ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টাইগারদের ঘূর্ণিজাদুতে টেস্টে প্রথমবারের মতো হারল অস্ট্রেলিয়া ম্যাচসেরা সাকিব আল হাসান স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে উৎসাহ যুগিয়েছেন ক্রিকেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

অবিস্মরণীয় জয়

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৩১ আগস্ট ২০১৭

অবিস্মরণীয় জয়

মিথুন আশরাফ ॥ পুরো জাতির ঈদ উপহার মিলে গেল। সেই উপহার দিলেন ক্রিকেটাররা। পুরো জাতিকে আনন্দে ভাসালেন। অস্ট্রেলিয়াকে স্পিন জাদুর ফাঁদে আটকিয়ে, মিরপুর টেস্টে হারিয়ে দিয়ে, ঐতিহাসিক বিজয়ও এনে দিলেন। ২০ রানের সেই বিজয়ের রূপকার হয়ে গেলেন সাকিব আল হাসান। যিনি ব্যাট হাতে নৈপুণ্য দেখানোর পর বল হাতে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের স্পিন ফাঁদে ফেলেন। সেই ফাঁদে পড়েই তো হারল অস্ট্রেলিয়া। কথায় আছে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্টের দল নিয়ে এবং একাদশ নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু কোচ হাতুরাসিংহে, সাকিব, তামিম, মুশফিকদের মনে শুরু থেকেই বিশ্বাস ছিল, অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব। এমনকি অসিদের হোয়াইটওয়াশও করা সম্ভব। সেই বিশ্বাসই শেষ পর্যন্ত কাজে লাগল। এই বিশ্বাস পুরো জাতির মধ্যেও ছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যেও ছিল। তাই তো তিনি বুধবার স্টেডিয়ামেও হাজির হয়েছেন। জয়ও দেখেছেন। একটা সময় বিপদের রেখা দেখা গেলেও হাসি থামাননি। হেসেই গেছেন। সেই বিশ্বাসের সঙ্গে ক্রিকেটারদের মাঠের পারফর্মেন্স মিলে একাকার হয়ে গেল। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েই দিল বাংলাদেশ। ম্যাচ শেষে প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেটারদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন। ১৮৭৭ সাল থেকে, ১৪০ বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেট খেলে অসিরা যে কলঙ্কযুক্ত দিনটি দেখেনি, তা দেখে নিল। অস্ট্রেলিয়ার কলঙ্কের দিনটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক দিন হয়ে গেল। সেই ইতিহাস রচনা হলো এমন দিনে, যেই দিন থেকে আর দুইদিন পরই বাংলাদেশের উৎসবের দিন। সেটি, ঈদ উৎসব। সেই ঈদ উদ্যাপনের আগে আরেকটি উৎসব মিলে গেল। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়েও গেল বাংলাদেশ। এখন ৪ সেপ্টেম্বর থেকে চট্টগ্রামে শুরু হতে যাওয়া টেস্টটি জিততে পারলে অস্ট্রেলিয়াকে হোয়াইটওয়াশ করার স্বপ্নও পূরণ হবে। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ২৬০ রান করে। অস্ট্রেলিয়া করে ২১৭ রান। এরপর প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ২২১ রান করায় অস্ট্রেলিয়ার সামনে জিততে টার্গেট দাঁড়ায় ২৬৫ রান। এই রান করতে গিয়ে তৃতীয়দিন শেষে ২ উইকেট হারিয়ে ১০৯ রান করে ফেলেছিল অসিরা। জিততে ১৫৬ রান দরকার ছিল। হাতে ছিল ৮ উইকেট। সময়ের সেরা দুই অসি ব্যাটসম্যান ওয়ানার ৭৫ রানে ও স্মিথ ২৫ রানে ব্যাট হাতে ছিলেন। তখন সবার ভেতরই আতঙ্ক তৈরি হয়ে যায়। বাংলাদেশ না আবার টেস্টটিতে হেরে যায়? সবার ভেতরই বিশ্বাস ছিল। যেহেতু বাংলাদেশের মাটিতে খেলা। বাংলাদেশের স্পিনাররাও উইকেট পাচ্ছেন। আবার মিরপুরে হওয়া সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচটিতে এমন পরিস্থিতিতেই জেতা গেছে। ৬৪ রানেই ইংল্যান্ডের ১০ উইকেট তুলে নেয়া গিয়েছিল। তাই অস্ট্রেলিয়ারও ৮ উইকেট মুহূর্তেই শিকার করা যাবে। সেটি পারবেন স্পিনাররা। সেই স্পিনারদের পারতে হলে এটাও জানা ছিল, সাকিবকেই আসল কাজের কাজটি করতে হবে। সাকিব করেও দেখালেন। ওয়ানার ও স্মিথ মিলে চতুর্থদিনেও এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ওয়ানার সেঞ্চুরিও করে ফেলেন। কোনভাবেই এই দুইজনকে আটকানো যাচ্ছিল না। সময় যত গড়াতে থাকে, অস্ট্রেলিয়াও জয়ের কাছাকাছি চলে যেতে থাকে। যখন ওয়ানার ও স্মিথ মিলে ১৩০ রানের জুটি গড়ে তোলেন, ১৫৮ রানে চলে যায় অসিরা, জিততে ১০৭ রানের দরকার থাকে; তখনই সাকিব নিজ মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেন। ওয়ানারকে (১১২) আউট করে দেন। এর কিছুক্ষণ পর স্মিথকেও (৩৭) সাজঘরে ফেরান। তখন সবাই আবার যেন গর্জে ওঠেন। আবার আশা জেগে যায়। সেই আশা যে এবার পূরণ হবে, তাও বোঝা হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও গত বছর অক্টোবরে যে একই কাহিনী ঘটেছিল। ২৭৩ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ১০০ রান করে ফেলেছিল ইংলিশরা। বিনা উইকেটে। এরপর ৬৪ রানেই ১০ উইকেট হারিয়ে বসে ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ারও একই অবস্থা হবে, তা তখন যেন সবার মনের ভেতরেই জেগে উঠে। তাই হয়। ওয়ানার ও স্মিথকে আউট করার পর যখন মধ্যাহ্ন বিরতির পর শুরুতেই ম্যাক্সওয়েলকেও সাজঘরে ফেরান সাকিব, তখন জয় যেন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কামিন্স, লিয়নরা মিলে শেষদিকে একটু ভয় জাগান। কিন্তু তাতে কাজ হয় না। মিরাজ, তাইজুল মিলে সেই ভয়ও দূর করেন। ৮৬ রানেই ৮ উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। ২৪৪ রানে অলআউটও হয়ে যায়। সাকিব দ্বিতীয় ইনিংসেও ৫ উইকেট শিকার করে নেন। তাইজুল যখন হ্যাজলউডকে এলবিডব্লিউ করেন, তখন ক্রিকেটাররা বিজয়ের আনন্দে মাঠে দৌড়াতে থাকেন। পুরো স্টেডিয়ামে তখন ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ রব ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন দেশের পতাকা নাড়াতে থাকেন। মিরপুর টেস্ট সাড়ে তিনদিনেই শেষ হয়ে যায়। বাংলাদেশ পায় ঐতিহাসিক বিজয়। মিরপুরে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর অস্ট্রেলিয়াকেও হারায়। টানা দুই টেস্টে জয় তুলে নেয়। সেই সঙ্গে ১০১ টেস্টে এসে দশম টেস্ট জয়ও পায়। অস্ট্রেলিয়া দল বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলবে খেলবে করে ৭ বছর পর টেস্ট খেলল। ২০১১ সালেই এই সিরিজটি খেলার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় শুধু ওয়ানডে সিরিজ খেলেছে অস্ট্রেলিয়া। পরে সময় ও সুযোগ বুঝে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলবে বলে জানিয়েছিল। বাংলাদেশও অপেক্ষায় ছিল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট খেলার পর আর টেস্ট খেলেনি অস্ট্রেলিয়া। তাই অসিদের বিপক্ষে টেস্ট খেলার প্রতীক্ষা ছিল। সেই টেস্ট সিরিজটি ২০১৫ সালেও খেলার কথা ছিল। কিন্তু তখন নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে তুলে ধরে অসিরা খেলতে আসেনি। এবার যখন সিরিজের সময়সূচী নির্ধারণ হয়, এরপর থেকে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটার ও বোর্ডের মধ্যে আর্থিক বিষয় নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়। সেই ঝামেলায় সিরিজটিই আবার ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কা জাগে। শেষ পর্যন্ত সেই ঝামেলা মেটে। