ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশপ্রেমিক শিল্পী ছিলেন আবদুল জব্বার

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ৩১ আগস্ট ২০১৭

দেশপ্রেমিক শিল্পী ছিলেন আবদুল জব্বার

সাজু আহমেদ ॥ পাঁচ দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের গানের ভূবনে আলো ছড়ানো বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী মুক্তিযোদ্ধা, আবদুল জব্বার চলে গেলেন না ফেরার দেশে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, আবদুল জব্বারের মৃত্যুতে দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে গভীর শোক নেমে এসেছে। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ কিংবা ‘বাংলার স্বাধীনতা আনলো কে’সহ অসংখ্য গানের মাধ্যমে তৎকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামে যুদ্ধরত মুক্তিসেনার বুকের রক্ত আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠত। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘তারা ভরা রাতে’-এর মতো অসংখ্য গানের শিল্পী আবদুল জব্বারের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নিভে গেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মৃত্যুর সংবাদে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর মৃত্যুতে শিল্পীরা বলছেন আবদুল জব্বার দেশপ্রেমিক একজন শিল্পী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর গান বাংলাদেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শিল্পীদের শোক: আবদুল জব্বারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এছাড়াও তাঁর সহশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালকরা আবদুল জব্বারের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, জব্বার ভাইও চলে গেলেন। তার গায়কী, তার কণ্ঠ ছিল অনবদ্য। তার মতো গায়ক এই দেশে আর কখনোই আসবে না। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অপরিসীম। তিনি এই দেশের জন্য, বাংলা গানের জন্য যা করে গেছেন তা খুব কম শিল্পীই করে থাকেন বা করেছেন। খুব দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এই যে, খুব কাছাকাছি সময়ে আমরা দুই অঙ্গনের দু’জন বড় মহান শিল্পীকে হারালাম। এটা সত্যিই আমাদের জন্য অনেক কষ্টের, বেদনার। জব্বার ভাইকে চিনি আমার বয়স যখন আট কিংবা নয়, সেই সময় থেকে। তিনি আমার বড় বোনদের সঙ্গে গাইতেন। আমাকে খুব আদর করতেন, ভালবাসতেন। তারসঙ্গে খুব বেশি গান গাওয়ার সুযোগ হয়নি আমার। যতদূর মনে পড়ে তার সঙ্গে আমার প্রথম গাওয়া গান ছিল ‘ওগো লাজুক লতা’। পরবর্তীতে চলচ্চিত্রের একটি গান ‘জীবনও আঁধারে পেয়েছি তোমারে চিরদিন পাশে থেকো বন্ধু’ গানটি বেশ শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল। এরপরেও ‘যদি বলি যেতে নাহি দিবো’, ‘সুরের আগুনে পুড়ে’, ‘কেন যে সাথে চলিতে’-এসব গান তার সঙ্গে আমার গাইবার সুযোগ হয়েছিল। জবব্বার ভাইকে যেন আল্লাহ বেহেস্ত নসিব করেন এই দোয়া করি। সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান বলেন, আব্দুল জব্বার ছিলেন আমাদের জাতীয় সম্পদ। তিনি চলে গেছেন ঠিকই। কিন্তু তার রেখে যাওয়া গান আমরা কাজে লাগাতে পারি। তিনি এমনই একজন শিল্পী ছিলেন যাকে কি না নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা উদাহরণ হিসেবে অনুসরণ করে নিজেদের জন্য কাজে লাগাতে পারে। আব্দুল জব্বারের মতো ভরাট আর গম্ভীর কণ্ঠের শিল্পী আর পাওয়া যাবে না। এমন একজন শিল্পীকে আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। এ আমাদের কষ্টের বিষয়। আল্লাহ আব্দুল জব্বারকে বেহেস্ত নসিব করুন, এই দোয়া করি। সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আলম খান বলেন, আমার নিজের শরীরটা ভাল না। তারমধ্যে আব্দুল জব্বারের চলে