ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চ আদালতের বিবেক কি তখন বন্দী ছিল?

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৩১ আগস্ট ২০১৭

উচ্চ আদালতের বিবেক কি তখন বন্দী ছিল?

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের ইনডেমনিটি দিয়ে বিচারের পথ রুদ্ধ করার সময় দেশের আদালতের বিবেক কোথায় ছিল সে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, এখন তো দেখি কত রিট হয়, সুয়োমোটো অর্ডার হয়। কিন্তু যখন এতবড় অন্যায় হলো, ইনডেমনিটি দিয়ে খুনীদের বিচারের পথ বন্ধ করা হলো- তখন আদালতের বিবেক কোথায় ছিল? উচ্চ আদালতের বিবেক কি তখন বন্দী ছিল? আর আমাদের দেশের এতবড় নামীদামী আইনজীবী থেকে শুরু করে এত বিবেকবানরা ছিলেন, একটু উনিশ-বিশ হলেই কত কথা বলেন। তখন তারা কোথায় ছিলেন? কেন তারা তখন প্রতিবাদ করেননি? আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর কোন দেশে নেই যে হত্যার বিচার করা যাবে না। কিন্তু আমাদের দেশে সে আইন হয়েছিল। আমরা (শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা) কি এ দেশের নাগরিক নই? আমরা যারা বাবা-মাসহ সবাইকে হারিয়েছি, তাদের হত্যার বিচার চাইতে পারবো না? আজ অনেকেই একটি হত্যাকা- ঘটলেই বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন। কিন্তু তখন তো আমাদের বিচার চাওয়ার অধিকারটুকুই কেড়ে নেয়া হয়েছিল। ২১ বছর পর আমরা ক্ষমতায় এসে সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করি। খুনীদের বিচার শুরু করি। কিন্তু রায় কার্যকর করতে পারিনি। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে সেই খুনীদের বিচার করেছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে মাসব্যাপী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে বুধবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ছাত্রলীগ আয়োজিত আলোচনা সভার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গৃহীত মাসব্যাপী শোকের কর্মসূচী শেষ হবে। এ আলোচনা সভায়ও প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সভাপতি হাজী আবুল হাসনাতের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন- আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি, লে. কর্নেল (অব) মুহম্মদ ফারুক খান এমপি, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম এমপি, খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি, নগর নেতা শাহে আলম মুরাদ, সাদেক খান, কামাল চৌধুরী, এসএম মান্নান কচি, হুমায়ুন কবির, শেখ বজলুর রহমান প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন দক্ষিণের প্রচার সম্পাদক আকতার হোসেন ও উত্তরের উপ-প্রচার সম্পাদক আজিজুল হক রানা। [জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনর্বার বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে জিয়াউর রহমান সরাসরি জড়িত দাবি করে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ষড়যন্ত্রে বেইমান ও মোনাফেক মোশতাকের ডানহাত ছিলেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর মোশতাকই জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। কিন্তু বেইমানরা বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। মীরজাফরও পারেনি, বেইমান মোশতাকও তিন মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ’৭৫ পরবর্তী ২১টি বছর ক্ষমতাসীন জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করেনি, বরং খুনীদের পুরস্কৃত ও মদদ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল। কূটনৈতিক মিশনে যাদের চাকরি দেয়া হলো, তাদের যোগ্যতা কী? তারা অনেক খুন করেছে, জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে, শিশু-নারীকে হত্যা করেছে। এরাই জিয়াউর রহমানের কাছে সবচেয়ে যোগ্য ছিল। আমি জানি ওই সময় যারা বিবেকবান ছিলেন, যারা বুদ্ধিজীবী ছিলেন, যারা আইনজীবী ছিলেন, তাদের অনেকেই ওই সময় কোন প্রতিবাদ করেননি। হাতেগোনা কয়েকজন প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু এখন যারা অনেক কথা বলেন তারা তো কোন প্রতিবাদ করেননি। তিনি বলেন, আত্মস্বীকৃত খুনীদের দূতাবাসে পাঠানোর কারণে পৃথিবীর বহু দেশ তাদের গ্রহণ করেনি। আমি পোল্যান্ডের কথা জানি, তারা খুনীদের গ্রহণ করেনি, ফিরিয়ে দিয়েছিল, নিষেধ করে বলেছিল- এরা মুজিবকে হত্যা করেছে, তাদের আমরা নিতে পারি না। বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্র সে সময় যে বিবেক দেখিয়েছিল, তখন আমাদের দেশের কয়জন বিবেকবান সেই বিবেক দেখিয়েছিলেন? প্রধানমন্ত্রী এ সময় বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলন ও নির্বাচন বানচালের নামে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা, নাশকতা, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস সৃষ্টির ভয়াল চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে বলেন, নির্বাচনে যাননি এটা বিএনপি নেত্রীর নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমি তো তাকে নির্বাচনে আনতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ফোন করে বলেছিলাম- যে যে মন্ত্রণালয় চান দিয়ে দেব, তবুও আসুন সবাই মিলে নির্বাচন করি। তিনি নির্বাচনে না এসে জঙ্গী-সন্ত্রাসী স্টাইলে আন্দোলনের নামে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করলেন। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার নোংরা ও হিংস্র কর্মকা- করলেন। আসলে এরা (বিএনপি-জামায়াত) মানুষের কল্যাণ করতে পারে না, এরা দেশ ও মানুষের ধ্বংস করতে জানে। জনগণের প্রতিরোধের মুখে অবশ্য খালেদা জিয়া ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই তাদের নানা অজুহাত শোনা যাচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো আমরা ক্ষমতায় আসতে পেরেছি বলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, জেল হত্যাকা-, অস্ত্র পাচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুযায়ী নিরলসভাবে দেশ পরিচালনা করছি বলেই বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। পৃথিবীর অনেক দেশের কাছেই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিস্ময়। একটি ভাল কাজ করলেই মনে হয় আব্বা (বঙ্গবন্ধু) তা দেখে খুশি হচ্ছেন, দোয়া করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি মানুষও না খেয়ে কষ্ট পাবে না। বানভাসিদের মাঝে আমরা খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছি, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করে দেব। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই যাতে কৃষিকাজ শুরু করতে পারে তার সব ধরনের ব্যবস্থাই আমরা করে রেখেছি। কারণ আমাদের রাজনীতিই হচ্ছে জনগণের জন্য, জনগণের কল্যাণে। আমরা সবদিক থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ বুকে ধারণ করে দেশকে বিশ্বের কাছে মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। দেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে। সেভাবে আমরা দেশকে গড়ে তুলবই ইনশা আল্লাহ। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারসহ এতিমের টাকা আত্মসাতের ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের কল্যাণে নয়, এরা ক্ষমতায় আসে দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট ও বিদেশে অর্থ পাচার করতে। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি নেত্রী এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন। বিদেশে অর্থ পাচারের দায়ে বিদেশের আদালতে বিএনপি নেত্রীর দুই পুত্র দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, আমরা তাদের পাচারকৃত কিছু অর্থ ফেরতও এনেছি। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী থাকতেও তিনি জরিমানা দিয়ে দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে এবং দেশের নীতি-আদর্শ ধ্বংস করে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে ক্ষমতাসীনদের নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনীদের শুধু পুরস্কৃত নয়, কারাগারে আটক সব যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের হাত থেকে রেহাই দিয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসন, স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও উপদেষ্টা বানিয়ে ক্ষমতার অংশীদার করেছিলেন। অথচ তিনি নাকি মুক্তিযুদ্ধের খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা! মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও স্বাধীনতার ইতিহাসই এ ব্যক্তিটি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘদিন জিয়াউর রহমান তাদের দু’বোনকে দেশে ফিরতে দেয়নি। আমার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। এরপর অনেক বাধা ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দেশে ফিরলেও ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমাদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। আমরা বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে দোয়া-মোনাজাত করেছি। তিনি বলেন, তখন জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পরিবর্তে আমাকে আরেকটি বাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোন খুনীর কাছে থেকে কোনোকিছু নেয়ার মনোবৃত্তি আমার ছিল না। আমি ঘৃণাভরে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান হত্যাকা-ের পর তড়িঘড়ি করে আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি বুঝে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তখন তাদের ষড়যন্ত্র আমরা বুঝতে পারি। ওই সময় তো জিয়াকে সাধু বানাতে অনেক বিবেকবান মানুষই সোচ্চার ছিলেন। ভাঙ্গা স্যুটকেস, ছেঁড়া গেঞ্জি ছাড়া জিয়া আর কিছু রেখে যায়নি আর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অনেক সোনা-হীরা-জহরত ছিল এমন অপপ্রচার চালানো হয়েছিল প্রায় ৪০ দিন ধরে। পরে দেশের মানুষ দেখতে পারল এ পরিবারটি কতবড় দুর্নীতিবাজ ছিল। ভাঙ্গা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি জাদুর বাক্স হয়ে গেল। জিয়া পরিবার শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেল। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ ২১টি বছর ক্ষমতাসীনরা দেশের কোন সমস্যাই সমাধান করেনি। জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ারা ২১টি বছর ক্ষমতায় থাকলেও পাবর্ত্য শান্তিচুক্তি, স্থলসীমানা নির্ধারণ কিংবা সমুদ্রসীমায় নিজেদের অধিকার আদায়ে কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি বা দাবি তোলার সাহসটুকুও দেখাতে পারেনি। আসলে তারা ক্ষমতাকে বানিয়েছিল ভোগের বস্তুতে আর দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করাই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। তারা দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে শুধু ছিনিমিনি খেলেছে, দেশের কল্যাণে কোন কাজ করেনি। লুটপাট, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, অর্থ পাচার করাই ছিল তাদের রাজনীতি। জনগণ এদের রাজনীতি সম্পর্কে ভাল করেই জানে। আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, এগিয়ে নিয়ে যাবই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা হিসেবে আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলবই।
×