ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা ॥ সব পথেই ঢল

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩১ আগস্ট ২০১৭

ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা ॥ সব পথেই ঢল

স্টাফ রিপোর্টার প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে রাজধানী ছাড়ছে মানুষ। বাস, ট্রেন, লঞ্চ টার্মিনালে উপচেপড়া ভিড়। পায়ে পায়ে মানুষের স্রোত টার্মিনালমুখী। ঈদের তাড়া। তাই মিরপুরে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট টেস্টেও বুধবার আশানরূপ দর্শক হয়নি। কমলাপুর রেল স্টেশনে প্রায় প্রতিটি ট্রেনে ছিল বাড়তি মানুষের চাপ। ছাদেও ঠাঁই ছিল না। এর মধ্যে কয়েকটি ট্রেন নির্ধারিত সময়ের অনেক পড়ে ছেড়েছে। ফলে রেলপথে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। সড়কপথে দীর্ঘ ভোগান্তি না হলেও ফেরিঘাটে কিছুটা জটলা রয়েছে। নৌপথেও বাড়তি মানুষের চাপ ও বিলম্বে লঞ্চ ছেড়ে যাবার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে বাসের টিকেট কাউন্টার বন্ধ করে দেয়া হবে। কমলাপুরে মানুষের ঢল, বিড়ম্বনা ॥ বুধবার সকাল থেকেই ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড় ছিল কমলাপুরে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেনগুলো ছিল পরিপূর্ণ। কাক্সিক্ষত ট্রেনের অপেক্ষায় বসেছিলেন অসংখ্য যাত্রী। কিন্তু প্রায় প্রতিটি ট্রেনই দেরিতে ছেড়ে যাওয়ায় ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের কমলাপুর ছাড়ার কথা ছিল সকাল ৬টা ২০ মিনিটে। কিন্তু ট্রেনটি দুই ঘণ্টা দেরিতে কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে গেছে। এছাড়া উত্তরবঙ্গগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস, একতা ও মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনও নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে স্টেশন ছেড়ে গেছে। ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট অনুযায়ী চতুর্থ দিনের মতো রাজধানী ছেড়ে যান মানুষ। এদিকে, স্টেশনে কর্মরতরা বলছেন, ট্রেনগুলো স্টেশনে এসে পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় সেগুলো দেরি করে ছেড়ে যাচ্ছে। সাময়িক এই দেরির জন্য যাত্রীদের কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে। তবে যাত্রাপথে যাত্রীদের যেন সমস্যা না হয় ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রাখতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। রাজশাহীগামী ট্রেনের যাত্রী বেসরকারী একটি স্কুলের শিক্ষিকা ইসরাত জাহান সুমি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদ করতে রাজশাহী যাচ্ছেন। তিনি বলেন, সড়কপথে যানজটের কথা মাথায় রেখে দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটেছি। ট্রেনে অতিরিক্ত ভিড়, অন্যদিকে প্রায় ট্রেন লেট করে ছাড়ছে। কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তী বলেন, যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় সকাল থেকেই। ঈদ এগিয়ে আসার কারণে এ ভিড় বাড়ছে। যাত্রীরা যেন নির্বিঘেœ বাড়ি ফিরতে পারেন সেজন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী দায়িত্ব পালন করছে। তিনি বলেন, যাত্রীদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি। দু’একটা ট্রেন কিছুটা বিলম্বে ছেড়েছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি সিডিউল ঠিক রেখে যাত্রীদের নির্বিঘœ যাতায়াত নিশ্চিত করতে। এবার ঈদ উপলক্ষে প্রতিদিন সারাদেশে প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার যাত্রী পরিবহন করছে রেলওয়ে। এছাড়া গত ২৯ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর এবং ঈদের পরে ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ সেপ্টেম্বর ৭ জোড়া বিশেষ ট্রেন চলাচল করবে। বাড়তি ভাড়া নিলে কাউন্টার বন্ধ- কাদের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সড়কে যান চলাচল বেড়ে গেলে এবং বৃষ্টি হলেও ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়বেন না। বুধবার সকালে গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শনে এসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি বলেন, বৃষ্টি-বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক অনেকাংশে মেরামতের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাই এবার ঈদযাত্রায় বৃষ্টি হলেও যাত্রীদের ভোগান্তি হবে না। তিনি বলেন, আজ বুধবার থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত যান চলাচলের হার বেড়ে যাবে। যান চলাচলের চাপ বাড়লে গতি হয়ত ধীর হয়ে যেতে পারে। তবে যানজট হবে না। সেতুমন্ত্রী বলেন, ঈদ সামনে রেখে বিআরটিসির ৫০টি বাস রিজার্ভ রাখা হয়েছে। যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ থাকলে বাসগুলো নামানো হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নিলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যেসব পরিবহন অতিরিক্ত ভাড়া নেবে তাদের কাউন্টার বন্ধ করে দেয়া হবে। তিন জেলা থেকে এক কোটি ২৯ লাখ মানুষের যাত্রা ঈদে ঘরমুখো মানুষের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করেছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি (এনসিপিএসআরআর)। বাসযাত্রীরা সহজে ঢাকা ছাড়তে পারলেও দূরপাল্লার মহাসড়কের বিভিন্নস্থানে ও ফেরিঘাটে মারাত্মক যানজটে পড়ছেন। এছাড়া দূরপাল্লার বিলাসবহুল বাসগুলো যথাসময়ে যাত্রা করলেও অনেক ট্রেন ও লঞ্চের সময়সূচীতে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে বলে দাবি করেছে বেসরকারী সংগঠনটি। বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে ঈদপূর্ববর্তী এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব অভিযোগ করা হয়। