ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

অসময়ে অবসরে কিংবদন্তি রুনি

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৩০ আগস্ট ২০১৭

অসময়ে অবসরে কিংবদন্তি রুনি

আধুনিক যুগে ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকার নাম ওয়েন রুনি। তারকা এই ফরোয়ার্ড চলতি বছর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন শৈশবের ক্লাব এভারটনে। পুরনো ক্লাবে ফিরে এসে নিজের হারানো ফর্মও ফিরে পেয়েছেন মেজাজি এই তারকা। ২২ আগস্ট রাতে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের ম্যাচে এভারটনের হয়ে ম্যানচেস্টার সিটির বিরুদ্ধে একটি গোল করেন ৩১ বছর বয়সী এই তারকা। তাতেই অসাধারণ এক মাইলফলকের মালিক হয়েছেন রুনি। মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ইংল্যান্ডের শীর্ষ লীগে ‘২০০’ গোল করার কীর্তি গড়েছেন। রুনির আগে অ্যালান শিয়েরার এই অভিজাত ক্লাবে প্রবেশ করেন। অসাধারণ এই কীর্তিগাথা রচনার পরের দিনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানান রুনি। বয়স খুব বেশি নয়, মাত্র ৩১ বছর। রিয়াল মাদ্রিদের পর্তুগীজ সুপারস্টার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর চেয়েও এক বছর কম। অথচ এই সময়েই আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় বলে দিয়েছেন রুনি। অনেকেই ইংল্যান্ডের হয়ে রুনির শেষ দেখে ফেলেছিলেন। কিন্তু প্রাণের ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে শৈশবের ক্লাব এভারটনে যোগ দিয়ে ফের জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্ন বুনছিলেন। শৈশবের ক্লাব টানা দুই ম্যাচে গোল করে রুনি বুঝিয়েও দিয়েছিলেন তিনি ফুরিয়ে যাননি। এরপরও থামতেই হলো তাকে। ইংল্যান্ডের বর্তমান কোচ গ্যারেথ সাউথগেট রুনিকে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের দলেও ডেকেছিলেন। কিন্তু জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার পরপরই আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নেন ইংলিশ তারকা। ইংল্যান্ডের হয়ে ১১৯ ম্যাচে ৫৩ গোল করা রুনি ২৩ আগস্ট সাউথগেটের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে অবসরের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। কোচ জোশে মরিনহোর অধীনে গত মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খারাপ সময় পার করার পর ইংল্যান্ড জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব হারান রুনি। এমনকি জাতীয় দল থেকেও বাদ পড়েন। চলতি মৌসুমে নিজের সাবেক ক্লাব এভারটনে যোগ দেন এ তারকা খেলোয়াড়। অবসর সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে বিবৃতিতে রুনি বলেন, আসন্ন ম্যাচগুলোর জন্য কোচ গ্যারেথ সাউথগেট পুনরায় দলে ডেকে আমাকে ফোন করায় আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। সত্যিই এটা প্রশংসনীয়। অনেক ভেবে চিন্তে কোচকে বলেছি নিজের ভালর জন্যই আমি আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সত্যিই সিদ্ধান্তটা কঠিন ছিল। আমি বিষয়টি নিয়ে আমার পরিবার, এভারটনের কোচ ও ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ইংল্যান্ডের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা বলেন, ইংল্যান্ডের হয়ে খেলাটা সব সময়ই আমার জন্য ছিল বিশেষ কিছু। প্রতিবারই দলের একজন খেলোয়াড় কিংবা অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হওয়াটা আমার কাছে ছিল অনেক সম্মানের। যারা আমাকে সমর্থন করেছেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ। তবে আমি মনে করি আমার সময় শেষ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এখন আমার একমাত্র চেষ্টা থাকবে এভারটনের হয়ে শিরোপা জয় করা। দেশের জার্সিতে খেলাকে স্পেশাল মুহূর্ত উল্লেখ করে রুনি বলেন, ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা সব সময় আমার জন্য বিশেষ মুহূর্ত ছিল। যখনই আমি খেলোয়াড় কিংবা অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি নিজেকে গর্বিত মনে করেছি। যারা আমাকে সাহায্য করেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এটিই বিদায় জানানোর সময়। বিদায় বেলায় নিজের আক্ষেপের কথাও জানান রুনি। বলেন, আমার সামান্য আক্ষেপের একটি হলো, ইংল্যান্ডের হয়ে কোন টুর্নামেন্টে সফল হতে না পারা। