ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যায় ঈদ আনন্দ ম্লান

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বন্যায় ঈদ আনন্দ ম্লান

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ পুরো মাস ধরেই বলতে গেলে বন্যার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হয়েছে রাজশাহী অঞ্চলের মানুষকে। এখনও অনেক এলাকা থেকে নামেনি বন্যার পানি। অনেকের ঘরবাড়িতে এখনও জমে আছে পানি। এ অবস্থায় এবার দুয়ারে এসেছে ঈদ-উল আযহা। রাত পোহালেই দুয়ারে হাজির হবে ঈদ-উল আযহা বা কোরবানির ঈদ। ঈদ মানে আনন্দ হলেও রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের মাঝে সে আনন্দ নেই। বিশেষ করে বন্যা কবলিত এলাকায় ঈদের আনন্দ প্রায় বিচ্ছিন্ন। সব আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে দীর্ঘ বন্যা। কোরবানির ঈদকে ঘিরে মানুষের চিরাচারিত ব্যস্ততাও এবার ভাটা পড়েছে অনেকটায়। ঘর সামলাতে যেখানে হিমশিম অবস্থা সেখানে ঈদের চিন্তাও বাদ রেখেছেন অনেকে। গ্রাম থেকে যারা শহরে বাস করেন- তাদের মধ্যে বন্যা কবলিত এলাকার অনেকেই ফিরছেন না এবার। শহরেই ঈদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ অবস্থায় এবার ঈদে আত্মীয়-স্বজনরাও বিচ্ছিন্নভাবে ঈদ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে যার মতো। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার কলেজ শিক্ষক কামরুজ্জামান। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর জন্য বাস করেন রাজশাহী শহরে। প্রতিবার ঈদ আসলেই সবাইকে নিয়ে ফিরে যান গ্রামে। অন্য ভাইয়েরাও ছুটে আসেন কর্মস্থল থেকে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন একসঙ্গে। অথচ এ কলেজ শিক্ষক এবার ঈদ করছেন রাজশাহী শহরের ভাড়া বাসাতেই। তিনি জানান, বন্যায় গ্রামের বাড়ি তলিয়ে আছে। টানা এক মাস ধরে গ্রামের বাড়িতে পানি জমে আছে। তাই এবার ঈদ করতে যাবেন না। তার অন্য ভাইয়েরাও নিজ নিজ কর্মস্থলেই থেকে যাচ্ছেন এবার। শুধু কলেজ শিক্ষক কামরুজ্জামান নয়, তার মতো হাজারো পরিবার এবার বন্যার কারণে ঈদ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গ্রামের বাইরে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ঈদে ভ্রাতৃত্বও বিচ্ছিন্ন থাকছে এবারের ঈদে। এদিকে দীর্ঘ বন্যার কারণে রাজশাহীর চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যেও আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। চাল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিষের দাম বাড়তি। সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হিমশিম খাচ্ছে। আগে যারা নিজে একটা পশু কোরবানি করেছেন তারাও যাচ্ছেন এবার শেয়ারে। অনেকে কোরবানি দিচ্ছেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের লাখ লাখ বানভাসি মানুষের ঈদ আনন্দ বানের পানিতে ধুয়ে যাওয়ার অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। রাজশাহীর বাগমারা ও মোহনপুরের বন্যা কবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বানের পানি কিছুটা কমলেও বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। এখনও ফসলের ক্ষেত ডুবে আছে। ঘরেও খাবার নেই। পর্যাপ্ত ত্রাণ নেই। মাঝে মধ্যে কেউ কিছু নিয়ে আসলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে নগণ্য। বানভাসি মানুষরা জানান, এবার আর ঈদ হচ্ছে না তাদের। রাজশাহীর পবা, গোদাগাড়ী ও বাঘা উপজেলার পদ্মার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল এখনও বন্যাকবলিত। ঠিকানা হারিয়ে অকূল পাথারে এখানকার মানুষ।