ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৪ রোহিঙ্গা নারীর লাশ উদ্ধার

রাখাইন মৃত্যুপুরী ॥ জ্বালাও পোড়াও হত্যা গুম চলছেই

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৩১ আগস্ট ২০১৭

রাখাইন মৃত্যুপুরী ॥ জ্বালাও পোড়াও হত্যা গুম চলছেই

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাবিরোধী নিধনযজ্ঞে রাখাইন রাজ্যটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। সীমান্তের ওপারে বিভিন্ন সূত্র, আইওএম (ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশন) ও আন্তর্জাতিক হিউমান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকে রাখাইন রাজ্যে সেনা নেতৃত্বে যৌথ অভিযানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ৫ দিন ধরে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এ রাজ্যে গণহত্যা অব্যাহত। এর ফলে ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশু বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে জিরো পয়েন্টে প্রাণ রক্ষার্থে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে চূড়ান্ত কড়াকড়ি আরোপের কথা বলা হলেও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে চোরাপথে এদের অনুপ্রবেশ ঘটেই চলেছে। বুধবার ভোর থেকে দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে গত ৫ দিনে হাজার হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও নাইক্ষ্যংছড়ি অঞ্চলের সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এপারে ঢুকে পড়েছে। ৫ দিনে এ পর্যন্ত ৫০ সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে বেসরকারী পরিসংখ্যান রয়েছে। মিয়ানমারের এনএলডি নেত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আউন সান সুচির দফতর থেকে বুধবার বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা রাখাইনে সন্ত্রাসীদের সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছে। প্রদত্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের যখন ঘিরে রাখা হয়েছে তখন তাদের সাহায্য- সহযোগিতা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা। সূচির দফতর থেকে এ ধরনের ঘটনার তদন্ত করা হবে বলে জানানো হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন ফর্টিফাই রাইটসের নির্বাহী পরিচালক ম্যাথিউ স্মিথ বলেছেন, আউন সান সুচির দফতরের পক্ষে মানবাধিকার কর্মীদের বিরোধী এ ধরনের বিবৃতি খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীন, মারাত্মক ও প্রাণঘাতী। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মংডু থেকে জাতিসংঘ কর্মীদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গাশূন্য করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে দেশটির সেনা নেতৃত্বাধীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ইতোমধ্যে ৩০টিরও বেশি গ্রাম রোহিঙ্গাশূন্য হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি সেদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিকও নির্যাতন থেকে বাদ পড়ছে না। বুধবারও মংডুর আন্ডাং, বচ্ছরা, সাহাববাজার, নয়াপাড়া, চরপাড়া এবং উখিয়ার রহমতেরবিল সীমান্তবর্তী গ্রাম চাকমাকাটা, ঢেঁকিবনিয়াসহ বিভিন্নস্থানে অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা, লুট ও ধর্ষণ চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সহস্রাধিক ঘরবাড়ি। গত পাঁচদিনে সেনাবাহিনীর কিলিং অপারেশনে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, শিশুসহ প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। এদের হত্যা করে ঝোপজঙ্গলে যেমন ফেলে দেয়া হয়েছে তেমনি সাগরে ফেলা হয়েছে আবার অনেককে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। বুধবার টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় ৪ রোহিঙ্গা নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এদের হত্যা করার পর সাগরে ফেলে দেয়া হয়েছে। এছাড়া সাগর এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে আরও লাশ ভাসছে বলে টেকনাফের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে। নির্যাতনের শিকার রাখাইন হিন্দুরাও আরাকানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সনাতন ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ও সরকারী বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদেরও হত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছেদ করা হচ্ছে। হিন্দু জনগোষ্ঠীর সদস্যরাও প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ সীমান্তমুখী হয়েছে। অনেকে ইতোমধ্যে অনুপ্রবেশও করেছে। মংডু জেলার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ফকিরা বাজারের নিকুঞ্জের পূত্র রঞ্জিতের স্ত্রী বুধবার জানিয়েছেন শুধু রোহিঙ্গারা নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদেরও নির্যাতন করা হচ্ছে। তারা সেখানে বোমা মারছে, হামলা করছে, কিরিচ দিয়ে মানুষ কাটছে। মংডু এলাকার বিনিশায্যার পুত্র স্বপনের স্ত্রী জানিয়েছেন, তার স্বামীকে রাখাইনরা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে রোহিঙ্গা হত্যা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তার স্বামীসহ হিন্দু জনগোষ্ঠীর সদস্যরা এতে রাজি হয়নি। ফলে তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে নির্যাতন শুরু করে দিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের ৫ সদস্যকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। অন্যান্য এলাকায় কি ঘটেছে তা তার জানা নেই। