ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

আজ শুক্রবার, সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ। রাত পোহালেই পবিত্র ঈদ। আবার ২০১৭-’১৮ অর্থবছরের তৃতীয় মাস। এই মুহূর্তে সরকার অনেক চ্যালেঞ্জিং অথচ জরুরী কাজের মুখোমুখি। সারাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট, পুল-ব্রিজ-কালভার্ট মেরামত করতে হবে। ঈদের পূর্বে রাস্তাঘাট চলাচলযোগ্য করতে হবে। কোরবানির চামড়া নিয়ে যাতে কোন রকম এদিক সেদিক না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। এর আগে দরকার চামড়া ক্রয়ে ব্যবসায়ীদের অর্থায়ন। পুনর্বাসনের কাজ জরুরী ভিত্তিতে শেষ করতে হবে। আউশ উঠছে এবং আমন লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দুই ফসলের মাঝামাঝি সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক দেড় কোটি বন্যাক্ষতিগ্রস্ত গরিব-দুঃখী মানুষকে খাবার দিয়ে বাঁচাতে হবে। এতে দরকার হবে প্রচুর খাদ্যশস্য, যেমন- চাল-গম। এর ব্যবস্থা করতে হবে। আমদানির ব্যবস্থা করা দরকার। আমদানিকৃত চাল-গম গুদামজাত করতে হবে এবং তা সারাদেশে নির্বিঘেœ পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানে আছে। চালের দাম রাখতে হবে মানুষের নাগালের মধ্যে। কৃষি পুনর্বাসনের জন্য দরকার হবে প্রচুর কৃষিঋণ, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে দেখলে বোঝা যাবে, সরকারকে এক অর্থে বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। স্বাভাবিক কাজ-কর্মও আছে। যেমন আইনশৃঙ্খলা। ঈদ উপলক্ষে সারাদেশে থাকবে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সরকারের অবশ্য স্বস্তির ব্যাপার আছে। বিরোধীদলীয় কোন ‘উৎপাত’ আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না। তা না থাক, যে কর্মকা-ের তালিকা দিলাম তা সামলিয়ে ওঠা স্বাভাবিক কোন কাজ নয়। যেমন আউশের ক্ষতি হয়েছে। এখন আমন লাগাতে হবে। এর জন্য দরকার সার, বীজ, চারা। চারা বন্যায় নষ্ট হয়েছে। নতুন চারা তৈরি করতে হবে। লাগবে বীজতলা। এ ক্ষেত্রে আমন-বোরো রোপণের কাজ বিলম্বিত হতে পারে। হতে পারে কী, হবে। নতুন বীজতলা তৈরি করা, নতুনভাবে বীজ কেনা ইত্যাদি কাজে ঋণ লাগবে। এমনিতেই কৃষকরা ঋণগ্রস্ত। বন্যায় তাদের নিঃস্ব করে গেছে। তাদের ঘর-বাড়ি গেছে, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিও গেছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মাছও নষ্ট হয়েছে। কৃষক এখন প্রকৃত অর্থেই দিশেহারা। তার পুরনো কৃষিঋণ মওকুফ করা না গেলে অন্তত সুদের অংশটি মাফ করা দরকার। ঋণ পুনঃতফসিল করা দরকার। নতুন ঋণ তো অবশ্যই দিতে হবে। পারলে কম দামে, বিনামূল্যে সার-বীজ সরবরাহ করা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের ঘরবাড়ি মেরামতের জন্যও অর্থায়ন দরকার। কোথাও কোথাও মেরামতি দিয়ে কাজ চলবে না। দিনাজপুর অঞ্চলে অনেক কৃষকের ঘর মাটি দিয়ে তৈরি। বন্যার জলে তা বিলীন হয়ে গেছে। অতএব তাদের দরকার হবে নতুন ঘর। তার মানে টাকা লাগবে। আউশ ও আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হলে দরকার হবে আরও কর্মসূচীর। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক এবং সর্বসাধারণ এখন খাদ্যাভাবে আছে। এই খাদ্যাভাব একদিন, দুদিনের নয়। বলা যায় আগামী বোরো ওঠার আগ পর্যন্ত তারা থাকবে বুভুক্ষু। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নবেম্বর, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের খাওয়াতে হবে। সবচেয়ে ভাল হতো যদি তাদের কর্মসংস্থান করা যেত। কিন্তু এর সম্ভাবনা খুব বেশি নেই। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে ‘ক্যাশ-এর অভাব থাকবে। অতএব কর্মসংস্থান করা কঠিন হবে। এমতাবস্থায় তাদের স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। সরকার ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে জানুয়ারি পর্যন্ত বুভুক্ষু দরিদ্র মানুষকে ১০ টাকা কেজি চাল দেবে। এই কর্মসূচী নতুন কিছু নয়। আমার ধারণা, সংশ্লিষ্ট সরকারী দফতরে এলাকাভিত্তিক সাহায্য পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা আছে। ওই তালিকা ধরে এবং তা পুনঃযাচাই-বাছাই করে যদি ১০ টাকা কেজির চাল গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা যায়, তাহলে এক-দেড় কোটি লোককে বাঁচানো যাবে। এক-দেড় কোটি বলছি অনুমানে। প্রকৃত হিসাবে কত লোক ক্ষতিগ্রস্ত এবং কত লোক সরকারী চাল পাওয়ার যোগ্য সেই হিসাব আমার কাছে নেই। সরকারী