ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নোম্যান্সল্যান্ডে কাঁদছে মানবতা

সাগরে রোহিঙ্গা বোঝাই তিন নৌকাডুবি ॥ ১৯ লাশ উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

 সাগরে রোহিঙ্গা বোঝাই তিন নৌকাডুবি ॥ ১৯ লাশ উদ্ধার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের শেষ রক্ষা হচ্ছে না। টেকনাফ থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যন্ত সীমান্ত এলাকাজুড়ে নেমেছে মানবঢল। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড ও পুলিশের কঠোর নজরদারি রীতিমতো লন্ড হয়ে গেছে। জোয়ারের মতো ঢুকছে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ। স্থল, নদী ও সাগর পথে রোহিঙ্গারা ধেয়ে আসছে। এ প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গা বোঝাই তিনটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ডুবে গেছে শাহপরীরদ্বীপ এলাকার অদূরের সাগরে। ১০ শিশু ও ৯ নারীর লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর আগে গত বুধবার একই এলাকা থেকে উদ্ধার হয় ৪ নারীর লাশ। এছাড়া চমেক হাসপাতালে বুধবার গভীর রাতে জখম এক রোহিঙ্গা শিশুর মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছে, যে তিনটি নৌকাযোগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছিল সেগুলোতে ৬৫ জন ছিল। অবশিষ্টদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনও জানা যায়নি। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যজুড়ে সে দেশের সেনা, পুলিশ ও বিজিপির গণহত্যা ও বিতাড়ন অভিযান অব্যাহত রয়েছে। চলছে জ্বালাও পোড়াও ও বর্বরতা। রাখাইনে রোহিঙ্গাবিরোধী যে ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হয়েছে তা রীতিমতো বিভীষিকাময়। সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে কাঁদছে মানবতা। বিজিবিসহ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ঠেকাতে পারছে না। মিয়ানমার সরকারের নির্দেশে সে দেশের যৌথ বাহিনীর তৎপরতায় প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এ যেন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এ দফার অভিযান তাদের মরণ কামড়। ফলে ইতোপূর্বে রোহিঙ্গাবিরোধী সে দেশের সরকারের সকল অভিযানকে এবারের পরিস্থিতি হার মানিয়েছে। এ ঘটনার বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ার পর ইরান সরকারও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এবং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেও হয়েছে রোহিঙ্গাবিরোধী মিয়ানমার সরকারের নিধনযজ্ঞের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও মিছিল সমাবেশ। কিন্তু কোন কিছুই যেন মিয়ানমার সরকারের কর্ণকুহরে পৌঁছুচ্ছে না। রাখাইনের তিনটি টাউনশীপ মংডু, বুচিদং, রাচিদং শহর এলাকায় এখন প্রায় রোহিঙ্গাশূন্য হিসাবেই বলা হচ্ছে। সীমান্ত এলাকার ক্রিটিক্যাল পয়েন্টগুলোসহ সবকটি স্পটে একই অবস্থা। দু’দেশের জিরো পয়েন্টে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের হাহাকার ও আহাজারিতে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে বহু আগে। বিশ্ব গণমাধ্যম এ পরিস্থিতি প্রচার হয়ে আসছে। এরপরও মিয়ানমার সরকার তাদের রোহিঙ্গা নিধন অভিযান অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে প্রাণ রক্ষায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশমুখী হয়েছে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যার প্রকৃত সংখ্যায় নির্ণয় করা কঠিন। বৃহস্পতিবার উখিয়ার ধুরংখালি এলাকা দিয়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সতেরো পরিবার অনুপ্রবেশ করে এপারের হিন্দু বসতিগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার সকাল নয়টায় উখিয়ার ঢেকিবুনিয়া এলাকায় মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যরা অনবরত গুলি চালিয়েছে। এতে ১০ রোহিঙ্গার প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা গেছে। অপরদিকে প্রাণ বাঁচাতে বুধবার গভীর রাতে ৩টি ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে ৬২ জনের