ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

ঢাকার দনিরাত

প্রকাশিত: ০৩:১৯, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ঢাকার দনিরাত

মনি : বুয়া, দ্যাখো তো, ঈদের দিন এই সাত-সকালে কে এলো? বুয়া : কেডায় আর আইবো, হয় নাইট গার্ড, নয় পেপারঅলা। অহনতরি শেমুই রান্না হয় নাই কা। কী কমু আফা। মনি : কী যে বলো না বুয়া, ঈদের দিনে খবরের কাগজ বেরোয় নাকি। থাক লাগবে না, আমিই যাচ্ছি। (মনি প্যাসেজ দিয়ে দরোজার কাছে এগুতেই দেখে দরোজা লাগিয়ে ফারজানা ফিরছে, হাতে পেপার) ফারজানা : আপা, পেপার পড়বেন? মনি : এটা পেপার পড়ার সময় হলো। ঈদের দিনে কিসের পেপার? ড্রইংরুম থেকে আকাশ চেঁচিয়ে বলে : ভাবী, পেপার দিয়েছে নাকি। দিয়ে থাকলে আমাকে দিয়ে যাও কাইন্ডলি। ফারজানা : দিচ্ছি। হ্যাঁ, আপা এবার ঈদের দিনেও কোন কোন পত্রিকা অফিস খোলা থাকবে শুনেছি। মনি : তা বেশ, টিভি চ্যানেলগুলো খোলা থাকলে পত্রিকা অফিস তো খোলা থাকতেই পারে। যাই। একটি অসমাপ্ত টিভি নাটকের কয়েকটি সংলাপ উদ্ধৃত করলাম। না, নাট্যকারের কল্পনা এবারও বাস্তব পায়নি, ঈদের দিন বেরোয়নি কোন সংবাদপত্র। আমার মতো অনেকেরই অভ্যেস আছে পেপারটা হাতে নিয়ে টয়লেটে ঢোকার। আজ ঢুকেছি ঈদসংখ্যা হাতে নিয়ে। আজ অবশ্য সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন এডিশন চালু থাকবে, অর্থাৎ নতুন নতুন আইটেম আপলোড হবে। আমি ছুটি করছি, অন্যদিকে আমাদের সহকর্মী ঠিকই কাজ করছেন। তা না হলে অনলাইন এডিশনে কিভাবে সকালেই চলে আসে জাতীয় ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায়ের সংবাদ! শুধু আজ ঈদের দিন কেন, আগামীকাল সংবাদপত্রের নির্ধারিত ছুটির দিনেও আমার মতো বহু মানুষ লাইন দেবেন অনলাইনে নতুন সংবাদ জানার প্রত্যাশায়। তিন তিনটা দিন কাগজ বেরুবে না। ফলে টিভির ছোটপর্দা আর কম্পিউটারের আলোকিত পর্দাই সংবাদপিপাসুদের ভরসা। আমাদের এক তরুণ বন্ধু ঈদের কয়দিন এই টিভি আর কম্পিউটার থেকেও দূরে থাকবেন। আরও আছে। তার নাম মোবাইল ফোন। সেখানে ইন্টারনেট আছে। ঢাকায় থাকলে এফএম রেডিও আছে। বোতাম টিপে সংবাদ শোনাও যায় সেলুলার ফোন কোম্পানির কল্যাণে। বন্ধুটি মোবাইল ফোনও অফ রাখবেন। একদিকে সংবাদের জন্য প্রতীক্ষায় থাকা, নিজেকে আপটুডেট রাখা। আরেকদিকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখে একান্ত আপনজনদের সান্নিধ্যে টেনশনহীন অবকাশ যাপন। আমার হয়েছে দুই নৌকায় পা দেওয়ার মতো অবস্থা। চাইছি সংবাদপত্রের লোক হয়েও সংবাদের চাঞ্চল্য আর উত্তেজনা-আবেগ এবং উৎকণ্ঠা থেকে শত মাইল দূরে থাকতে। একটা ধরলে অন্যটা ছাড়া সম্ভব হয়। আমি দুটোই ধরতে চাই, মনে মনে একটা ছাড়ার জন্য অস্থির হলেও। কম্পিউটারে এই কথাগুলো লিখে আবার অনলাইনে লাইন দিই। যদি কোথাও বড় কোনো ঘটনা ঘটে যায়! একবার ফেসবুকেও ঢুঁ মারতে ইচ্ছে হয়, টুইটারেও। যদি কোন সূত্র পাওয়া যায় বিগ কোন নিউজের! ফেসবুক টুইটার ইত্যাদি এখন আর বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নানান ধরনের ব্লগ, ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটতো রয়েছেই। এগুলো এখন একেকটি সংবাদ মাধ্যম হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছে। বিগত আমেরিকান নির্বাচনে ফেসবুক টুইটার ব্যাপক ব্যবহৃত হয়েছে। ঈদের দিন সকালে ঘুম ভেঙেছিল বৃষ্টির শব্দ। যেমনতেমন বৃষ্টি নয়, তুমুল বৃষ্টি। কোরবানির পশু জবাই পর্যন্ত এই বৃষ্টি বহাল