হিসাব নিশ্চিতভাবেই আছে। এখানে প্রশ্ন, সাহায্য প্রাপ্তির যোগ্য লোকের সংখ্যা কত তা নয়, প্রশ্ন খাদ্যশস্যের। যতদূর জানা যায়, খাদ্যশস্যের আমদানি শুরু হয়েছে। কারণ, দুই বন্যায় বেশ পরিমাণ চাল নষ্ট হয়েছে। সিলেট এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের অতিবৃষ্টিজনিত বন্যায় ৬-৭ লাখ টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। এই মুহূর্তের বন্যায় ক্ষতি হয়েছে বেশি। সব মিলিয়ে কত ঘাটতি তার হিসাব হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। তবে সরকার ২০ লাখ টনের মতো চাল ও গম আমদানি করবে বলে জানা গেছে। এতেও সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। কারণ বেশি আমদানি করলে আবার দেশীয়ভাবে উৎপাদক কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সব মিলিয়ে বোঝা যায় দরিদ্র মানুষকে বাঁচানোর জন্য সরকারীভাবে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এখন দরকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। চাল শুধু আমদানি করলেই চলবে না, তা গুদামজাত করতে হবে। আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে কিছু চাল গুদামে রেখে বাকি চাল বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাঠাতে হবে। এটা বিশাল কাজ সন্দেহ নেই আশা করি। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এই কাজ দুর্নীতিমুক্তভাবে করবে যাতে মানুষের কষ্ট না হয়। এই যে বিশাল কর্মযজ্ঞের কথা বললাম তার সঙ্গেই জড়িত টাকার প্রশ্ন। রাস্তা মেরামত, পুনর্বাসন, কৃষি উৎপাদন সহায়তা, খাদ্যশস্য আমদানি ইত্যাদি অবশ্য পালনীয় কাজের জন্য দরকার হবে প্রচুর টাকা। বলা বাহুল্য, এই খরচ হবে বাজেটাতিরিক্ত খরচ। এর বিহিত কী? এই টাকার ব্যবস্থা কী? ২০১৭-’১৮ অর্থবছরের বাজেট শুরুই হয়েছে ঘাটতি দিয়ে। ভ্যাট আইন কার্যকর না হওয়ায় ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হবে বলে অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন। ‘খবরদারি প্রতিষ্ঠান’ বিশ্বব্যাংক বলছে শেষ পর্যন্ত ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। বলাবাহুল্য এই বোঝা বিশাল বড়। কিভাবে তা মেটানো হবে তার হিসাব অর্থমন্ত্রী নিশ্চয় করছেন। তবে তা নতুন করে বসিয়ে করা হবে কিনা, করা হলে তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে তা অবশ্যই আলোচনার বিষয় হবে। এদিকে কিছু কিছু অর্থনৈতিক সূচকও ভাল খবর দিচ্ছে না। ‘কারেন্ট এ্যাকাউন্ট’-এ বিশাল ঘাটতি হয়েছে ২০১৬-’১৭ অর্থবছরে। বস্তুত বিগত ৫-৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ঘাটতি হয়েছে ‘কারেন্ট এ্যাকাউন্ট’ (আমদানি ও রফতানি ব্যয়)। রেমিটেন্স প্রবাহেও কোন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। যদি এই অবস্থা অব্যাহত থাকে তাহলে ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ পরিস্থিতিও খারাপ হবে। আর তা হলে ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল’ ‘খপ’ করে ধরবে। শর্ত দিয়ে ঋণ দেবে। এই অবস্থায় গেলে আমাদের ‘বদনাম’ হবে। এমতাবস্থায় আর্থিক পরিস্থিতির ওপর সার্বিকভাবে একটা পর্যালোচনা দরকার। মূল্যস্ফীতি হবে এই ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচ্য বিষয়। বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ডলারের দাম বাড়তে পারে। আর তা হলে আমদানিযোগ্য সকল পণ্যের দাম বাড়বে। এমনিতে ইতোমধ্যেই বাজার গরম। মাছ-মাংস, ডিম, দুধ ও শাক-সবজির বাজার গরম। বন্যার অজুহাত একটা, দ্বিতীয় অজুহাত হচ্ছে ঈদ উপলক্ষে কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। যথারীতি এগুলোর দাম বাড়ানো হয়েছে। রক্ষা, কোরবানির পশুর দাম দৃশ্যত মনে হচ্ছে এবার কম। কৃষকরা গরু-ছাগল বিক্রি করে দিচ্ছে। নানা কারণে ভারতীয় গরুর আমদানিও বেশি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের লোক এবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। এমতাবস্থায় তাদের ‘ক্যাশ’-এর অভাব আছে। বিদেশ থেকে রেমিটেন্স কেবল আসবে আগস্ট মাসে, তার হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। তবে খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী বাজার একটু মন্দা বলেই দৃশ্যমান। এখন এভাবে কনজাম্পশন কম হতে থাকলে তা আবার জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বিঘœ ঘটাতে পারে। অতএব বিশেষ নিরীক্ষা করে এগোনো দরকার। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×