অন্যরা ঘটা করে ঈদ উদযাপন করলেও দুর্গত এসব মানুষের ঘরে এবার ঈদ আসেনি। বন্যা ও নদী ভাঙনকবলিত পবার হরিয়ান ইউনিয়নের চরখানপুরের বাসিন্দারা জানান, ভাঙন থেকে বাঁচতে একে একে চারবার ঘরবাড়ি সরিয়েছেন হাসিনা আকতার, রেবেকা বেগম, পলিআরা। এবারও তাদের অন্যত্র সরে যেতে হয়েছে। এখন শেষ আশ্রয়টুকুও নেই তাদের। পরিবার নিয়ে উঠেছেন অন্যের জায়গায়। বন্যা নেমে গেলে কোথায় উঠবেন এ নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ। ফলে তারা এবার ঈদে কোন কোরবানি দিতে পারেননি। পরিবারে নেই ঈদের আনন্দ। পবার হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বাচ্চু জানান, প্রতিবছর এসব গ্রামের অনেকেই কোরবানি দেয়। তবে এবার বন্যার কারণে তারা নিজেদের বাড়ির ভিটেমাটি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় অনেকেই কোরবানি ও ঈদের কথা ভুলে গেছেন। নীলফামারী স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী থেকে জানান, ঈদের আনন্দ নেই সম্প্রতি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসি পরিবারগুলোর মাঝে। বন্যায় বাড়িঘর, ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় সঙ্কটে পড়েছেন গ্রামের মানুষরা। আগামী দিনগুলো কিভাবে চলবে সে চিন্তায় তারা দিশেহারা। বন্যা ও ক্ষতি সব মিলে মানুষের মধ্যে ঈদের আনন্দ অনেকটাই ম্লান। নীলফামারীর ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরীগঞ্জ, সদর ও সৈয়দপুর উপজেলার গ্রাম এলাকায় এখন চিত্র বিরাজ করছে। কৃষকরা রোপা আমনের দোগাছি কিনে জমিতে লাগানো আর বাড়িঘর ঠিক করতে হাতের টাকা-পয়সা শেষ করেছেন। সরকারীভাবে যে ত্রাণ দেয়া হয় তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। হাতে টাকা-পয়সা নেই। তাই এসব পরিবারের সদস্যরা এবার কোরবানি দিতে পারছেন না। যশোরের ভবদহ স্টাফ রিপোর্টার যশোর অফিস থেকে জানান, প্রতি বছর ভবদহের জলাবদ্ধতা যেন উৎসব আনন্দ কেড়ে নিচ্ছে। এবারও রাস্তায় কাটবে অনেকের ঈদ। পানিতে তলিয়ে আছে ঈদগাহ। উঁচু রাস্তায় এবারও তাদের নামাজ আদায় করতে হবে। ঈদ আনন্দের দোলা লাগেনি ভবদহ অঞ্চলের মানুষের মনে। বাড়িঘর, ফসল, মাছের ঘের হারিয়ে বিধ্বস্ত জনপদের লাখো মানুষের মাঝে এখন শুধু হাহাকার চলছে। জলাবদ্ধতা যেন মøান করে দিয়েছে জীবনের সব আনন্দ। গত বছরও ঈদের আনন্দ ছিল না ভবদহে। জলাবদ্ধ এলাকার মানুষের জন্য সরকারী সহায়তাও যথেষ্ট নয় বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। বেসরকারীভাবে কিছু ত্রাণ সহায়তা দিলেও “সেটি সব এলাকার মানুষ সমানভাবে পাচ্ছে না। যশোর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসের তথ্যমতে, যশোরের তিন উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কেশবপুরে ৬৯ হাজার ২১৮ জন, মনিরামপুরে ৫৮ হাজার ১০০ জন ও অভয়নগরে ১১ হাজার মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছেন। সব মিলিয়ে তিন উপজেলায় এক লাখ ১৮ হাজার ৩৩৪ জন জলাবদ্ধতার শিকার। এদের মধ্যে তিন হাজার ৩৯৪টি পরিবারের ১৬ হাজার ৪৯৮ জন ৪২টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। এবারের কয়েক দফা ভারি বৃষ্টিতে জেলার ২৪টি ইউনিয়নের ১২৫টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে।
×