থাকলে আমাদের এলাকা অনেকটা সাফসুতরো হয়ে যাবেÑ এ কথা ভেবে ভাল লাগে। ঈদের দিন এই একচিরচেনা দৃশ্য। প্রতিটি গলিতে প্রায় প্রতিটি বহুতল বাসাবাড়ির সামনে এক বা কাধিক পশু কোরবানি দেয়া হয়। তারপর কয়েকঘণ্টা ধরে সেইসব কাটাকুটি চলতে থাকে। তারপর দিনভর মাংস সংগ্রহের জন্য দুস্থ মানুষদের ভিড় ও জটলা। মাংসের দাম যে হারে বেড়ে চলেছে তাতে বিত্তহীন মানুষের আমিষের চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই কোরবানি ঈদ যে তাদের জন্য এক ধরনের আশীর্বাদ হয়ে আসেÑ সেকথা স্বীকার করতেই হবে। ঢাকাবাসীর ঈদের সুখ ও সৌন্দর্যের একটি দিক হলো ঈদ-অবকাশে কোনো একজন নির্দিষ্ট আত্মীয়ের বাড়িতে সব নিকটাত্মীয়ের দাওয়াতে অংশগ্রহণ। একই শহরে বাস করেও ব্যস্ততার কারণে পরস্পর দেখাসাক্ষাৎ হয় না এমন অভাগা স্বজনেরা ঈদের দিন কিংবা তার পরের দিন এমন সম্মিলনীতে যোগ দিয়ে আনন্দ খুঁজে পান। খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি একসঙ্গে টিভি অনুষ্ঠান দেখা, গল্পে-আড্ডায় মেতে ওঠা এবং অধুনা সেলফি তোলার ভেতর দিয়ে সময় ফুড়ুৎ করে ফুরিয়ে যায়। ঈদের দিন ক্ষুদেবার্তায় খুব কম শুভেচ্ছাবার্তা পেলাম এবার। মেসেঞ্জারে পেলাম গিফ ও ভিডিও ঈদবার্তা। প্রযুক্তি কিভাবে আমাদের ঈদশুভেচ্ছা বিনিময়েও প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। ক্ষুদেবার্তায় ঈদ শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের সংস্কৃতি বেশ থিতিয়ে আসছে। হতে পারে আমি এই সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দেইনি বলে, মানে শুভেচ্ছাবার্তার জবাব একই উপায়ে না দেয়ার ফলে হয়ত বন্ধু-পরিচিতজনদের অনেকেই আর আমাকে এসএমএস করছেন না। আবার এমনও তো হতে পারে, আমার পথ ধরেছেন তারা! যেটাই হোক, সরাসরি বাসায় গিয়ে শুভেচ্ছা জানানো, কিংবা একান্ত অপারগ হলে ফোন করে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের স্বাভাবিক আন্তরিক পদ্ধতিটি গণএসএমএস কালচারের তোড়ে অনেকটাই ভেসে গিয়েছিল। সেটি আবার স্বমহিমায় ফিরে এলে ভাল হয়। যা হোক, এবার যে কমন ক্ষুদেবার্তাটি এগিয়ে আছে, সেটি আমাদের জাতীয় কবির কবিতারই চরণ- ‘মনের পশুরে কর জবাই...’ মনের পশুকে কোরবানি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আমাদের এক সিনিয়র আপা বার্তাটি এমন একজনের কাছ থেকে পেয়েছেন, যার নিজের জন্যই ওই বার্তাটি অধিক যুক্তিযুক্ত ও প্রযোজ্য। ভগ্নিটির মতে, ওই ক্ষুদেবার্তা প্রদানকারী কস্মিনকালেও তার মনের পশুকে কোরবানি দিতে সমর্থ হবেন না। ভারি কদর্য স্বভাবের লোক তিনি। নিজের স্বভাব সম্পর্কে ধারণাও রাখেন। তাই অমন উপদেশ/আহ্বানবাণী রীতিমতো প্রহসন বা হিপোক্র্যাসি। যারা লোকটিকে চেনেন, ওই ক্ষুদেবার্তা পেয়ে তারা একচোট হেসে নেয়ার সুযোগ পান। গ্রামের নাম ঢাকা রোজার ঈদ ও কোরবানির ঈদ- দু’ঈদে ঢাকার দিনরাত প্রায় একই রকম, অবশ্য কিছুটা পার্থক্যও রয়েছে। ঈদের আগে ঢাকা ফাঁকা করে বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায়- শহর ও গ্রামের উদ্দেশে ছুটে যাওয়া সাধারণ নিয়মে পরিণত। যারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যেতে ব্যর্থ হন তাদের হৃদয়ের ভেতর চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস, যারা যান না বলে আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখেন তারা এবং তাদের সঙ্গে ঢাকার অন্য নাগরিকরা ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নেন। রাস্তাঘাটে যানবাহন ও মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে আসায় ঢাকার চিরচেনা বা বলা ভাল স্থায়ী হয়ে যাওয়া রূপ বদলে যায় সাময়িকভাবে। আবহাওয়াবিদরা একটু আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে, ঈদ এবং তার পরেও বৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু ঈদের পর এবং অফিস খোলার দিনে সোমবার কোথায় বৃষ্টি, সামান্য ছিটেফোঁটা থাকলেও হতো। রীতিমতো কটকটে রোদ, অসহ্য গরম। বহুজনের প্রত্যাশা থাকে কোরবানি ঈদের দিন সকালে না হোক, বিকেল বা রাতে বৃষ্টি হোক। বৃষ্টি হলে পশু জবাইয়ের রক্তধারা সব ধুয়ে যাবে। যতদূর মনে পড়ে, গত বছর এদিন ভালই বৃষ্টি হয়েছিল। গতবার অবশ্য আমাদের দুই নতুন নগরপিতা কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সুনির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাইয়ের জন্য প্রচারণাও চালানো হয়। ভেবেছিলাম পুরো না হোক, সিকি পরিমাণ কাজ হবে এতে। চারজনের ভেতর একজন অন্তত পশু নিয়ে কোরবানি দিতে নির্দিষ্ট এলাকায় রওয়ানা দেবেন। তা হয়নি। যদি তাই হতো তাহলে আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির সামনের রাস্তায় দশ থেকে পনেরোটি গরু কি জবাই করা হতো! পুরো রাস্তা আটকে পশু কোরবানি দেয়ার সংস্কৃতি থেকে রাজধানীবাসী বের হয়ে আসতে পারেনি। যদিও মেয়রদ্বয়ের প্রচারণা কার্যক্রমের জন্য মানুষের সচেতনতা কিছু বেড়েছে। বর্জ্য অপসারণ ও পরে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানোর কাজে অগ্রগতি এসেছে। এটাকে তাই সুলক্ষণ বলেই আমাদের বিবেচনা করতে হবে। এবার এক মেয়র বিলেতের রোগশয্যায়। আরেক মেয়র কড়া ভাষায় নগরবাসীকে সাবধান করে চলেছেন যত্রতত্র গবাদিপশুর বর্জ্য না ফেলার জন্য। কোরবানি ঈদের আগে লাখো গরু-ছাগলের আগমনের কারণে রাজধানীর অবয়ব অনেকটাই বদলে যায়। বিশেষ করে আবাসিক এলাকাগুলোয় এক অন্যতর গন্ধ পাওয়া যায়। যে গলিতে কুকুর-বিড়াল ছাড়া অন্য মানবেতর প্রাণীর প্রবেশাধিকার মেলে না, সেখানে বীরদর্পে ঢুকে পড়ে দশাসই ষাঁড়। সেই সঙ্গে নিরীহদর্শন কিছু ছাগলও। এ দুটি প্রাণীর উদরপূর্তির জন্য খড়-বিচালি ও কাঁঠাল পাতার প্রয়োজন পড়ে। গরু-ছাগলের হাঁকডাক গলির ধ্বনিতরঙ্গে আচমকা ভিন্ন আবহ নিয়ে আসে। গোবর-গোমূত্রের গন্ধ গ্রামীণ পরিবেশে মিশে থাকে, নগরীতে তা সাময়িক। ফলে সাময়িকভাবেই বদলে যায় রাজধানীর পরিবেশ। গরু বাঁধার জন্য গাছ কি মেলে সব স্থানে? বরং রয়েছে ইলেকট্রিকের পোল, ফটকের লোহা বা ইস্পাত নির্মিত বার ও গ্রিল। সেসবের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় কোরবানির পশু। স্বল্পকালীন এই অতিথিরা কোরবানির শেষে এক রকম অদৃশ্যই তো হয়ে যাবে। তবু ক’টা দিন রাজধানীর সামগ্রিক পরিবেশ ও অর্থনীতিতে একটা বড় প্রভাব পড়তে দেখি আমরা। সড়কে সড়কে দেখি মাংস কাটার ধারালো সরঞ্জাম, হোগলা পাতার পাটি এবং গাছের গুঁড়ির কর্তিত অংশ নিয়ে বসে পড়েন দোকানিরা। সব মিলিয়ে এক ভিন্নধর্মী বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে রাজধানী বছরে এই একটিবার। মমতাভরে কাঁঠালপাতা যে ছাগলটির মুখে তুলে দিতে দেখলাম এক ঘরণীকে, ঈদের দিন সেই তিনি ওই প্রাণীটির মাংস দারুণ মসলা সহযোগে রেঁধে তার টুকরো তুলে দেবেন প্রিয়জনের পাতে। ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ [email protected]
×