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়ার সিদ্ধান্তটাও কঠিন ছিল বলে উল্লেখ করেন রুনি। বলেন, ম্যানইউ ছাড়ার সিদ্ধান্তটা ছিল খুবই কঠিন। তবে আমি জানি নিজ ঘর এভারটনে ফেরার সিদ্ধান্তটা সঠিক। এখন এ ক্লাবের সাফল্যের লক্ষ্যে আমি আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করতে চাই। ২০০৩ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইংল্যান্ড দলে অভিষেক হয়েছিল রুনির। ১৮ বছরেই ইউরোর মতো বড় মঞ্চে খেলেছেন। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে কোন সাফল্য পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। বিদায় বেলায় এ নিয়ে দুঃখ জানাতে ভোলেননি তিনি। একজন খেলোয়াড় হিসেবে রুনির সঠিক মূল্যায়ন হয়নি বলে মনে করেন ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ফুটবলার গ্যারি লিনেকার। কিশোর বয়সের ক্লাব এভারটনে প্রত্যাবর্তনের পর নতুন করে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে রুনি। তার কিশোর বয়সেও ক্লাবটি দারুণ সহায়তা পেয়েছিল। কিন্তু মরিনোহর অধীনে গিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে অসন্তষ্ট হয়েই ফিরতে হয়েছে প্রিমিয়ার লীগে দুই শ’ গোলের মাইলফলকে পৌঁছানো এই ইংলিশ স্ট্রাইকার। এভারটনে ফেরার পর দুই লীগ ম্যাচে অংশ নিয়ে দুটিতেই গোল পেয়েছেন ৩১ বছর বয়সী রুনি। এভারটন ও ইংল্যান্ড জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করা লিনেকার বলেন, ব্রিটিশ ফুটবলের ইতিহাসে শীর্ষ ১০ ফুটবলারের তালিকায় রুনিকে স্থান দেয়া উচিত। তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে উল্লেখ করে লিনেকার বলেন, সম্ভবত সেখানেই স্থান নিতে যাচ্ছেন তিনি। তিনি যে ক্যারিয়ার গড়েছেন তাতে ব্রিটিশ ফুটবলের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দশ ফুটবলারের তালিকায় স্থান পাওয়া উচিত। তিনি ইংলিশ ফুটবলের একজন কিংবদন্তি খেলোয়াড়। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে ৮০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশ নিয়ে ৪৮টি গোল করা লিনেকার বলেন, আন্তর্জাতিক ফুটবলেও রুনিকে অবহেলা করা হয়েছে। যখনই জাতীয় দলে খেলতে গেছেন তখনই তাকে বোঝা মনে করা হয়েছে। অথচ জাতীয় দলে তিনিই ছিলেন বিশ্ব মানের সেরা তারকা। বার্সিলোনা ও টটেনহ্যাম হটস্পারের হয়ে খেলা ৫৬ বছর বয়সী এই ইংলিশ কিংবদন্তি আরও বলেন, তার কারণেই এক সময় ইংল্যান্ড আন্তর্জাতিক ফুটবলে ছড়ি ঘুরিয়েছে। মাঝে মাঝে পুরোপুরি ফিট না থাকা সত্ত্বেও তাকে খেলতে হয়েছে। আবার যখন তিনি পুরো সুস্থ ছিলেন তখন তাকে অনুপযুক্ত মনে করে বসিয়ে রাখা হয়েছে। যা তার ফর্মে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। রুনির মতোই ইংল্যান্ডকে বড় কোন শিরোপা এনে দিতে ব্যর্থ এই ফুটবল গ্রেট বলেন, ২০০৪ সালে পর্তুগালে অনুষ্ঠিত ইউরো টুর্নামেন্টের সময় যদি রুনি ফিট থাকতেন তাহলে অন্য কিছু হতে পারত। পায়ের হাড় ভাঙ্গার আগে ওই টুর্নামেন্টে চারবার গোল করেছেন রুনি। লিনেকার বলেন, তার ক্যারিয়ারের সূচনা লগ্নের কথা যদি আমরা স্মরণ করি তাহলে তাকে অবশ্যই কিংবদন্তির কাতারে রাখতে হবে। পর্তুগালে তিনি তা দেখিয়েছেন। তিনি যদি ইনজুরিতে না পড়তেন তাহলে হয়ত আমরাই শিরোপা নিয়ে আসতাম। কারণ তখনকার দলটি দারুণ ছিল। রুনির প্রতি সমর্থকদের সমর্থনেও ঘাটতি আছে বলে মনে করেন লিনেকার। তিনি বলেন, আমরা বিচারিক সমাজে বসবাস করার কারণে তাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করিনি। কারণ তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলেছেন। ক্লাবের কারণেই বিপুলসংখ্যক ফুটবল অনুরাগী এমনিতেই তাকে অপছন্দ করতে শুরু করেন। মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ইংল্যান্ডের শীর্ষ লীগে ‘২০০’ গোল করার কীর্তি গড়েছেন রুনি। এই কীর্তির পর শিয়েরার রুনিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। রুনির ২০০ গোলের ১৮৩টিই এসেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে। এভারটনের হয়ে দুই দফায় করেছেন বাকি ১৭ গোল। প্রিমিয়ার লীগে ২৬০ গোল নিয়ে তালিকার শীর্ষে শিয়েরার। শীর্ষ দশে এখনও খেলে যাচ্ছেন এমন খেলোয়াড় রুনি ছাড়া আছেন শুধু জার্মেইন ডিফো (১৫৮ গোল)। ২০০ গোলের ক্লাবে নিকট ভবিষ্যতে কেউ ঢুকতে পারছেন না এটা বলাই যায়। তবে শিয়েরারকে টপকাতে হলে পারফর্মেন্সের ধারটা আরও বাড়াতে হবে রুনির। সেটা তিনি করতে পারবেন কিনা সেটা বোঝা যাবে চলতি মৌসুম শেষেই। ২০০২ সালে এভারটনের হয়েই পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন রুনি। তখন বয়স ছিল মাত্র ১৬। প্রিমিয়ার লীগে এভারটনের হয়ে প্রথম গোলটি করার দিন রুনির বয়স ছিল ১৬ বছর ৩৬০ দিন। গুডিসন পার্কের ক্লাবটির হয়ে ৩১ বছর বয়সে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ইউনাইটেডের সাবেক তারকা।
×