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশে সিরিজ খেলতেও আসে। খেলতে নেমে প্রথম টেস্ট হেরেও যায়। এখন সবারই মনে হচ্ছে, ২০১১ সালে কিংবা ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া দল সিরিজ না খেলে ভালই করেছে। কারণ, তখন খেললে হয়তো বাংলাদেশ দল হেরে যেত। এই সময়ে বাংলাদেশ দল নিজেদের আরও উন্নত করার সুযোগ পেয়েছে। এখন তো বাংলাদেশ দল যে কোন দলকেই টেস্টে হারানোর আশা নিয়েই নামে। জিতেও। গত বছর অক্টোবরে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এরপর শ্রীলঙ্কাকেও হারিয়েছে। এবার অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ঐতিহাসিক জয়ই পেল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যে এখন কতটা শক্তিশালী দল, তা ভালভাবেই বুঝে গেছে অসিরা। এর আগে দুই দলের মধ্যে ২০০৬ সালে সর্বশেষ টেস্ট খেলা হয়েছে। সে বারেও বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা বলতে পারেনি অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেবে। সেই সময় আর এই সময়ের মধ্যে কত পার্থক্য হয়ে গেছে। তা বুঝে গেছে অসিরা। এখন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা অস্ট্রেলিয়াকে শুধু হারাবে তা বলছে না, হোয়াইটওয়াশ করে দেবে বলতেও দ্বিধা করেনি। কতটা আত্মবিশ্বাস ও সাহস বুকে জন্মেছে। সেই সাহস দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা। সিরিজ শুরুর আগে হাতুরাসিংহে, সাকিবদের ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জেতার আশার কথা অসি অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথকে বলা হয়েছিল। তিনি কথাটি শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন। এখনও কী স্মিথ বিস্মিত? সেই প্রশ্ন এখন সবার মুখেই ঠাট্টার সুরে বাজছে। স্মিথ অবশ্য কথার সুর পরিবর্তন করেছেন। বলেছেন, ‘অনেক ভাল একটি টেস্ট হয়েছে। বাংলাদেশেরই ক্রেডিট।’ এখন বাংলাদেশ প্রশংসা করছেন স্মিথ। না করেও যে উপায় নেই। বাংলাদেশ দল এখন আর আগের মতো নেই, তা যে ভালভাবেই বুঝে গেছেন। শুধু কী স্মিথ। পুরো বিশ্বক্রিকেটই বাংলাদেশকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছে। টুইটারে তো বাংলাদেশেরই শুধু প্রশংসা দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ান সাবেক ক্রিকেটাররাও বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে। সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ক্লাক যেমন বাংলাদেশকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ভারতের লিজেন্ড ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকর বলেছেন, উৎসাহ দেয়ার মত পারফর্মেন্স। শ্রীলঙ্কার মাহেলা জয়ার্বধনে, ভারতের বীরেন্দর শেবাগও বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি নজর একদিকে গেছে সবার। যখন ম্যাচ শেষ করে ড্রেসিংরুমে গেছেন ক্রিকেটাররা, তখন সবাই এক সুরে গান, ‘আমরা করব জয়, আমরা করব জয়’ গানটি। সেই জয় মিলে গেছে। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ঐতিহাসিক বিজয় পেয়ে গেছে বাংলাদেশ।
×