তিল তিল শ্রমে গড়ে ওঠে প্রতিষ্ঠান। শ্রমিকের প্রসারিত হাত ধরে বেড়ে ওঠে প্রতিষ্ঠান এবং তা রক্ত ঘাম শ্রমের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা, লাভজনক করা, উৎপাদন বাড়ানো সবই শ্রমজীবীর ওপর নির্ভরশীল। শ্রমিকের শ্রম যদি না পায় মর্যাদা, দু’বেলা দু’মুঠোর না হয় ব্যবস্থা, তবে স্বাভাবিক বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা এসে সামনে দাঁড়ায়। আর রুগ্ন হতে থাকা প্রতিষ্ঠানে এক সময়ে জ্বলে ওঠে লালবাতি। আর সমূহ সর্বনাশ এসে বিপজ্জনক অবস্থানে দাঁড় করায়। প্রতিষ্ঠান বেড়ে ওঠে শ্রমিক-মালিকের সুসম্পর্কের ওপর। মালিকরা ব্যবসা করেন। সুতরাং মুনাফাই তাদের কাম্য অবশ্যই। আর উপার্জিত অর্থ নিজেরা ভোগ করবেন, কিন্তু শ্রমিক যদি থাকে উপেক্ষিত, তবে দুরবস্থার সৃষ্টি হয়। অথচ শ্রমিকরাই কারখানা বা প্রতিষ্ঠান চালু রাখে। তাদেরই শ্রমে কর্মে উৎপাদিত হয় পণ্য। উৎপাদন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক গতিতেই চলে। প্রতিষ্ঠানের যা কিছু উপার্জন তা এই শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়েই অর্জিত। কিন্তু সেই তাদের কল্যাণ ও মঙ্গল যদি উপেক্ষিত হয়, হয় অবহেলিত, বঞ্চনার পরিমাণ যদি হয় সীমাহীন, তবে উপার্জনের দিগন্তও সংকুচিত হয়ে আসে। মালিক-শ্রমিকপক্ষ দুটি হলেও প্রতিষ্ঠান কিন্তু একক। তাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা হয়ে পড়ে জরুরী। মালিকপক্ষ যদি শোষণের উপকরণ হিসেবে শ্রমিকদের ব্যবহার করেন, তবে যথাযথ কর্মক্ষমতা প্রদর্শন, প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষার ক্ষেত্রগুলো বিপর্যস্ত হতে বাধ্য, শ্রম ও কর্মের বিনিময়ে পারিশ্রমিক যদি না হয় যথাযথ এবং যথাসময়ে তবে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে প্রতিষ্ঠানের ওপর। এর মাশুল গুনতে হয় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে শ্রমিক-মালিক এবং ভোক্তা জনগণকে। কিন্তু এমন অবস্থা কারও কাম্য হতে পারে না। জাপানের মতো উন্নয়নশীল দেশের শিল্পকারখানায় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। পারস্পরিক কল্যাণ ও মঙ্গলে উভয়পক্ষই সক্রিয়। পদ-পদবির ভেদাভেদকে কখনই দেয়া হয় না প্রাধান্য। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে নিবেদিত সবাই, সেখানে শোষণ গুরুত্ব পায় না বলে শ্রমিকরা হয়ে ওঠেন কর্ম ও শ্রমনিষ্ঠ। এই উপমহাদেশে শ্রমিকদের অবস্থান অনেক ক্ষেত্রে অন্ত্যজের কাছাকাছি। শ্রমিকদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা অনেক ক্ষেত্রে মেলে না। নামমাত্র বেতন-ভাতায় শ্রমিকদের যে পরিমাণ খাটানো হয়, তাতে কারও জন্যই মঙ্গলবার্তা বয়ে আনে না। শ্রমিক ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুকে বরণ করে। করুণ জীবনধারায় শ্রমিক যদি ভোগে, তবে প্রতিষ্ঠানও ভুগতে বাধ্য। অথচ শ্রমিকদের রুটি-রুজি, আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা এই প্রতিষ্ঠানের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং প্রতিষ্ঠান বা কারখানা যদি ভালভাবে চলে, উৎপাদনশীলতা গতি পায়, কর্মের পরিবেশ থাকে নির্ভেজাল, যথাযথ পারিশ্রমিক যথাযথ সময়ে প্রাপ্তি মানেই প্রতিষ্ঠানটির স্থিতিশীলতা সংরক্ষিত হওয়া। শ্রমিককে যদি করতে হয় অত্যধিক পরিশ্রম আর বিনিময়ে মেলে যৎসামান্য, তবে তো কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে বাধ্য। আর তা পেলে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্পূর্ণ ব্যাহত হয়। এতে মালিকের সন্তুষ্টি লাভ দূরে থাক, লোকসানের ভারে জর্জরিত হওয়ার বিকল্প আর থাকে না। শ্রমিকদের কল্যাণ সাধনা কারখানা বা প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার উপাদান হিসেবেই কাজ করে। শ্রমের অনুপাতে পারিশ্রমিক পাবার নজির এদেশে নামমাত্র। বেতন-ভাতা যথাসময়ে পাওয়া যায় না। দুর্বিষহ জীবন যখন, তখন কর্মঠ হওয়ার শক্তিও হয়ে যায় স্তিমিত। উৎপাদনও পায় হ্রাস। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হলে ক্ষতিপূরণ মেলে না।
বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে নারী-পুরুষ শ্রমিক সংখ্যা সর্বাধিক। এই খাতে সরকার ভর্তুকি প্রদান করে আসছে। কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের কল্যাণে কোন হাসপাতাল স্থাপন করে না। তাদের সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষার জন্যও নেই কোন কার্যক্রম। শ্রমিক অসন্তোষ এই খাতে বেশি। বাইরের উস্কানিতে সেখানে নানারকম দুর্ঘটনা ঘটে। শ্রমিক নেতা যারা, তারাও বহিরাগত। কতিপয় এনজিও এ খাতে খবরদারি করে, যা উৎপাদনবান্ধব নয়।
শ্রমিকরা আহত ও নিহত হলেও মালিকরা ক্ষতিপূরণ দেয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহত ও আহত শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতার জন্য কেন্দ্রীয় কল্যাণ তহবিল গঠন করে সেখান থেকে সাহায্য প্রদান করছেন। এই তহবিলের আওতায় পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করার কথাও বলেছেন। শ্রমিকবান্ধব শেখ হাসিনা শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। তাই তিনি শিল্প কারখানার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নও চান। দেশ ও জনগণ প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ ও চাওয়ার সঙ্গে সহমত পোষণ করে। আমরাও চাই শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণ হোক।