ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অরুণ কুমার বিশ্বাস

বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি

প্রকাশিত: ০৩:২১, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি

বন্ধু কে, বন্ধুত্ব কী ও কত প্রকার- এ নিয়ে মেলা যুক্তিতর্ক চলে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। স্বভাবতই সে একা থাকতে পারে না। তার স্বজন চাই, বন্ধুও চাই। বন্ধু শব্দটি শুনতে যত সহজ ও ছান্দসিক বলে মনে হয়, আদতে বন্ধুত্ব তত সহজলভ্য নয়। খাঁটি বন্ধু পাওয়া রীতিমতো কঠিন ব্যাপার। নির্ভেজাল ঘি বা খাঁটি মধুর মতোই প্রকৃত বন্ধু পাওয়া দুষ্কর বৈকি! সেই যে ভালুক আর আর দুই বন্ধুর গল্প, মনে আছে নিশ্চয়ই। এমনিতে তাদের খুব ভাল বোঝাপড়া। একসঙ্গে হাঁটে-চলে খেলা করে। কিন্তু যেই বিপদের মেঘ ঘনায়মান, অমনি তাদের বন্ধুত্ব গেল টুটে। যে বন্ধু গাছে চড়তে জানে, সে অমনি প্রাণ বাঁচাতে গাছের ডালে চড়ে বসল। ওদিকে যে গাছে চড়তে জানে না, সে প্রাণের মায়া ভুলে মাটিতেই শুয়ে পড়ল। শুনেছে, ভালুক মরা মানুষ খায় না। বরাতজোরে যদি সে বেঁচে যায় তো ভাল। নইলে প্রাণ গেল। কিরে বন্ধু, ভালুক তোর কানে কানে কী বলল? স্বার্থপর বন্ধু জানতে চায়। ভালুক বলল, বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। বিপদ দেখলে যে বন্ধুকে ফেলে পালায়, মোটেও সে তোমার বন্ধু নয়। সে শত্রুরও অধম। অপর বন্ধু বলল। হক কথা বটে। আমাদের জানাশোনার চৌহদ্দিতে বিশ^স্ত বন্ধু খুব কমই আছে। প্রায় সবাই স্বার্থের টানে কাছে আসে, কিছুদিন পানকৌড়ির মতো ঘুরপাক খায়, আবার স্বার্থ ফুরালে কেটে পড়ে। একেই বলে দুধের মাছি বা মৌসুমি পাখি। দুধ শেষ তো মাছিও উধাও। ষোড়শ শতকের ইতালিয়ান কূটনীতিক ও পলিটিক্যাল থিওরিস্ট নিকেলো ম্যাকিয়াভেলি অবশ্য তার ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে বন্ধুত্বের একটা ভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি যে প্রেক্ষিতেই বলুন না কেন, আমার কিন্তু বেশ মনে ধরেছে। ম্যাকিয়াভেলির মতে, শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়। এর নাম কূটনৈতিক বন্ধুত্ব। আপনি একজনকে দেখতে পারেন না। রহিমও তাকে দেখতে পারে না। তার মানে আপনারা দুজন তার কমন শত্রু। তাই রহিমের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব হতে বাধ্য। এখানেও অবশ্য স্বার্থগন্ধ আছে। নইলে রহিমের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব হতো না। বস্তুত, এসব ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব থেকেই বন্ধুত্বের শুরু। উদ্দেশ্য মোটেও মহৎ নয়। আবার ইংরেজ দার্শনিক ও এ্যাটর্নি ফ্রান্সিস বেকন (রজার বেকন নয় কিন্তু) বন্ধুত্বের একটা বেড়ে সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার মতে, বন্ধু মানেই উপকারী একজন। প্রকৃত বন্ধু আপনার কাজে আসবে। আপনি চাইলেও তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন না। বন্ধুর কাজই হলো রোদে-শ্রাবণে আপনার পাশে থাকা। মোটেও সে অতিথি পাখি নয়। রবিঠাকুর অবশ্য বলেছেন, দেবে আর নেবে, মিলিবে মেলাবে, যাবে নাহি ফিরে! অর্থাৎ এখানেও একটা দেনা-পাওনার ব্যাপার আছে। একেবারে অহেতুক কোন সম্পর্ক আদতে হয় না। টেকেও না। কিছু একটা কাহিনী থাকা চাই। নইলে বন্ধনে আঁশ থাকবে কেন! আর সম্পর্কে যখন আঁশ কেটে যায়, তখন তারা একে অপরকে বাঁশ দিতে উদ্যোগী হয়। একটা কথা হামেশা শোনা যায়, জানি জিগার দোস্ত। মানে একে অপরের জন্য জান কোরবান! বন্ধু ছাড়া জীবন চলে না টাইপ মারফতি ধারণা। বাস্তবে এর কতটা সত্যি! মানুষ জন্মগতভাবেই স্বার্থান্ধ। মূলত সে নিজের জন্য বাঁচে। ম্যান ইজ ফর হিমসেল্ফ। তবুও আবেগের তাড়নায় আমরা অনেক