রোহিঙ্গাদের একটি দল সাগর এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে নৌকাগুলো ডুবে যায়। বৃহস্পতিবার সকালে শাহপরীরদ্বীপের সাবরাং এলাকায় এদের লাশ পাওয়া যায়। এরা সবাই নারী ও পুরুষ। শাহপরীর দ্বীপের মিস্ত্রীপাড়ার দক্ষিণে এসব অসহায় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের লাশ ভেসে আসে। মিয়ানমারের রাখাইনে এবারের সেনা অভিযান এত মারাত্মক রূপ নিয়েছে যে, যা বর্ণনাতীত। সেখানকার সূত্রগুলো বলেছে, নির্বিচারে রোহিঙ্গা নিধন ও হত্যাকা- ঘটেই চলেছে। এতে কারা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী, আর কারা নিরীহ এর কোন বাছবিচার হচ্ছে না। সৃষ্ট পরিস্থিতিতেই সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া এ অভিযানে নিহতের সংখ্যা যে ঠিক কত তা নির্ণয় করাও কঠিন। কেননা, হত্যার পর এদের অনেককে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে, অনেককে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আবার অনেককে পাহাড়ের ঝোপজঙ্গলে ফেলে দেয়া হয়েছে। সেনা বাহিনীর নেতৃত্বে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহিংসতার মনোভাব এতই ভয়াবহ যে, রোহিঙ্গাদের যখন যেখানে পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই মেরে ফেলা হচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটেছে বহু। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এ পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চোরাকারবারি দল ও মানব পাচারকারী দালালরা তৎপর হয়েছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি এদেশে কোরবানি উপলক্ষে চোরাপথে ঝাঁকে ঝাঁকে নিয়ে আসা হচ্ছে মিয়ানমারের গবাদি পশু। গবাদি পশুর মধ্যে গরুর সংখ্যাই বেশি। এছাড়া ইয়াবার চালানও ঢুকছে। সীমান্তজুড়ে যেন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিজিবির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতার কথা যতই বলা হোক না কেন, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না বলে বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তে হেঁটে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের স্রোত দেখা গেছে বৃহস্পতিবার। অপরদিকে সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে জিরো পয়েন্ট লক্ষ্য করে মিয়ানমার বাহিনীর প্রায় গুলিবর্ষণ চলছে। এতে করে জিরো পয়েন্টেও অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রাণ রক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের অবর্ণনীয় দুর্দশার পরিস্থিতি এপারের লোকজন সার্বক্ষণিকভাবে প্রত্যক্ষ করছে। আর এ ফাঁকে দালাল চক্রের সদস্যরা জনপ্রতি যাকে যেভাবে পারে টাকা হাতিয়ে নিয়ে এপারে অনুপ্রবেশে সহায়তা দিচ্ছে। দালালদের উৎপাত এতই বেশি যে, যাদের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। বুধবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দালাল কাজে নিয়োজিত ১৫ জনকে আটক করেছে। কিন্তু এরপরও এপারে বসবাসরত রোহিঙ্গারা নিজেদের আত্মীয় ও অনাত্মীয়দের এপারে প্রবেশে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের স্রোত ঠেকানো যাচ্ছে না। রাখাইনের সর্বশেষ পরিস্থিতির খবর দিয়ে সেখানকার সূত্রগুলো বলেছে পুরো রাজ্যটিই যেন বর্তমানে বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে রোহিঙ্গা বসতিগুলো। বাতাসে লাশের পোড়া গন্ধ। রোহিঙ্গা পাড়াগুলোতে লোকজন নেই বললেই চলে। কারণ যে যেভাবে পেরেছে প্রাণ রক্ষার্থে পালিয়ে গেছে। বাংলাদেশমুখী হওয়া ছাড়াও বহু রোহিঙ্গা সেখানকার পাহাড় পর্বতে আশ্রয় নিয়েছে। এরা একদিকে যেমন বিনিদ্র রজনী যাপন করছে, অনাহারে অর্ধাহারে রয়েছে। বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার কর্মীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোন ধরনের ত্রাণ সামগ্রী সেখানে পৌঁছুচ্ছে না। পক্ষান্তরে, এপারে যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারা বিভিন্নভাবে আশ্রয় ও চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। তবে তাও একেবারে নিতান্ত।
×