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ঈদ-উল-ফিতরের তুলনায় এবার ঈদ-উল-আযহায় ট্রেন ও বাসের টিকেট কালোবাজারি কম হলেও অনেক বাস ও লঞ্চ সার্ভিস অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফেরিঘাট মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া (মাওয়া) ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে ‘ভিআইপি সেবা’র নামে পদ্মার শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে যাত্রীবাহী যানবাহন পারাপারে সিরিয়াল (ধারাবাহিকতা) ভঙ্গসহ নানা অনিয়ম হচ্ছে। ফলে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ২১ জেলার বাস নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারছে না। এছাড়া দুর্ঘটনার ঝুঁকি সত্ত্বেও আইন লঙ্ঘন করে ট্রেন ও লঞ্চের ছাদে যাত্রী বোঝাই করা হচ্ছে। এসব কারণে শেষ মুহূর্তে ঘরমুখো মানুষকে দুর্ভোগ-দুর্দশা ও শঙ্কা মাথায় নিয়েই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। ঈদে এক কোটি ২৯ লাখ মানুষ ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরসহ এই তিন জেলা ছাড়ছে উল্লেখ করে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘরমুখো মানুষের ৫৫ শতাংশ সড়কপথে, ২৫ শতাংশ নৌপথে এবং ২০ শতাংশ রেলপথে যাতায়াত করে। এই সংখ্যক মানুষ ঈদপরবর্তী দ্রুততম সময়ে ফিরে আসবে। এই হিসেবে এবার বাসসহ বিভিন্ন ধরনের সড়কযানে যাচ্ছে ৭০ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ। আর লঞ্চ-স্টিমার-ট্রলারসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযান ও বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন সার্ভিসে যাচ্ছে যথাক্রমে ৩২ লাখ ২৫ হাজার ও ২৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বজনদের সান্নিধ্যপ্রত্যাশী এসব মানুষ ঈদের দিনসহ ঈদপূর্ববর্তী সাত ও ঈদপরবর্তী ১০ দিন মিলিয়ে ১৮ দিন যাতায়াত করবে। কিন্তু স্বল্পসময়ের জন্য এই বিপুল মানুষের নিরাপদ-নির্বিঘœ যাতায়াত নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমনকি ঈদপূর্ববর্তী বাস ও লঞ্চের অগ্রিম টিকেট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে গণবিড়ম্বনা ও অনেক লঞ্চ-বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করতে পারেনি প্রশাসন। পর্যবেক্ষণকালে একটি পরিবহন সার্ভিসের বিরুদ্ধে ভলভো এসি বাসে ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাড়া ১২ শ’ টাকার স্থলে ১৫ শ’ টাকা এবং অন্য একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে নন-এসি নরম্যাল বাসে ঢাকা থেকে গাইবান্ধার ভাড়া ৪৬০ টাকার স্থলে ৫২০ টাকা নেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রির ক্ষেত্রে রেলওয়ের বিরুদ্ধে কোন অনিয়ম পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। সড়কে প্রধান বিড়ম্বনা যানজট ও প্রধান শঙ্কা দুর্ঘটনা উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিভিন্নস্থানে সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর সরব পদচারণা সত্ত্বেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট এবং শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে তীব্র গাড়িজট নিরসন করা যেমন সম্ভব হয়নি তেমনি দিন-রাত মেরামত করেও ৫০ শতাংশের বেশি সড়ক নির্বিঘœ যান চলাচলের উপযোগী করা যায়নি। এ কারণে বিড়ম্বনা ও দুর্ঘটনার শংকা মাথায় নিয়েই চলতে হচ্ছে সড়কপথের যাত্রীদের। একইভাবে ট্রেন চলাচল যানজটমুক্ত হলেও ছাদে যাত্রী বহন করায় সেখানেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। মুন্সীঞ্জের-শিমুলিয়া ঘাটে বুধবার তিন শতাধিক যানবাহন পারাপারের জন্য অপেক্ষা করছে বলে দেখা গেছে। ছোট গাড়িই বেশি। রয়েছে কোরবানির গরু বহনের ট্রাকও। ঘুরমুখো মানুষের চাপ, পদ্মার তীব্র স্রোত ও বাতাসে নৌপথে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। স্বাভাবিক গতিতে ফেরি চলতে না পারায় দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত এই ঘাটে যানবাহনের সারি ক্রমে দীর্ঘতর হচ্ছে। সকাল থেকেই ঘরমুখো যাত্রীদের চাপ দেখা গেছে। ১৮টি ফেরি, ৮৭টি লঞ্চ ও তিন শতাধিক স্পিডবোটে পারাপার হচ্ছেন যাত্রীরা। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের পাঠানো। মাদারীপুর ॥ বুধবার সকাল থেকে শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি ঘাটে মানুষের ঢল ছিল। লঞ্চ, স্পিডবোট ও ফেরিতে শিমুলিয়া থেকে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে এসে নামে যাত্রীরা। এদিকে মূল সড়ক থেকে কাঁঠালবাড়ী ঘাট পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে যানজট। মানিকগঞ্জ ॥ পাটুরিয়া ঘাটে দুপুরের পর যাত্রী ও যানবাহনের চাপ ওঠানামার মধ্যে রয়েছে, কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। তীব্র স্রোত ও বাতাসে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ঘাটে যাত্রীবাহী কোচের চেয়ে প্রাইভেটকার, জিপ ও মাইক্রোবাসের চাপ বেশি। বিআইডব্লিউটিসি পাটুরিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক বলেন, বুধবার দুপুরের পর যানবাহনে চাপ বাড়লেও পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার বন্ধ রাখায় এ নৌ- রুটের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
×