যাওয়ার খবরটা শুনে ভীষণ মন খারাপ হয়েছে। এই অসুস্থ শরীর নিয়েও শেষবারের মতো তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। আব্দুল জব্বার নিঃসন্দেহে এদেশের প্রথম সারির কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। ছিলেন তিনি কণ্ঠযোদ্ধাও। তার কণ্ঠের গান শুনে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে ভরাট কণ্ঠের শিল্পী হিসেবে যদি কারও নাম প্রথমে নিতে হয় সেটা আব্দুল জব্বার। কিছু কিছু গান আছে যে গানগুলো আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে স্থান না পেলে কালজীয় হয়ে উঠত না। যেমন তেমনই একটি গান আমার সুর করার ‘ওরে নীল দরিয়া’। এই গানটি যদি অন্য কেউ গাইতো তবে এতেটা জনপ্রিয়তা বা শ্রোতাপ্রিয়তা পেত না। তাই আব্দুল জব্বার একজনই। তার ভরাট কণ্ঠর মাধুর্য মাখা কথা আর শুনতে পাব না-ভাবলেই কষ্ট হচ্ছে। শাম্মী আখতার বলেন, জব্বার ভাই নেই, একথা ভাবলেই যেন চোখে পানি চলে আসছে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল যে জব্বার ভাইয়ের সঙ্গে একটি গান গাইবার সুযোগ পেয়েছিলাম। এরপর আর গান করতে পারিনি তারসঙ্গে। বাংলাদেশ টেলিভিশনেই তারসঙ্গে আমার দেখা হতো। খুব মায়া করতেন আমাকে। দেখা হলেই জায়গায় দাঁড়িয়ে নানান ধরনের গল্প করতেন। এমন মহানশিল্পীর প্রয়ানে শুধু আমি নই, সবাই খুব কষ্ট পাচ্ছেন। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসিব করেন। কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, আমাকে আদর করে বিশু বলে ডাকার আর কেউ রইল না। সত্যি বলতে কী জব্বার ভাইকে নিয়ে বললে অনেক কিছুই বলা যায়। জব্বার ভাই যে আমার কতটুকু প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের গান, বাংলা আধুনিক গান তিনি নিজের হাতে ধরে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি বাংলা গানের সত্যিকারের দিকপাল। বিবিসির জরিপে শ্রেষ্ঠ বিশটি গানের তিনটিই তার কণ্ঠের। তার কণ্ঠের ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ কিংবা ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান শুনলে এখনও শিওরে উঠি। জীবদ্দশায় তিনি স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্র তাকে সর্বোচ্চ সম্মাননা দিয়েছে। দেশের মানুষও তাকে সর্বোচ্চ ভালোবাসার স্থানে রেখেছিল। তিনি যুগের পর যুগ আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার কালজীয় গানের মধ্যদিয়ে। জব্বার ভাইয়ের প্রাণশক্তি ছিল এমন যে জীবনের শেষ সময়ে এসেও তিনি আরও ভাল ভাল গান গাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। তিনি আদ্যোপান্ত একজন দেশপ্রেমিক শিল্পী ছিলেন। দেশের জন্য সবসময়ই তার মন কাঁদতো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুব প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তার চলেও যাওয়ায় সঙ্গীতাঙ্গনে বিশাল এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই শূন্যতা থেকে উত্তরণের কোনই উপায় নেই। জব্বার ভাইয়ের আত্মার শান্তি কামনা করছি। এ্যান্ড্রু কিশোর বলেন, জব্বার ভাই চলে গেলেন, আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। আমাদের একা করেই চলে গেলেন তিনি। জব্বার ভাইই হার্ট একজন শিল্পী ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে তার গান কত বড় ভূমিকা রেখেছিল তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি সত্যিকার অর্থের একজন মহানশিল্পী ছিলেন। তিনি চলে গেছেন। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের অন্তরে। তার গান তাকে বাংলার আকাশে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখবে নিশ্চয়ই। ফাহমিদা নবী বলেন, আব্বা ও জব্বার চাচার সঙ্গীতভুবনে পথচলা বলা যায় প্রায় একই সময়ে। তাই সম্পর্কের জায়গা থেকে যদি বলতে হয় তাহলে বলা যায় যে জব্বার চাচা চলে যাওয়া মনে হচ্ছে যে আমার আব্বাই চলে গেলেন। তাই কষ্ট হচ্ছে খুব। একজন শিল্পী ভাবতে ভালবাসে, শিল্পীরা ভুলু মনা হয়। যে কারণে তাদের বাড়ি হয় না, গাড়ি হয় না। পরপারে চলে যাওয়ার সময় তাদের কিছুই থাকে না। যাইহোক জব্বার চাচা এমনই একজন শিল্পী যার গানশুনে হাজার হাজার মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছেন, শক্তি পেয়েছেন, সাহসী হয়েছেন। কিন্তু প্রতিদানে তিনি সত্যিকার অর্থে কী পেলেন। আমার বাবা অনেক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কষ্ট হয় এই যে একজন শিল্পীর শেষ বয়সে এসে নিজেকে নিঃশ্বেষ করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান। জব্বার চাচারও তাই হয়েছে। একজন চাকরিজীবী মানুষ চাকরি শেষে পেনশন পান। কিন্তু একজন শিল্পী যখন জীবনের শেষ সময়ের দিকে চলে আসেন অসহায়ত্ব ছাড়া তার আর কিছুই থাকে না। এ কেমন শিল্পী জীবন। জব্বার চাচা চলে গেছেন। আমাদের শুন্য করে দিয়ে চলে গেছেন। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসা রইল। দুঃখ প্রকাশ করছি পরিশেষে চাচা, আপনার জন্য আমরা সবাই কিছু করতে পারলাম না। একজন আবদুল জব্বার : ১৯৩৮ সালের ৭ নবেম্বর কুষ্টিয়া জেলায় আবদুল জব্বারের জন্ম। কুষ্টিয়ার তার শৈশব কেটেছে। মায়ের অনুপ্রেরণায় ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন কুষ্টিয়ায় মহম্মদ ওসমানের কাছে গান শেখেন। এরপর মকসেদ আলী সাঁই ও লুৎফেল হকের কাছেও গানের তালিম নেন। ওপার বাংলার উচ্চাঙ্গসঙ্গীতশিল্পী শিবু কুমার চ্যাটার্জির কাছে গান শিখতে কৈশরে দশ মাসের জন্য কলকাতায় ছিলেন আবদুল জব্বার। ১৯৫৭ সালে একটি বিচিত্রানুষ্ঠানে তার কণ্ঠে নজরুল সঙ্গীত ‘ঘুমিয়ে আছো বুলবুলি গো মদিনার গুলবাগে’ গানটি শুনে ঢাকা বেতারের গীতিকার আজিজুর রহমান তাকে রাজধানীতে নিয়ে আসেন। ১৯৫৮ সাল থেকে বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। বেতারেই তার কণ্ঠে নজরুল সঙ্গীত শুনে সঙ্গীত পরিচালক রবীন ঘোষ তাকে চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের প্রস্তাব দেন। এহতেশাম পরিচালিত ও রবীন ঘোষ সুরারোপিত ১৯৬২ ‘নতুন সুর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নেপথ্য শিল্পী হিসেবে অভিষেক হয়। দুই বছর পরে বিটিভিতেও নিয়মিতভাবে গান গাইতে শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হানের ‘সঙ্গম’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন আবদুল জব্বার। বিটিভির জন্মলগ্ন থেকে তিনি এর নিয়মিত গায়ক ছিলেন। ১৯৬৮ সালে মুক্তি পায় ‘এতটুকু আশা’। চলচ্চিত্রে সত্য সাহার সুরে ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পান আবদুল জব্বার। ১৯৬৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘পিচ ঢালা পথ’ চলচ্চিত্রের ‘পিচ ঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতা- দর্শকদের মন জয় করে নেন। গানটির সুরকার ছিলেন রবীন ঘোষ। একই বছর মুক্তি পাওয়া ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’ চলচ্চিত্র প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন তিনি। এ চলচ্চিত্রে ‘সূচরিতা যেও নাকো’ গানটির মাধ্যমে রোমান্টিক গায়ক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পান তিনি। আবদুল জব্বার এ দেশের অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। পুরস্কার ও সম্মাননা : আবদুল জব্বার ছিলেন এ দেশের জনপ্রিয় প্লেব্যাক শিল্পী এবং স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রধান শিল্পী। তিনি একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকে সম্মানিত শিল্পী। দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও জহির রায়হান স্মৃতি পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
×