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এসব হিন্দু নারীর মধ্যে একজনের স্বামী মালয়েশিয়ায় ৩ বছর যাবত সেলুনে কাজ করছেন। অপর হিন্দু মহিলার স্বামী ফকিরাবাজারে সেলুন এবং জুয়েলারির কাজ করত। তাদের স্বামীরা এখন বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তা তাদের জানা নেই। তবে সরকারীভাবে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ৬ জনকে হত্যা করেছে। সে দেশের স্টেট কাউন্সিলর দফতর থেকে প্রচারিত ভাষ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে মিয়ানমারের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে যে, রাখাইনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৬ জনকে হত্যা করেছে আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। কিন্তু বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রিত হিন্দু জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বলেছেন তার উল্টো। রোহিঙ্গারা নয়, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে রাখাইন জনগোষ্ঠীর সদস্য এবং সেনা নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী। হিন্দুদের হত্যা করে দায় রোহিঙ্গাদের কাঁধে চাপানোর অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। গত শুক্রবার রাত থেকে শুরু হওয়া মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর কিলিং অপারেশন যেমন চলছে তেমনি মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। নিহতদের মধ্যে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সদস্য অর্ধশত হবে বলে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে। একাধিক হিন্দু পাড়াও পুড়িয়ে দিয়েছে রাখাইনরা। বুধবার পর্যন্ত সাত সহ¯্রাধিক রাখাইনকে গোলযোগপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে সরকারী উদ্যোগে। এদিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং, উলুবনিয়া, লম্বাবিল, খারাইংগ্যা ঘোনা, উখিয়ার পালংখালী এলাকা দিয়ে শত শত রোহিঙ্গা নাফনদী অতিক্রম করে সীমান্তের উপকূলীয় বিভিন্ন কেওড়া বনে আত্মগোপন করেছে। এসব রোহিঙ্গা রাতের আঁধারে অনুপ্রবেশ করে টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প, নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্প, উখিয়া কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প, কুতুপালং ও বালুখালী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সুযোগ বুঝে আশ্রয় নিচ্ছে বলে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সদ্য অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা সদস্যের অনেকে জানিয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। পুুরুষদের ধরে গুলি করে হত্যা করছে। মহিলাদের নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা আতঙ্কে পাহাড়, ধান ক্ষেতে ও বনজঙ্গলে পালিয়ে-লুকিয়ে আছে। আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। কিন্তু বিজিবি বাধা দেয়ায় বহু রোহিঙ্গা ঢুকতে পারছে না। কিন্তু তারা রাতের আঁধারে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে। রাখাইন রাজ্যে এক রাতে ৩০টি পুলিশ পোস্টে হামলার পর সেই দেশের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর ওপর দমন-নিপীড়ন, হত্যাহসহ ভয়াবহ অত্যাচার বাড়িয়েছে বলে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। পাঁচ রোহিঙ্গা দালাল নিখোঁজ টেকনাফে মঙ্গলবার রাতে রোহিঙ্গা আনতে গিয়ে বিজিপি তাড়া খেয়ে ৫ রোহিঙ্গা দালাল নিখোঁজ রয়েছে। প্রাণ রক্ষার্থে নাফনদী পার হয়ে ফিরে এসেছে ১জন। রাতে টেকনাফের হ্নীলা জাদিমোরার রোহিঙ্গা নজির আহমদের পুত্র রশিদ আহমদ, লাল মিয়ার পুত্র ইব্রাহীম এবং দক্ষিণ লেদার কুব্বাসপাড়ার নুরুল ইসলামের পুত্র ফজল করিম, মৃত মোঃ হোছনের পুত্র আনোয়ার হোছন বাবুল, গফুরের পুত্র ঈমান হোছন ও মৃত আবু জাফরের পুত্র আবছার উদ্দিন ওপারে রশিদের ছেলে-মেয়েসহ অপর রোহিঙ্গাদের আনতে পৃথকভাবে নৌকা নিয়ে রইগ্যাদং ও পুছিংগ্যাপাড়া পয়েন্টে যায়। ওপারে সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বিজিপি সদস্যরা নৌকাসমূহে রোহিঙ্গা তোলার সময় তাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। তখন তারা প্রাণরক্ষার্থে পালিয়ে যায়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে লেদার মৃত আবু জাফরের পুত্র আবছার উদ্দিন নাফনদী পার হয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হন। অপর ৫জন নিখোঁজ রয়েছে। হ্নীলা ৯নং ওয়ার্ড মেম্বার মোঃ আলী বলেন, ওপারে রোহিঙ্গা আনতে গিয়ে দুর্ঘটনা এবং নিখোঁজের বিষয়টি তিনি জানতে পেরেছেন। আউন সান সুচির দফতরের বিবৃতি মিয়ানমারের এনএলডি নেত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আউন সান সুচির দফতর থেকে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, তার সরকার চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের দমন করছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা ওসব চরমপন্থীকে সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার সেনা ও পুলিশ চৌকিতে চরমপন্থীদের হামলার ঘটনার পরই তাদের দমনে অভিযান শুরু হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন ফর্টিফাই রাইটসের পক্ষ থেকে সুচির বক্তব্যের সমালোচনা করে তা দায়িত্বজ্ঞানহীন, মারাত্মক ও প্রাণঘাতী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, সুচির দফতর রোহিঙ্গা এবং মানবাধিকার কর্মীবিরোধী মনোভাব তৈরির চেষ্টা করছেন। অথচ সুচিকে তার দেশে শান্তি ও মানবাধিকার রক্ষার্থে ক্ষমতা ব্যবহার করা উচিত। প্রসঙ্গত, গতবছর ডিসেম্বরে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের ঘটনায় নোবেল বিজয়ী ১৩ ব্যক্তিসহ ২৩ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব সুচির ভূমিকার সমালোচনা করেন। এসব খ্যাতিমান ব্যক্তির পক্ষ থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছেও লেখা এক খোলা চিঠিতে বলা হয়েছিল: বার বার আবেদন জানানোর পরও আউন সান সুচি সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের পূর্ণ ও সমান অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন, যা হতাশাজনক। তারা আরও বলেছিলেন, সুচি মিয়ানমারের নেত্রী এবং এক্ষেত্রে সাহসিকতা, মানবিকতা ও সহানুভূতির সঙ্গে সামগ্রিক বিষয়টি মোকাবেলার দায়িত্ব তার কাঁধেই রয়েছে।
×