ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণপরিবহনে গণধর্ষণ

প্রকাশিত: ০৩:১৭, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

গণপরিবহনে গণধর্ষণ

শিক্ষক হবার স্বপ্ন পূরণ হলো না রূপা খাতুনের। শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শুক্রবার বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাচ্ছিলেন ‘ছোঁয়া পরিবহন’ নামের একটি বাসে। সেখানে এক আত্মীয়ের বাসায় রাত কাটিয়ে পরদিন শেরপুর ফিরতে চেয়েছিলেন কর্মস্থলে। রূপার দুর্ভাগ্য, তিনি আর গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি। পথিমধ্যে বাসের পাঁচ স্টাফ একে একে ধর্ষণ করে তাকে। অতঃপর মধুপুরের নিকটবর্তী কোন স্থানে তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় জঙ্গলে। পুলিশ কর্তৃক লাশ উদ্ধারের পর টাঙ্গাইল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে ‘অজ্ঞাতনামা’ হিসেবে স্থানীয় গোরস্তানে দাফন করা হয় হতভাগিনী রূপার লাশ। পরে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়ি গ্রাম থেকে তার ভাই ছবির মাধ্যমে শনাক্ত করে বোনের লাশ। এই ঘটনায় পুলিশের হাতে আটক হয়েছে বাসের চালক, সুপারভাইজারসহ পাঁচজন। তারা এই গণধর্ষণ ও পৈশাচিক হত্যাকা-ের কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। গণধর্ষিত রূপার নৃশংস নির্মম হত্যাকা- ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিল্লীতে ফিজিওথেরাপির ছাত্রী নির্ভয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। চলন্ত বাসে সেই বহুল আলোচিত ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ভারতজুড়ে তীব্র ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিল। পরে অবশ্য ধর্ষকদের মৃত্যুদ-সহ কারাদ- প্রদান করা হয় আদালত কর্তৃক। অনুরূপ একাধিক ঘটনা ঘটে বাংলাদেশেও। ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জে শুভেচ্ছা পরিবহনের বাসে, ২০১৫ সালের ১২ মে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে চলন্ত বাসে এক পোশাককর্মী, রাজধানীতে মাইক্রোবাসে এক গারো তরুণী, গত বছর ২৩ জানুয়ারি বরিশালে সেবা পরিবহনের এক বাসে দুই বোন, ওই বছর ১ এপ্রিল টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী থেকে ঢাকাগামী বিনিময় পরিবহনের বাসে এক পোশাককর্মী গণধর্ষণের শিকার হন। এসব ঘটনায় ধরপাকড়সহ মামলাও হয়েছে। তবে এতে স্বভাবতই গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। এই ধরনের ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য তৎপরতা জনমনে পরিবহন খাত সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। অন্যদিকে পরিবহন মালিকদের ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে অবস্থায় ধৃতদের দ্রুত বিচারের স্বার্থে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নিষ্পন্ন করা বাঞ্ছনীয়। থানা-পুলিশকেও নিশ্চিত করতে হবে যে, আসামিরা যেন আইনের ফাঁক গলে জামিনে বেরিয়ে যেতে না পারে। তদুপরি ঘাতক ও ধর্ষকদের সর্বোচ্চ সাজাই প্রত্যাশিত। এটিকে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। আর ঘটনা কেবল ধর্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে অথবা ধর্ষিতা পরিবার, সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করছে। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক বিচারের রায়ে ধর্ষকের পরিবর্তে শাস্তি দেয়া হয় ধর্ষিতাকে। ধর্ষিতার পরিবারটিকে করা হচ্ছে একঘরে। এ বছর সর্বাধিক আলোচিত ছিল সোহাগী জাহান তনুর ঘটনা। ২৩ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস সংলগ্ন সংরক্ষিত এলাকায় ঝোপের মধ্যে পাওয়া যায় তনুর লাশ। দুই দফা ময়নাতদন্তে শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় যে, হত্যার আগে তনুকে অন্তত তিনজন ধর্ষণ করেছিল। তবে এত মাস পরও তনু হত্যা মামলার অগ্রগতির কোন খবর নেই। যদিও তনু হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে সারাদেশের মানুষ। নারীর ক্ষমতায়নসহ অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নে বাংলাদেশের নারী সমাজ বিশ্বে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে এদিক থেকে। অবশ্য নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি প্রতিরোধে দেশে যথেষ্ট ভাল আইন রয়েছে। তবে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে, বিস্তৃত পরিসরে এর প্রয়োগ সীমিত ও সীমাবদ্ধ। দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও আছে বিস্তর। এ ধরনের সকল ক্ষেত্রে নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ আন্তরিক ও সচেষ্ট হবে বলেই প্রত্যাশা। আমরা রূপা খাতুনের ধর্ষক ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
×