ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চামড়াবাহী গাড়ি সীমান্তের দিকে চলাচল নিষিদ্ধ

চামড়া পাচার রোধে সরকার কঠোর অবস্থানে

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

চামড়া পাচার রোধে সরকার কঠোর অবস্থানে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ চামড়া পাচার রোধে সীমান্তের দিকে চামড়াবাহী সব ধরনের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঈদের পর টানা ছয়দিন চামড়া পাচার রোধে সারাদেশে বিশেষ অভিযান চালাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিষয়টি মনিটরিং করছে স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ টাস্কফোর্স। সারাদেশের সড়ক- মহাসড়কে বসবে চেকপোস্ট। আর বিশেষ চেকপোস্ট বসানো হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্তে। চেকপোস্টগুলোতে চামড়াবাহী প্রতিটি যানবাহনের নম্বর, চালকের মোবাইল নম্বর, ছবি তুলে রাখাসহ আনুষঙ্গিক অনেক বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করে রাখবে পুলিশ ও র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চামড়াবাহী প্রতিটি যানবাহনকে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর দিকে পাঠানো হবে। যারা যেতে অনাগ্রহ দেখাবে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আগামী ২০২১ সাল নাগাদ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৪০ হাজার কোটি টাকা আয় করার টার্গেট পূরণে এমন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেই লক্ষ্য পূরণেই চামড়া পাচার রোধে এমন কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ছোট-বড় ৩শ’ চামড়া প্রস্তুতকারী কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ২৬৫টি। বাকিগুলো ঢাকার বাইরে। উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর বেশিরভাগ কারখানাই সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে চলে গেছে। প্রতিবছর ঈদ-উল-আযহায় সারাদেশে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ পশু কোরবানি হয়। অধিকাংশ চামড়াই এক সময় ঢাকায় আসত। এবার চামড়া যাবে সাভারে। বেশকিছু চামড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা চামড়া প্রস্তুতকারী কারখানায় যায়। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান মোতাবেক বাংলাদেশ থেকে রফতানিকারক পণ্যের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে হিমায়িত মাছ। আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। বিগত দিনগুলোর মধ্যে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ৫০ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার ও ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে সাড়ে ৬২ কোটি মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। আর ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রায় ১০০ কোটি ডলার। আর ২০২১ সাল নাগাদ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৪০ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রা করার লক্ষ্য অর্জন করতে চামড়া পাচার রোধে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। নিয়মিত রাস্তায় চেকপোস্ট বসানো হবে। বেআইনীভাবে চামড়া বেচাকেনা ও পাচার রোধে সতর্ক রয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। দেশীয় চামড়া শিল্পকে উন্নত করতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রেলস্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনালেও চেকপোস্ট বসানো হচ্ছে। হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আতিকুল ইসলাম জানান, চামড়া পাচার রোধে সারা বছরই পুলিশের চেকপোস্ট চালানো হয়। চেকপোস্টের মূল কাজই হচ্ছে, চামড়াবাহী যানবাহনকে এবার সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে পাঠানো। এবার চামড়াবাহী যানবাহনগুলোকে সীমান্তের দিকে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যারা এমন নির্দেশ অমান্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঈদের পর টানা ছয় দিন সারাদেশে চামড়া পাচার রোধে বিশেষ অভিযান ও নিরাপত্তা এবং চেকপোস্ট ব্যবস্থা জোরদার থাকবে। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন ইতোমধ্যেই সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে চামড়া পাচার রোধে সীমান্তে বিশেষ চেকপোস্ট বসানো এবং নজরদারি বাড়ানোর কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। চেকপোস্টগুলোতে বাড়তি তল্লাশি চালানো হবে। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, চামড়া পাচার রোধে সারাদেশে বিশেষ অভিযান চালাবে র‌্যাব। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, চামড়া পাচারকারী ছাড়াও বাড়তি টাকার লোভে ভাল চামড়ার সঙ্গে নিম্নমানের চামড়া রফতানিকারক ব্যবসায়ীদের ওপরও নজরদারি চালানো হচ্ছে। ঈদের অনেক পরেও নজরদারি চলবে। কারণ অনেক পরেও কেউ কেউ চামড়া পাচার করে থাকেন। দেশের একজন খ্যাতিমান চামড়া ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের আওতায় আনতে হয়। চামড়া সংগ্রহের পর তা থেকে চর্বি ও মাংস পরিষ্কার না করলে পচন ধরে। পরিষ্কার করার পর তাতে পরিমাণ মতো লবণ দিতে হয়। পর্যাপ্ত লবণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক লবণ ব্যবসায়ী চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম লবণ সঙ্কট সৃষ্টি করেন। আর এমন অজুহাতে সিন্ডিকেটের সদস্যরা সস্তা দামে চামড়া কিনে থাকে। লবণ না দিলে চামড়া পচে যায়। আর পরিমাণ মতো লবণ না দিলে নিম্নমানের চামড়া প্রস্তুত হয়। এমন সুযোগটিকেই কাজে লাগায় চামড়া পাচারকারী ও অসাধু চামড়া ব্যবসায়ীরা। খুচরা ক্রেতারা চামড়াগুলো মাঝারি মানের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। মাঝারি মানের ক্রেতাদের কাছ থেকে ইচ্ছে করেই পাচারকারীরা চামড়া কেনা বন্ধ রাখে। এতে করে দ্রুত চামড়ায় পচন ধরার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কারণ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চামড়া পরিষ্কার করে উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় লবণ দিতে না পারলে তা পচতে বাধ্য। ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে এক পর্যায়ে সস্তায় চামড়া বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন মাঝারি মানের ব্যবসায়ীরা। এই অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আবার পাচারকারীদের যোগসূত্র থাকে। অনেক সময় পাচারকারীদের সঙ্গে সিন্ডিকটে করেও অনেক চামড়া ব্যবসায়ী এ কাজ করে থাকে।
×