ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় কণ্ঠসৈনিক

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিদায় কণ্ঠসৈনিক

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যার দীপ্তকণ্ঠ দরাজ স্বরে প্রকম্পিত হয়ে সারা বাংলাকে শিহরিত করত সেই অমর গায়ক আবদুল জব্বার আর নেই। গত ৩০ আগস্ট বুধবার তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন। যে উদাত্ত কণ্ঠ এক সময় সারা বাংলাকে কাঁপিয়ে দিত তা আজ নিথর, নিস্তব্ধ। ১৯৩৮ সালে জন্ম নেয়া শিল্পী আবদুল জব্বারের সঙ্গীত জীবন শুরু হয় ১৯৫৭ সালে ১৯ বছর বয়সে। ছোটবেলা থেকেই গানের দরাজ গলা ছিল তার। তার সময়োচিত চর্চা তাকে অনবদ্য কণ্ঠশিল্পীর আসনে বসাতে দেরি করেনি। কাজী নজরুল ইসলামের গান দিয়েই তার সঙ্গীত ভুবনে পা রাখা। ১৯৫৮ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত শিল্পী হওয়ার পর থেকেই তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক জনপ্রিয় গানে দর্শক-শ্রোতাদের শুধু মুগ্ধ করাই নয়, পাশাপাশি নিজের আসনটিও শক্তভাবে সঙ্গীত জগতে তৈরি করেছিলেন তিনি। ‘এতটুকু আশা’ চলচ্চিত্রের সেই মনোমুগ্ধকর সকরুণ আর্তি ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ গানটি আজও শ্রোতাদের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। তারও আগে মাত্র ১৪ বছরের কিশোর আবদুল জব্বার ভাষা আন্দোলনের মতো সংগ্রামী ঐতিহ্যকেও অন্তরে লালন করেছেন। সেই বোধে দেশপ্রেমকে সঙ্গীতের অনুষঙ্গ করেছেন। ’৬০-এর দশকে উত্তাল রাজনৈতিক স্রোতে ভাসমান এই অমর শিল্পী সে সময়েরও একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠযোদ্ধা ছিলেন। এর পর আসে স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো এক অগ্নিঝরা কালপর্বের উন্মাদনা। সেখানেও ছিল তার সমান অংশীদারিত্ব। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যার উচ্চকণ্ঠ আর বলিষ্ঠ সুরে কেঁপে উঠত, ঝঙ্কৃত হতো তিনি কণ্ঠসৈনিক আবদুল জব্বার। ’৬০ আর ’৭০-এর দশকে একচ্ছত্র দাপুটে এই শিল্পী এক সময় নিজের সাবলীলতায় হরেক রকমের বিঘœ আর বিপত্তিতে পড়ে যান। রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের পালাবদল সাংস্কৃতিক অঙ্গনকেও বিপন্ন করে দিতে সময় নেয় না। মুক্তিযুদ্ধের এমন বলিষ্ঠ কণ্ঠ স্বাধীনতাবিরোধী চক্রদের রোষানলে পড়বে সেটা যেমন স্বাভাবিক, একইভাবে সময়ের স্রোতকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসাও এক ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার ছিল। শিল্পী আবদুল জব্বারও সেই বিরূপ পরিস্থিতির শিকার। এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন স্বাধীনতার পক্ষের সরকার তাকে সব ধরনের স্বীকৃতি দেন। ‘একুশে পদক’, ‘স্বাধীনতা পদক’ সব ধরনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা তাকে দেয়া হয়। এমনকি এক স্মৃতিচারণে এই অমর শিল্পী উল্লেখ করেন- স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে মৌখিকভাবে ‘জাতীয় গায়কের’ও মর্যাদা দিয়েছিলেন। আর এটাই তার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া। সারাদেশকে অভিভূত করা এই কণ্ঠশিল্পীর শূন্যস্থান কখনও পূরণ হবে না। এমন কণ্ঠযোদ্ধা চলে যাওয়ার অপূরণীয় ক্ষতি বেদনাদায়ক। প্রায় অর্ধশত বছর সঙ্গীতাঙ্গনে রাজত্ব করা প্রতিভাবান শিল্পী আবদুল জব্বার বাংলার সাংস্কৃতিক ভুবনে যে যুগান্তকারী প্রভাব রেখে গেছেন সেটাই তাকে চির অম্লান করে রাখবে। তিনি চলে গেছেন; কিন্তু তার সঙ্গীত আপামর বাঙালীর সম্পদ হিসেবে ভবিষ্যত প্রজন্মকেও যুগ যুগ ধরে অনুপ্রাণিত করে যাবে। তার স্মৃতি বাংলা ও বাঙালীর জীবন থেকে কখনও মুছে যাবে না। সৃষ্টিশীল অমর শিল্পীরা সর্বমানুষের জন্য সব সময়ই বেঁচে থাকেন। তাদের সৃজনভান্ডার মানুষের সহযোগী শক্তি হিসেবে নিরন্তর প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। আবদুল জব্বারও সেই মাপের শিল্পী যার স্মৃতি যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়ে। তার স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।
×