ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোমাঞ্চকর জয়ে নায়ক সাকিব

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ৩১ আগস্ট ২০১৭

রোমাঞ্চকর জয়ে নায়ক সাকিব

মোঃ মামুন রশীদ ॥ চতুর্থদিন শেষে সহধর্মিণীকে বলেছিলেন, ‘কঠিন হয়ে গেল। আমরা হয়তো ম্যাচটা জিততে পারব না!’ কিন্তু তিনিই সাহস জুগিয়েছিলেন, ‘তুমিই একমাত্র জেতাতে পার। ৫ উইকেট নিয়ে নাও তাহলেই হবে!’ চতুর্থদিনে সেই কাজটাই করে দেখানোর পর বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান এ কথা জানান। প্রথম ইনিংসের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও ৫ উইকেট শিকার করে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বের অন্যতম দোর্দ- প্রতাপশালী দল অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপ। এমন নৈপুণ্যে বিজয়ের মহানায়ক হয়ে গেছেন সাকিব। প্রথম ইনিংসে সর্বোচ্চ ৮৪ রানের পর বল হাতে ৫ উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসেও ৫ উইকেট নিয়ে বিরল কীর্তি গড়েছেন। কিংবদন্তি রিচার্ড হ্যাডলির কাতারে নাম লিখিয়েছেন তিনি। এক ম্যাচে অর্ধশতক বা তার বেশি রান করার পর বল হাতে ১০ উইকেট নেয়ার কীর্তি একাধিকবার শুধু নিয়েছিলেন হ্যাডলি। তিনি ওই কীর্তি গড়েন তিনবার। আর সাকিব করলেন দ্বিতীয়বার। তবে ক্যারিয়ারের পঞ্চাশতম টেস্টে ১০ উইকেট শিকারের ঘটনায় সাকিবের অবস্থান চার নম্বরে। এরপরও ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার ভাবতে নারাজ বিশ্বসেরা এ অলরাউন্ডার। এরচেয়ে তিনি ধারাবাহিকভাবে এমন নৈপুণ্য আরও দেখিয়ে যেতে চান। ঐতিহাসিক এক জয় এসেছে। ১১ বছর পর বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম অভিজাত টেস্ট দলের বিরুদ্ধে নেমেই বিজয় তুলে নিয়েছে মাত্র তিনদিনের কিছু বেশি সময় ময়দানী লড়াই করে। ক্রিকেটের যাত্রাই শুরু হয়েছিল যাদের হাত ধরে আজ থেকে ১৪০ বছর আগে তাদের মাত্র ১৭ বছর টেস্ট অঙ্গনে যাত্রা করেই কুপোকাত করেছে টাইগাররা। আর সেটা সিরিজ শুরুর আগেই একপ্রকার ঘোষণা দিয়েছিলেন সাকিব, বলেছিলেন ২-০ ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব এবং মিরপুর টেস্টে দারুণ জয়ের পর সেই সম্ভাবনাটাকে আরও উজ্জ্বল মনে করছেন তিনি। এ বিষয়ে সাকিব বলেন, ‘ইংল্যান্ডের সঙ্গে আমাদের জেতার বিশ্বাস শুরু হয়েছে। আমরা যে ঘুরে দাঁড়াতে পারি সেই বিশ্বাস এসেছে তখন। আগে হলে হয়তো এটা করতাম না, হাল ছেড়ে দিতাম। এটা একটা বড় অর্জন আমাদের জন্য।’ কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয় পাওয়াটা কোনভাবেই সহজ ছিল না। এমনকি চতুর্থদিন শেষে অসিরা যখন টার্গেট নিয়ে খেলতে নেমে দারুণ ব্যাটিং করেছিল কিছুটা হতাশই হয়ে পড়েছিলেন। তখন তাকে ৫ উইকেট নেয়ার কথা বলে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন সহধর্মিণী উম্মে আহমেদ শিশির। এসব নিয়ে সাকিব বলেন, ‘কাজটা সহজ ছিল না। অনেক কঠিন ছিল। আমি বলব তামিম অসাধারণ ব্যাটিং করেছে। এই উইকেটে রান করাটা অনেক কঠিন, তাই ব্যাটসম্যানদের কৃতিত্ব দিতেই হবে। ও (শিশির) যখন বললো যে ৫ উইকেট নিলেই তো হয়ে যায়। তখনই আমার মনে হয়েছিলÑ তাইতো! তবে অস্ট্রেলিয়ানরা খুব ভাল খেলেছে, আমরাও ওদের থেকে শিখেছি। এটা খুবই ভাল একটা টেস্ট। এরকম ম্যাচ মানুষকে আরও টেস্ট দেখতে উৎসাহ দেয়। ক্রিকেটের জন্য খুবই ভাল। আশাকরি চট্টগ্রামেও ভাল একটা ম্যাচ আছে।’ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই শুধু ৫ উইকেট শিকার করা বাকি ছিল। কারণ এর আগে তাদের বিরুদ্ধে টেস্ট খেলারই সুযোগ হয়নি সাকিবের। সেজন্য মুখিয়েই ছিলেন হয়তো। তার কুফল ভোগ করল অসিরা। দুই ইনিংসেই ৫ উইকেট শিকার করেছেন সাকিব। প্রথম ইনিংসে ৬৮ রানে এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৫ রানে ৫ উইকেট করে তুলে নিয়ে অসি ব্যাটসম্যানদের জন্য সাক্ষাত যমদূত হয়ে গেছেন সাকিব। সেই মর্যাদা আর সম্মান সিরিজ শুরুর আগেই অসি ক্রিকেটারদের কাছে পেয়েছিলেন, সবাই সমীহ করে সাকিবের নামই উচ্চারণ করেছিলেন। তিনিই ডোবালেন অসিদের আর গর্বিত করলেন বাংলাদেশকে। সেইসঙ্গে নিজেকেও আসীন করলেন কিংবদন্তিদের আসনে। এর আগে ৫০তম টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ১০ উইকেট শিকারের ঘটনা ছিল মাত্র চারটি। ইংল্যান্ডের ট্রেভর বেইলি প্রথম ঘটনাটির মালিক হয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে লর্ডসে ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্ট খেলতে নেমে। এছাড়া ১৯৮৪ সালে নিউজিল্যান্ডের স্যার হ্যাডলি, ২০০০ সালে পেশোয়ারে মুত্তিয়া মুরলিধরন এবং ২০০৫ সালে আহমেদাবাদে হরভজন সিং তাদের ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্টে এই কীর্তি দেখান। ১২ বছর পর তেমন আরেকটি ঘটনার জন্ম দিলেন সাকিব। অথচ এই কীর্তি দেখাতে পারেননি অসি কিংবদন্তি শেন ওয়ার্ন, ভারতের অনীল কুম্বলে, পাকিস্তানের আব্দুল কাদির, সাকলাইন মুস্তাকরা। ক্যারিয়ারজুড়ে হ্যাডলি ছাড়া আর কোন কিংবদন্তি ক্রিকেটারই ম্যাচে অর্ধশতক হাঁকানোর পাশাপাশি ১০ উইকেট দ্বিতীয়বার শিকার করতে পারেননি। স্যার হ্যাডলি ক্যারিয়ারে তিনবার এই কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। তারপর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ক্যারিয়ারে একবারের বেশি এই বিরল কৃতিত্ব দেখালেন সাকিব। সেদিক থেকে ইমরান খান, কপিল দেব, জ্যাক ক্যালিস, গ্যারি সোবার্স, ওয়াসিম আকরামদের মতো কিংবদন্তি অলরাউন্ডারদেরও পেছনে ফেলেছেন এ বাংলাদেশের বিস্ময়। ২০১৪ সালের নবেম্বরে খুলনায় প্রথমবার ম্যাচে ১০ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি প্রথম ইনিংসে ১৩৭ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। এবার করলেন প্রথম ইনিংসে ৮৪ রান এবং ম্যাচে ১০ উইকেট। ভারতের কপিল দেব ১৯৮০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮৪ রান ও ১১ উইকেট নিয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে পাকিস্তানের ইমরান খান ১১৮ রান ও ১১ উইকেট পেয়েছিলেন। স্যার ইয়ান বোথাম ১৯৮০ সালে ভারতের বিপক্ষে ১১৪ রান ও ১৩ উইকেট পেয়েছিলে। আশির দশকের সেরা এ অলরাউন্ডাররা কেউই তাদের এ পারফর্মেন্সের পুনরাবৃত্তি করতে পারেননি। বিংশ শতাব্দীতেও এ রেকর্ড পুনরাবৃত্তি করতে পারেননি কেউ। হ্যাডলিই ছিলেন অনন্য এবং একজন বিরল কীর্তির অধিকারী। এবার তার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন সাকিব। সে কারণে বাংলাদেশের পক্ষে টেস্ট বিজয়ের ম্যাচে সর্বাধিক ৩ বার ম্যাচসেরা হওয়ার পুরস্কার লাভের রেকর্ডও গড়েছেন তিনি। এতকিছুর পরও নিজেকে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারদের কাতারে ভাবতে নারাজ সাকিব বলেন, ‘না, ওরকম কিছু মনে হচ্ছে না। আমি যেটা বললাম, আমার কাজ যেহেতু দুইটা দিক দিয়েই আছে, চেষ্টাটা থাকবে দুইটা দিকেই সমানভাবে অবদান রাখার। সবচেয়ে বড় যে অনুভূতিটা এসেছে দলের জেতার জন্য অবদান রাখতে পারাটা, যেটা আমি সবসময়ই করতে চাই। ৫০তম টেস্ট হিসেবে অবশ্যই আলাদা একটা অনুভূতি, দলের জন্য কিছু করতে পারা। আমি খুবই খুশি, যেভাবে অবদান রেখেছি, এই টেস্ট শেষে ওরা আরও বেশি সম্মান দেবে।’ বোলার/দেশ প্রতিপক্ষ বোলিং পারফর্মেন্স ভেন্যু/সময় ট্রেভর বেইলি (ইংল্যান্ড) ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১১/৯৮ লর্ডস, ১৯৫৭ রিচার্ড হ্যাডলি (নিউজিল্যান্ড) শ্রীলঙ্কা ১০/১০২ কলম্বো, ১৯৮৪ মুত্তিয়া মুরলিধরন (শ্রীলঙ্কা) পাকিস্তান ১০/১৪৮ পেশোয়ার, ২০০০ হরভজন সিং (ভারত) শ্রীলঙ্কা ১০/১৪১ আহমেদাবাদ, ২০০৫ সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ) অস্ট্রেলিয়া ১০/১৫৩ মিরপুর, ২০১৭
×