সব রাষ্ট্রকে আমরা চিনি, তারা। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি একে অপরের ওপর দোষ চাপানোর মধ্য দিয়ে এখন এমন একটি জায়গায় এসে পৌঁছেছে, যে কেউ চাইলেই আসল সত্যটি বের করে আনতে পারছে না। কারণ, রাখাইন রাজ্যে সাংবাদিক প্রবেশ একেবারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও পশ্চিমা গণতন্ত্রের দেবী আউং সান সুচি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চলছে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। যদিও এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য কারও পক্ষেই জানা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এই নির্যাতনের খবর মিয়ানমার অস্বীকার করছে আর নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে যেসব তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে, তার কিছু কিছু অতিরঞ্জিত বলে প্রমাণিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিকভাবে এসব তথ্য ও ছবির উৎস সম্পর্কে কখনই নিঃসন্দেহ হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ব্রিটেনের ডেইলি মেইল পত্রিকা এক রোহিঙ্গা শিশুর ছবি ছেপে তা পরবর্তীতে সংবাদ মাধ্যম থেকে তুলে নিতে বাধ্য হয়। কারণ, পরে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ছবিটি আসলে একটি কলাম্বিয়ান শিশুর। এ রকম আরও অনেক ঘটনার উল্লেখ করা যায়। কিন্তু তাতে এটি প্রমাণিত হয় না যে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নির্যাতন চালাচ্ছে না। অপরদিকে এও সত্য যে, লাখ খানেক রোহিঙ্গা মুসলিম যারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে, তাদের মধ্য থেকে বাংলাদেশ সরকারের নথিতেই প্রায় শ’খানেক ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে তারা বিভিন্ন রকম অপরাধ ও জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। মিয়ানমার সরকারও বার বার এ কথা জোর দিয়েই বলার চেষ্টা করছে যে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভেতর ক্রমবর্ধমান জঙ্গীবাদী তৎপরতা দেশটির অভ্যন্তরীণ শান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এসব জঙ্গী প্রায়শই মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালায় এবং স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শত্রু জ্ঞানে তাদেরও আক্রমণ করে। ফলে এই রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই কঠোর হতে হয়েছে। অনেকেই বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একদল মানুষ রয়েছেন, যারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনকে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করতে চান এবং এই আন্দোলনে বাংলাদেশের সমর্থন দাবি করেন। মিয়ানমারের সরকারী হিসাবমতে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪ ভাগ মুসলিম এবং দেশটির ইতিহাসে মুসলমানদের রয়েছে বিশেষ অবস্থান। রাখাইন রাজ্য ছাড়াও অন্যান্য রাজ্যে বিশেষ করে রাজধানী ইয়াঙ্গুনে রয়েছে মুসলমানদের বসবাস। কিন্তু কেন কেবল রাখাইন রাজ্য ছাড়া অন্যত্র মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী কোন ধরনের নির্যাতন চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায় না, এ প্রশ্ন নিঃসন্দেহে একটি মুখ্য আলোচনার বিষয়। এ প্রশ্নও আলোচনার বাইরে নয় যে, ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে কোন জাতীয়বাদী আন্দোলন হয় কিনা। কিন্তু রাখাইন রাজ্যে ঘটা মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের যেসব ভয়াবহ তথ্য ও ছবি ইতোমধ্যেই পৃথিবী জেনেছে, তার সবটা যদি সত্যি নাও হয় তাহলেও কি এসব প্রশ্ন দিয়ে সভ্য পৃথিবী তাকে ঢেকে রাখতে পারবে? নাকি সেটা উচিত হবে? তাই এই প্রশ্নটি জোরালোভাবে তোলা প্রয়োজন যে, মিয়ামনারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন এবং এটি বন্ধ করার জন্য সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান দায় ও দায়িত্বটি আসলে কার? এই প্রশ্নের সোজা-সাপ্টা উত্তর হচ্ছে, এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। কিন্তু যেহেতু রোহিঙ্গা ইস্যুটি এরই মধ্যে একটা আন্তর্জাতিক চেহারা নিয়েছে, বিশেষ করে শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে এবং বাংলাদেশের বাইরেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে, সেহেতু আন্তর্জাতিক কমিউনিটিও রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিষয়ে চোখ বন্ধ রাখতে পারে না, পারা উচিতও নয়। আগেই বলেছি যে, পশ্চিমা মোড়লদের কাছে আউং সান সুচি একজন গণতন্ত্রের দেবী। তিনি মিয়ানমারে দীর্ঘ সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে সেখানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন বলে এখনও পশ্চিমারা ভীষণ আশাবাদী। যদিও আউং সান সুচির দেড় বছরেরও বেশি