ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুসলিম উম্মার শান্তি কামনায় হজ

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক ধ্বনিতে মুখরিত আরাফাত

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক ধ্বনিতে মুখরিত আরাফাত

আজাদ সুলায়মান ॥ লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক ধ্বনিতে পাপমুক্তি ও আল্লাহর খাস রহমতের আশায় লাখ লাখ মুসল্লির চোখের জলে সিক্ত হয়েছে আরাফাতের ময়দান। দু’হাত তুলে এক সঙ্গে ২০ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য রহমত কামনা করেছেন। এবারের হজের খুতবায় শাইখ ড. সাদ বিন নাছের আল-শিছরি বিশ্বব্যাপী ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করে বলেন, সহিংসতায় কখনো শান্তি আসে না। একমাত্র আল্লাহ ও রাসুলের পথেই নিহিত মানব কল্যাণ ও শান্তি। প্রায় সোয়া এক ঘণ্টার এই খুতবা শুরু হয় স্থানীয় সময় বেলা পৌনে বারোটায়, শেষ হয় একটায়। খুতবায় ড. সাদ সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার জুলুম নির্যাতন দূর করা, অসহায় মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসা, পিতা মাতার হক আদায় এবং আল্লাহ ও রাসুলের পথে সরল জীবন যাপন করে ইমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করার আহ্বান জানান। বৃহস্পতিবার দিনভর আরাফাতে অবস্থানের মাধ্যমেই সম্পন্ন হলো পবিত্র হজ। বুখারী মুসলিম শরীফে রয়েছে-মকবুল হজের প্রতিদান একমাত্র জান্নাত। আরাফাতের ময়দান থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নব্য হাজী তসলিম জনকণ্ঠকে বলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালভাবেই সম্পন্ন হলো বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৭৫টি দেশের মুসলমানদের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত এবাদত হজ। এর মধ্যে বাংলাদেশের ১ লাখ ২৭ হাজার মুসলিম হজ পালনের সৌভাগ্য অর্জন করেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে এত বিপুলসংখ্যক হজযাত্রীর কণ্ঠে ছিল দোয়া-মোনাজাত-জিকির। মসজিদে নামিরার খতিব খুতবা পাঠের সময় সমস্ত হাজীই ছিলেন আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন। তারা নিজ নিজ খিমায় বসে দিনভর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়েছিলেন দুনিয়াদারির ক্ষণস্থায়ী জীবনের মায়া। সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশী ভাষা গবেষক ড. সরদার জিয়াউল হক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে জনকণ্ঠকে জানান, সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আযিয এবারের আরাফার ময়দানে খুতবা দেয়ার জন্য শাইখ ড. সাদ বিন নাছের আল-শিছরিকে মনোনীত করেছেন। ইলম ও দ্বীনদারি এবং আল্লাহ্ অধিকারের ব্যাপারে আপোষহীন অকুতোভয় এক আলেম শাইখ শিছরি। দ্বীনি পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে ছোটবেলা থেকেই তিনি ইলমি পরিবেশে বড় হন। ইলমের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। রিয়াদস্থ শরিয়া কলেজে লেখাপড়ার পাশাপাশি মসজিদভিত্তিকে অনানুষ্ঠানিক ইলম হাসিলেও তিনি ছিলেন আগ্রহী। তার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন- শাইখ বিন বায, শাইখ উছাইমীন, শাইখ গুদাইয়্যান, শাইখ সালেহ আল-ফাওযান প্রমুখ। মাস্টার্সে তার গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিল ‘আত-তাফরিক বাইনাল উসূল ওয়াল ফুরর’ (মূলনীতি ও শাখাসমূহের মাঝে বিভাজন)। হিজরী ১৪১৭ সালে তিনি উসুলুল ফিকহ এর ওপর ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল: ‘আল-কাতউ ওয়ায যান ইনদাল উসুলিয়্যিন’ (আইনতত্ত্ববিদদের নিকট অকাট্য ও ধারণা)। ফিকাহ ও উসুলুল ফিকহ শাস্ত্রে অসাধারণ যোগ্য এ আলেমে দ্বীন। তার রয়েছে বিভিন্ন গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত প্রায় ১১টি গবেষণা আর্টিকেল। তার রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫০ এর অধিক। রেডিও, টেলিভিশনে নিয়মিত তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও পাঠদান সম্প্রচারিত হয়। ড. সরদার জিয়াউল হক জানান- বাদশাহ আব্দুল্লাহ্ শাসনামলে যখন কিং আব্দুল্লাহ সায়েন্স এ্যান্ড টেকনলজি ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেখানে সহশিক্ষার অনুমোদন দেয়া হয়, তখন কোন এক লাইভ অনুষ্ঠানে ড. সাদের আপোষহীন এক বক্তব্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার করে। এতে ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর শাইখ শিছরিকে উচ্চ উলামা পরিষদ থেকে পদচ্যুত করা হয়। আল্লাহ্র সঙ্গে বিশ্বস্ত ও আল্লাহ্ দ্বীনের ব্যাপারে আপোষহীন আলেমরা কখনই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। বাদশাহ সালমান ক্ষমতায় আসার পর ২০১৬ সালে পুনরায় তাকে উচ্চ উলামা পরিষদে ফিরিয়ে আনেন এবং বাদশাহ্ উপদেষ্টা ঘোষণা করেন। ২০০৯ সালের সে ঘটনাকে ইঙ্গিত করে জনৈক সৌদি নাগরিক টুইটারে লেখেন: ‘১৪৩০ সালের কোন এক সকালে শুধুমাত্র একটি দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে পত্র-পত্রিকায় তার বিরুদ্ধে ৪০টি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। অথচ আজ (বৃহস্পতিবার) তিনি সবচেয়ে বড় ইসলামী মিম্বরে (আরাফা) আরোহণ করেন। সেদিন তার ওপর যারা হামলে পড়েছিল তারা আজ দৃশ্যপটে নেই। আদি পিতা হজরত আদম (আ) ও আদিমাতা বিবি হাওয়ার (আ) মিলিত হওয়ার এবং নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহম্মদের (সা) বিদায় হজের ভাষণের সেই ঐতিহাসিক স্থান আরাফাত ময়দানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পাপমুক্তি ও আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনা নিয়ে বৃহস্পতিবার সারাদিন হজের মূল কাজ সম্পন্ন করেন। সেলাইবিহীন সাদা দুই খ- কাপড় (ইহরাম) পরিধান করে সমস্ত হাজী আরাফাতে জমায়েত হন। এ সময় তাদের মানসপটে ভেসে ওঠে দেড় হাজার বছর আগে বিদায় হজের ভাষণের সেই ঐতিহাসিক চিত্র। এদিন সমস্ত হজযাত্রী তাঁবু টানিয়ে, খোলা আকাশের নিচে মাথায় ছাতা ধরে দেশ-জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে এক কাতারে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে অন্তত একটি দিনের জন্য হলেও ইসলামের নীতি-আদর্শকে সমুন্নত রেখেছেন, যা বিপথগামী মুসলমানের জন্য পাথেয় হতে পারে। আরাফাতের এ খুতবায় তুলে ধরা হয়- বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি ও কোরান হাদিসের আলোকে করণীয় দিকনির্দেশনা। মসজিদে নামিরা থেকে খুতবার শব্দ গোটা আরাফাতে শোনা না গেলেও মুসল্লিরা রেডিও এবং টিভির মাধ্যমে শুনেছেন গুরুত্বপূর্ণ এ খুতবা। তিনি খুতবায় সারা জাহানের মুসলিম উম্মার শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন। এছাড়া আরব বিশ্বের সমস্ত মুসলমানের ঐক্য ও সংহতির গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে শায়খ ড. সাদ বলেন, দুনিয়ায় ফেতনা সৃষ্টিকারী ও শান্তি বিনষ্টকারীরা পরকালে অবশ্যই শাস্তি পাবে। আল্লাহ ও রাসুলের তরিকায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হিংসাবিদ্বেষ ভুলে গিয়ে মানুষের কল্যাণে ব্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, শান্তিুর ধর্ম ইসলাম। এ ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকতে পারে না। বর্তমান বিশ্বের সমস্ত মুসলমানের ওপর অত্যাচারীদের হেদায়েত করার জন্য আল্লাহর খাস রহমত কামনা করেন। আরব বিশ্বের বর্তমান সহিংসতার কথা উল্লেখ করে তিনি পশ্চিমা শক্তিকে হীনরাজনীতি থেকে বিরত থাকা ও সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানান। দুপুরে খুতবার পর জোহর ও আছরের নামাজ আদায় করেন হাজীরা। তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে পাঁচ কিলোমিটার দূরের মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায়ের নিয়তে রওনা হন। রাতে সেখানে অবস্থান করেন খোলা মাঠে। শয়তানকে নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহ করেন এখানেই। আজ শুক্রবার মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে হাজীদের কেউ ট্রেনে, কেউ গাড়িতে, কেউ হেঁটে মিনায় যাবেন এবং নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরবেন। মিনায় বড় শয়তানের উদ্দেশে সাতটি পাথর মারার পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল ছেঁটে (মাথা ন্যাড়া করে) গোসল করবেন। সেলাইবিহীন দুই টুকরো কাপড় বদল করবেন। এরপর স্বাভাবিক পোশাক পরে মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে কাবা শরীফ সাতবার তাওয়াফ করবেন। কাবা শরীফের সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় ‘সাঈ’ (সাতবার দৌড়াবেন) করবেন। সেখান থেকে তারা আবার মিনায় যাবেন। মিনায় আরও এক বা দুই দিন অবস্থান করে হজের অন্য আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করবেন। এরপর আবার মক্কায় ফিরে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন। আগে যারা মদিনায় যাননি, তারা বিদায়ী তাওয়াফের পর মদিনায় যাবেন। যারা আগে মদিনায় গেছেন, তারা নিজ নিজ দেশে ফিরবেন। এবারও কয়েকটি স্যাটেলাইট চ্যানেল সৌদিয়া টেলিভিশনের কল্যাণে আরাফাতের ময়দান থেকে খুতবা ও দোয়া সরাসরি সম্প্রচার করে। এতে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ কোটি কোটি মানুষ আরাফাতের হজের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। জানা যায়, এবার আরাফাতের ময়দানে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় হজের সামগ্রিক কর্মকা- তদারকি করা হয়েছে। বাংলাদেশের হাজীদের সবাইকে একটি নির্দিষ্ট চিহ্নিত স্থানের খিমায় রাখার আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে অনেকেই আখেরি মোনাজাত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিজ নিজ স্বজনদের কাছে সরাসরি সম্প্রচার করেছে। এতে বাংলাদেশে অবস্থান করেও অনেকে মোনাজাতে অংশ নেয় বলে জানা যায়। সৌদি হজ মন্ত্রণালয় ও মোয়াচ্ছাসা কার্যালয় সূত্র জানায়, মক্কা, মিনা ও আরাফাতের ময়দানে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে সব হাজীকে বিনা মূল্যে খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ সব সুবিধা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান হাজীদের নানা উপহার দিচ্ছে। হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। এর মাধ্যমে মুসলমানগণ আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভ করেন। এই দিনেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বান্দার গুনাহ সর্বোচ্চ পরিমাণে মাফ করে থাকেন। হাদিস অনুযায়ী হজের মাধ্যমে বান্দা যেন সদ্যজাত শিশুর ন্যায় বেগুনাহ মাসুম হয়ে যায়। হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর সময় থেকে শুরু এই হজের মাধ্যমে বান্দার জন্য আল্লাহর রহমত ও নেয়ামত বর্ষিত হতে থাকবে যুগ যুগ ধরে, পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত। হজের তিন ফরজের মধ্যে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হিজরী ১০ সালে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজ চলাকালীন সময়ে আরাফায় অবস্থিত জাবালে রহমত পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের উদ্দেশে হজরত মুহম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। মুহম্মদ (সা.)এর জীবতকালে এটা ছিল শেষ ভাষণ। তাই সচরাচর এটিকেই বিদায় খুতবা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে এই ভাষণেই চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেয়া ছিল।
×