সময় আগড়ম বাগড়ম মেলা কিছু বলে ফেলি। বিশেষত যারা বাছুর প্রেম করছে, তাদের কাছে মনে হয় নিজস্ব বলে কিছু নেই। সবই ওর বা তার! বাহ্ বাহ্! কী প্রেম! জমে একেবারে আইসক্রিম! নাদান আর কাকে বলে! বেকনের কথা আবারও বলা যায়। তিনি বলেন, বন্ধুত্ব বিশেষ দরকারি জিনিস। যেসব কাজ বা কথা নিজে বলা বা করা যায় না, সেসব ক্ষেত্রে আমাদের বন্ধুর প্রয়োজন পড়ে। যেমন ধরুন, মেয়ে দেখতে গেছেন। মেয়েপক্ষ বরের ব্যাপারে জানতে চায়। নিজের মুখে সব কথা বলা যায় না, বলাটা শোভনও নয়। বন্ধু তখন খুব কাজে আসে। একটু বাড়িয়ে ছড়িয়ে বরের বিষয়ে লম্বা একখানা ফিরিস্তি মেলে ধরতে পারে। তার আছে হয়ত একটা পুরনো বাইক, বলে দিল কোটি টাকার হ্যামার। মামুলি কোন চাকরি করে, বন্ধু তার পক্ষ নিয়ে বলল, বর তো আপনাদের কর্পোরেট বস! টাকা গোনার সময় নেই। কখনও কখনও অবশ্য হিতে বিপরীতও হতে পারে। কেন, সেই কৌতুকের কথা মনে নেই! বর সামান্য কাশি দিতেই মেয়ের বাপ হা হা করে উঠল। সে কি বাবাজীবন, ঠা-ার ধাত আছে নাকি! অমনি জানের বন্ধু পরাণের পরাণ আবেগতাড়িত হয়ে বলে বসল, ঠা-ার ধাত বলছেন কি, ওর তো যক্ষ্মা আছে! ব্যস, কম্মো কাবার। বিয়েটিয়ে আর হলো না। পত্রপাঠ বিদায়! এই জন্যই বলে, গোমূর্খ বন্ধুর চেয়ে বুদ্ধিমান শত্রুও ভাল। এবার আসুন প্রেম ও বন্ধুত্বের ফারাকটা একটু বুঝি। অনেকেই এদুটোকে গুলিয়ে ফেলে। কে বন্ধু আর কে নয়, তা বুঝতে না পেরে শেষে লেজেগোবরে আর কি! প্রেমে বন্ধুত্ব থাকতেই হবে, তবে বন্ধুত্ব মানেই প্রেম নয়। ইদানীং কিছু চালিয়াত ছেলে-ছোকরা অবশ্য নিপাট বন্ধুত্ব দিয়ে শুরু করে শেষে ঘুঁটি উল্টে প্রেমিকের সুরে কথা কয়! এর নাম গিরগিটিগিরি। সহসা ধরা যায় না। তবে কথা মিথ্যে নয় যে, প্রেম বলুন আর যাই বলুন, শুরুটা ওই বন্ধুত্ব দিয়েই হয়। কাছে আসতে গেলে ইনিয়েবিনিয়ে দুচার পাতা পত্রালাপ, থুক্কু, এখন তো আর রাত জেগে চিঠি লেখা নেই, যাকে বলে ডাইরেক্ট এ্যাকশন। প্রেম চাই, বন্ধুত্বও চাই। অনেকটা রাজনৈতিক সেøøাগানের মতো শোনায়। কিন্তু ভায়া, চাইলেই তো হবে না। জীবনে আমরা মেলা কিছু প্রত্যাশা করি, তার কতটা পাই বলুন! প্রেম ভীষণ গোলমেলে ব্যাপার। তারচে’ বন্ধুত্ব ভাল। তাতে আবেগ আছে বটে, তবে চাপাচাপি নেই। সময়মতো দেখা করতে আসতেই হবে, নইলে সম্পর্ক নট- এ জাতীয় জোর-জবরদস্তি করে আর যাই হোক, সম্পর্ক টেকে না। নিখাদ বন্ধুত্ব বিরল বটে, তবে একেবারে যে নেই তা বলব না। প্রচুর স্বার্থত্যাগ, বোঝাপড়া আর মায়া-মহব্বত না থাকলে বন্ধুত্ব হয় না। আমি অনেককে বলতে শুনেছি, ছেলেটা ত্যাঁদড়, একনম্বর ফাজিল। কিন্তু তাও ওকে ছাড়তে পারি না। কেমন যেন মায়া মায়া লাগে। কী, ভাবছেন তো আমি প্রেমের সঙ্গে বন্ধুত্ব গুলিয়ে তালের পিঠা ভাজছি! মোটেও না। এই অদৃশ্য টান বন্ধুত্বেও বড্ড জরুরী। নইলে শুধু একটা বাঁশের ওপর সম্পর্কটা দাঁড়াবে কি করে! তাই বলে কি দুজন মানুষের মাঝে খোঁচা-খুনসুটি থাকবে না! আলবত থাকবে। ভিন্নমত আছে বলেই তো ঐকমত্যের এত দাম! একে অপরের মতামতকে সম্মান না করতে পারলে কিসের বন্ধুত্ব! মানতে হবে, আবার মেনেও নিতে হবে। দিল্ সে। মতান্তর হবে, কিন্তু মনান্তর নয়। কিছুতেই আঁতে ঘা দেয়া চলবে না। তাতে বন্ধুত্বের ভিত নড়ে যায়। সম্পর্কের ফেঁসো উঠে যায়। কেউ কেউ বলে, দূরে গেলে বন্ধুত্ব ফিকে হয়ে যায়। আমি মনে করি, আংশিক সত্যি। এমনও অনেকে আছেন যাদের বছরের পর বছর দেখা হয় না অথচ তারা একে অপরকে অনুভব করেন। মনে মনে খোঁজ নেন। সম্পর্ক মানেই মনের কারবার। এই অন্তঃজ সম্পর্কে জাগতিক লোভ-লালসা ও চাওয়া-পাওয়া যত কম আসে, সম্পর্ক ততই নিটোল ও অটুট থাকে। এখানেই অন্য সম্পর্কের থেকে বন্ধুত্বের পার্থক্য ও মহত্ত্ব নিহিত। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×