বয়সের সরকার, যেখানে তিনি সাংবিধানিকভাবেই এমন একটি পদ তৈরি করে বসে আছেন যে, তাতে তাকে কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। কিন্তু সেটিও বড় কথা নয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে দেশটিকে মোটা দাগে ভাগ করে নিয়েছেন, যেখানে দেশটির কিছুটা অংশের মালিক আউং সান সুচি। যেমন রাখাইন প্রদেশের ক্ষেত্রে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যেখানে ভয়ঙ্কর নির্যাতনমূলক অভিযান চালাচ্ছে, সেখানে আউং সান সুচির খুব বেশি কিছু বলার মতো কথা আছে বা তা সেনাবাহিনী রাখবে, এমনটি ভাববার কোন কারণ নেই। কিন্তু তারপরও আউং সান সুচির নির্বাচিত সরকার কতটা গণতান্ত্রিক, তা নিয়ে খোদ পশ্চিমেও প্রশ্ন উঠেছে। ব্রিটেনের জাতীয় দৈনিকগুলো নিয়মিতভাবেই মিয়ানমার সম্পর্কে খবর প্রকাশ করে থাকে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নেমে আসা নির্যাতন নিয়েই থাকে সে সব খবর, যা মূলত বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে সংগ্রহ করা। এর কারণও মূলত এটাই যে, ব্রিটেন মনে করছে ১৯৪৮ সালে যে বর্মা থেকে তাদের চলে আসতে হয়েছিল, সেখানে নতুন করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে তাদের আউং সান সুচির সঙ্গে সম্পর্ক ভাল রাখতেই হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একই কথাই প্রযোজ্য। আমরা জানি যে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট একাধিকবার মিয়ানমার সফর করেছেন এবং এই দেশগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের নানাবিধ সম্পর্ক ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয় তা হলো, চীনের প্রভাব থেকে মিয়ানমারকে বের করে এনে পশ্চিমাদের তাঁবেদার রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করাতে সুচি এখনও সক্ষম হননি। তিনি সেই প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয় এবং তার বিখ্যাত শান্তি পুরস্কারটিও আসলে এসব কারণেই তিনি পেয়েছিলেন বলে পশ্চিমা গণমাধ্যম স্বীকার করে। কিন্তু পশ্চিমাদের আউং সান সুচিকে নিয়ে মোহভঙ্গ হয়েছে কিনা সে বিষয়ে বেশ জটলা তৈরি হয়েছে। নিবন্ধের শুরুতেই নিউইয়র্ক টাইমসের যে প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, তা কিন্তু আমাদের এই জটলারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। একই কথা প্রযোজ্য দ্য গার্ডিয়ান, টাইমস বা ডেইলি মেইল বা বিবিসিতে প্রকাশিত-প্রচারিত সংবাদ বা সংবাদ-বিশ্লেষণ, যা রোহিঙ্গা-নির্যাতনকে কেন্দ্র করে আউং সান সুচিকে সমালোচনায় ঠাসা। তা থেকে এটুকু অন্তত বোঝা যাচ্ছে যে, পশ্চিম একটু হলেও সুচির ওপর বিরক্ত। এটা কতটা তাদের কাক্সিক্ষত মোক্ষ দেয়ার ক্ষেত্রে সুচির ব্যর্থতা আর কতটা রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি মানবিক দায়িত্ব থেকে করা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কারণ পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিবেকের পারা তাদের স্বার্থের সঙ্গে ওঠানামা করে। যখন আর কিছুই পাওয়া যায় না, তখন সংশ্লিষ্ট দেশটিতে মানবাধিকার নেই বলে তার ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু যাই-ই হোক না কেন, মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে নিপীড়ন-নির্যাতন হচ্ছে, তা কোনভাবেই একজন শান্তি পুরস্কার বিজয়ী, গণতন্ত্রপন্থী নেতার কাছ থেকে আশা করা যায় না। তিনি এই বিষয়টি স্বীকারই করছেন না এবং তার প্রশাসন একে হাস্যকরভাবে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে অনবরত। আউং সান সুচি ছাড়া আরও অনেক নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের কথা আমরা বলতে পারি, যারা আসলে পৃথিবীকে কেবল অশান্তই করেছেন বা এখনও করে চলেছেন। ওবামাকে কোন কিছু করে দেখানোর আগেই শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল। কিন্তু তার হাত দিয়ে আমরা ভয়ঙ্কর আইসিসের জন্ম ও উত্থান ঘটার ভয়াবহ গল্প জানি। বাংলাদেশের শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। এটা নিশ্চিত যে, এই শান্তি বিজয়ী তার ফেলো আউং সান সুচিকে কোনদিন এ আহ্বান জানাবেন না যে, অবিলম্বে যেন রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করা হয়। অথচ এদেশে তার রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সমর্থকগণ বাংলাদেশ সরকারকে ‘আরও মানবিক’ হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের এ দেশে আশ্রয় ও সাহায্য-সহযোগিতা দেয়ার জন্য চেঁচিয়ে মরছেন। অথচ রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন আবারও প্রমাণ করছে যে, নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়েও দেশে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। শান্তির সূত্র আসলে নিহিত মানবিকতার ভেতরেই। ঢাকা ॥ ৩০ আগস্ট, বুধবার ॥ ২০১৭ ॥ [email protected]
×