ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ মনের পশুটির কথা হোক আগে। এই কারণে যে, চারপাশের বহু মানুষ মানুষের মতো দেখতে শুধু। আদতে জানোয়ার। ভেতরে তাদের হিংস্র পশু লুকিয়ে আছে। বনের পশু কোরবানি করা সহজ। মনের পশুকে বধ করবে কে? ঈদ-উল আযহার ঠিক আগে এই প্রশ্নটি অনেক বড় হয়ে সামনে এসেছে। সামনে এনেছে রূপা নামের এক তরুণী। না, আর বেঁচে নেই সে। তাকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে একদল নরপশু। এর পর ঘাড় মটকে হত্যা করা হয়। ফেলে দেয়া হয় রাস্তায়। গত ২৫ আগস্ট রাতে সিরাজগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার হয় রূপা। ছোঁয়া পরিবহনের একটি বাসে চড়েছিল সে। অন্য যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পর বাসের ড্রাইভার হেলপাররা পালাক্রমে তাকে ধর্ষণ করে। পরে ঘাড় মটকে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে চলে যায়। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের পাশ থেকে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তখনও পরিচয় অজানা। টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে সমাহিত করা হয় রূপাকে। গণমাধ্যমে লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে মধুপুর থানায় গিয়ে ছবি দেখে রূপাকে শনাক্ত করে তার পরিবার। আসামিরা ধরা পড়েছে। হয়ত বিচার হবে। কিন্তু যা তারা ঘটিয়েছে, এমন বর্বর ঘটনা, কী করে সম্ভব হলো? উত্তরটি খুব সহজ। ভেতরে ভেতরে পশু তারা। মানুষের বোধ এদের নেই। পশুর অধিক যে নরপশু তাদের রুখবে কে? সারাদেশের মানুষ এই প্রশ্ন তুলছেন। ঢাকার বাইরের ঘটনা রেখাপাত করেছে শহর ঢাকার মানুষের মনেও। তারা বলছেন, বনের পশুকে কোরবানি দেয়া আগে মনের পশুকে জবাই করতে হবে। তবেই কেবল সার্থক হতে পারে কোরবানি। আমরা কী সেভাবে ভাবছি? পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারেও চলছে হত্যাজ্ঞ। আহা, মানুষ কীভাবে যে মানুষকে হত্যা করছে। কিছু তার অনুমান করা যাচ্ছে ছবি দেখে। ভিডিও ফুটুজে কিছুটা উঠে আসছে। হাজার হাজার মানুষ ঘর হারা। আগুনে পুড়ে মরছে। গুলি করে কুপিয়ে মারা হচ্ছে তাদের। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানুষের কোন মর্যাদা দিতে নারাজ মিয়ানমার সরকার। নারী পুরুষ শিশুরা তাই বাঁচার জন্য ছুটতে ছুটতে চলে আসছে বাংলাদেশের সীমানায়। বঙ্গোপসাগর দিয়ে ঢুকে পড়ছে। এবং এখানেও মৃত্যু। জলে একাধিক নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এর পরও পৃথিবী তাকাচ্ছে না চোখ তুলে। মানুষরূপী খুনীদের বর্বরদের বলছে না কিছু। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মানবিক মানুষ সত্যি বেদনাহত। ঢাকাতেও রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশেষ আলোচনায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ হচ্ছে। শোক করা হচ্ছে। কিন্তু সামাধান নেই। সব দেখে বলতে মন চায়- বেঁচে থাকা সবার জন্য নয়। তুমি ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রক্তাক্ত হও। তোমার বাড়িতে আগুন। আগুনে পুড়ে গলে যাও তুমি। সীমান্তে কাঁটাতার। তুমি গেঁথে থাকো সেখানে। জলে ভেসে যাক তোমার শিশু সন্তান। তুমি কাঁদতে কাঁদতে মরো। মরো। না মরলে আর বাঁচবে না তুমি। জাতিসংঘ তোমাকে বাঁচাবে না। শান্তির নোবেল বাঁচাবে না তোমাকে। এবং আমরা যারা শোক করছি তারা অক্ষম। তোমার কাছে ক্ষমা চাইব। বাঁচাবো না তোমাকে। মৃত্যু তোমাকে বাঁচাবে। তুমি মরো। মৃত্যুর কাছে আশ্রয় নাও ভুল করে পৃথিবী তে আসা রোহিঙ্গা মানব। এবার গরু ছাগল মহিষগুলোর কথা। ঢাকার প্রতি প্রান্তে হাট বসেছে। হাট ভর্তি কোরবানির পশু। শেষ সময়ে এসে জমে উঠেছে কেনা বেঁচা। বৃহস্পতিবার শহরের প্রায় সব অলিতে গলিতে দেখা কোরবানির পশু নিয়ে টানা হেঁচড়া। আজ শুক্রবার শেষদিন। আজ বিক্রি বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যাবে। দামও নাকি কমেছে। আর তাহলে কোরবানি হবে বেশি বেশি। কোরবানির ঈদে ছুরি চাকুও প্রাসঙ্গিক আলোচনা। ভয়ঙ্কর সব ছুরি চাকু দেখে পিলে চমকে যায়। সাধারণ সময় এমন দেশীয় অস্ত্রের আশপাশ দিয়ে কোন ভদ্রলোক যান না। কিন্তু এখন বিষয় আলাদা। ধারালো ছুরির ধারে দিব্যি আঙুল ঘঁষে নিচ্ছেন নীরিহ দেখতে লোকটি! একরকম পরখ করেই কিনছেন ছোট ছুরি, বড় ছুরি। এমনকি চায়নিজ কুড়াল! হ্যাঁ, কোরবানির ঈদ যে! বরাবরের মতোই মুখ্য বিবেচনা হয়ে উঠেছে গরু ছাগল। সামর্থ অনুযায়ী কেনাকাটা। তার পর পশু কোরবানি। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে এসব উপকরণ খুবই জরুরী। পশু জবাই ও মাংস কাটার কাজটি সহজ করতে এসবের কোন বিকল্প নেই। কোরবানির পশু কেনার পাশাপাশি তাই চলছে ছুরি চাকু কেনার কাজ। চাহিদার কথা মাথায় রেখে প্রস্তুত দোকানিরাও। এ ধরনের উপকরণের বড়সড় সংগ্রহ রাজধানীর কাওরান বাজারে। এখানে গত প্রায় ৩২ বছর ধরে দা বটি ছুরি চাকু তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। ৩০টির মতো দোকান। বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি দোকানের সামনের অংশে ছুরি দা বটি সাজানো। কোরবানির উপকরণের কিছু শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু নিচে সাজিয়ে রাখা। হঠাৎ দেখলে ভয়ে হাত পা হিম হয়ে আসে। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সবচেয়ে বড় ছুরিটির নাম ‘জবাই ছুরি’। পশু জবাই করার জন্য বিশেষ উপযোগী করে বানানো। তাই জবাই ছুরি নাম। ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চির মতো লম্বা। সামনের অংশ হাতির সুরের মতো বাঁকানো। কিছুটা উপরের দিকে উঠে গেছে। শক্ত হাতে ধরতে হয়। তাই কাঠের হাতল। দাম ৪০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। মান অনুযায়ী এ দাম ওঠানামা করে। পশু জবাইয়ের পর গা থেকে চামড়া ছাড়াতে হয়। একটু সতর্কতার সঙ্গে করা চাই। এ জন্য ছোট এক ধরনের ছুরি পাওয়া যাচ্ছে। রোস্তম আলী নামের এক দোকানি জানান, ছুরিটির নাম ‘ছিলা ছুরি’। পরিমাণে বেশি বলেই মনে হলো। কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, চামড়া ছাড়ানোর কাজটি একসঙ্গে চারজন বা ততোধিক ব্যক্তি করতে পারেন। এ জন্য ‘ছিলা ছুরি’ কয়েকটা কিনতে হয়। দাম প্রতিটি ৪০ থেকে ১০০ টাকা। কোন কোনটির হাতল কাঠে তৈরি। সে ক্ষেত্রে দাম ২২০ টাকা। মাঝারি সাইজের ছুরিটির নাম আবার ‘সাইজ ছুরি।’ দোকানিদের ভাষায়Ñ এ ছুরি দিয়ে মাংস ‘সাইজ’ করা হয়। কুপিয়ে ‘সাইজ’ করার ব্যাপার আছে। একে তাই কোপ ছুরিও বলা হয়। কোন কোন দোকানি আবার বললেন, কামেলা ছুরি। এই ছুরির দাম ১০০ থেকে ৪০০ টাকা। গরুর হাঁড় কেটে ছোট করার কাজে ব্যবহৃত হয় চাপাতি। তাই বিভিন্ন আকারের চাপাতি তৈরি করে সাজিয়ে রেখেছেন দোকানিরা। এক দোকানি একরকম জোর করে তার দোকানে ঢুকলেন। দেখালেন তার চাপাতির বিশেষ সংগ্রহ। একটি চাপাতি হাতে তুলে নিয়ে তিনি বললেন, এটি রেললাইনের রেল কেটে তৈরি করা হয়েছে। দেড় কেজির মতো ওজন। ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা দাম। প্রচুর ধার উঠে। আছে গাড়ির স্প্রিংয়ে তৈরি চাপাতি। প্রায় একই কাজে ব্যবহৃত হয় চায়নিজ কোড়াল। চকচকে খুব। হাতলও কাঠের ফার্নিচারের মতো সুন্দর রং করা। দাম ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা। কোরবানির মাংস ঘরে আনার পর দরকার হয় দা বঁটির। কাওরান বাজারের প্রতিটি দোকানের সামনের অংশে তাই দা বঁটি খুব দেখা গেল। দায়ে ব্যবহৃত লোহার ওজন যত বেশি, দামও। ইউসুফ নামের এক দোকানি জানান, ছুরি চাকু কম বেশি সারাবছরই বিক্রি হয়। তবে কোরবানি ঈদে চাহিদা থাকে তুঙ্গে। তাই অনেক আগে থেকেই তারা প্রস্তুতি নিয়ে রেখে ছিলেন। বিক্রি ভাল। তবে শেষদিন আজ শুক্রবার সবচেয়ে বেশি বিক্রির আশা করছেন তারা।
×