ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট মোঃ মামুন রশীদ

মিরপুরে স্পিনের রাজত্ব

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৩০ আগস্ট ২০১৭

মিরপুরে স্পিনের রাজত্ব

বরাবরই স্পিনস্বর্গ হিসেবে স্বীকৃত বাংলাদেশের ‘হোম অব ক্রিকেট’ খ্যাত মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। আর এই স্পিন দিয়েই প্রতিপক্ষদের অনেকবার নাজেহাল করেছে বাংলাদেশ দল। সর্বশেষ গত অক্টোবরে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক টেস্ট বিজয়ও এসেছে স্পিনারদের দুর্দান্ত নৈপুণ্যে। তাই এবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ শুরুর আগেই ধারণা করা হয়েছিল মিরপুরে স্পিনই নিয়ন্ত্রণ করবে টেস্টের ভাগ্য। প্রথম টেস্টে সেটাই পরিষ্কার দেখা গেছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলও বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণের সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিজেদের সর্বনিম্নœ ২১৭ রানের দলীয় সংগ্রহে গুটিয়ে গেছে। তবে স্বাগতিক দলও অসি স্পিনের বিরুদ্ধে নাজেহাল হয়েছে ভালভাবেই। আগে ব্যাট করে ২৬০ রানেই গুটিয়ে গেছে। দ্বিতীয় ইনিংসেও স্পিনের দাপট দেখা গেছে। আর প্রতিদিনের খেলা শেষে সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন খুব স্পিন হচ্ছে এবং রান করাটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ব্যাটসম্যানদের জন্য। মিরপুরের উইকেট স্পিনস্বর্গ হিসেবে পরিচিত অনেক আগে থেকেই। গত অক্টোবরে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথমবার টেস্ট জয়ের যে অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়েছিল বাংলাদেশ দল সে ম্যাচে পুরো অবদানই ছিল স্পিনারদের। দুই ইনিংসে ইংল্যান্ডের ১০ উইকেট করে মোট ২০ উইকেটই নিয়েছেন বাংলাদেশের তিন স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ, সাকিব আল হাসান ও তাইজুল ইসলাম। মিরপুরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মুখোমুখি হওয়ার আগে বাংলাদেশ দল এখন পর্যন্ত ১০০ টেস্ট খেলে ৯টিতে জিতেছিল। এরমধ্যে মিরপুরে খেলা ১৬ টেস্টের মধ্যে জয় আছে দুটি। ২০১৪ সালে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে প্রথমবার মিরপুরে জয় পায় টাইগাররা। সেবার সাকিব, জুবায়ের হোসেন লিখন ও তাইজুল মিলে দুই ইনিংসে দখল করেছিলেন মোট ১৮ উইকেট। এবার অবশ্য সংস্কার করা হয়েছে মিরপুর স্টেডিয়াম। উইকেটগুলোও নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। এই উইকেটে খেলেনি এমনকি স্বাগতিক বাংলাদেশের কোন ক্রিকেটারও। তাই ছিল নানা জল্পনা-কল্পনা। উইকেট কেমন আচরণ করবে সেটাও বোঝা যাচ্ছিল না। আর মিরপুরের উইকেটের রহস্যময়তা সবসময়ই ছিল। এ বিষয়ে ম্যাচের আগেই অস্ট্রেলিয়ার স্পিন অলরাউন্ডার এ্যাশটন এ্যাগার বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় স্বাগতিকরা চাইবে যেভাবেই হোক স্পিন উইকেট করার। আমরা সেটার জন্যই প্রস্তুত হচ্ছি। সাধারণত এখানে স্পিননির্ভর উইকেট হয়ে থাকে এমনটাই দেখে এসেছি। এবারও তেমনটাই হবে।’ আর রহস্যময়তা নিয়ে সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, ‘মিরপুরের উইকেট বিচিত্র। এখানে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। তারা হয়তো খেলেনি এখানে, কিন্তু ওদের অনেক ভাল ব্যাটসম্যান আছে। বেশ কয়েকজনের উপমহাদেশের উইকেটে খেলার অভিজ্ঞতাও আছে। কয়েকজন ব্যাটসম্যান আছে যারা ভাল স্পিন খেলেন। তবে ভারত বা শ্রীলঙ্কার চেয়েও আমাদের উইকেট ভিন্ন। এখানে খেলার অভিজ্ঞতা থাকলেও অনেক সময় পরিকল্পনা করে কিছু হয় না।’ মিরপুরে এরআগে বাংলাদেশ দল খেলেছে ১৬ টেস্ট। এই টেস্টগুলোর মধ্যে দুটিতে জয়ের বিপরীতে ৪ ড্র ও ১০ পরাজয় আছে টাইগারদের। পরিসংখ্যান বলছে টেস্ট ম্যাচগুলোয় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন স্পিনাররা। ১৬ টেস্টে ৩৩.৭৭ গড়ে স্পিনাররা উইকেট নিয়েছেন ২৫৩টি। এরমধ্যে ম্যাচে ১০ উইকেট নেয়ার ঘটনা আছে দুটি। ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়ার ঘটনা ১৫ বার। এটাই স্পিনারদের খতিয়ান মিরপুর স্টেডিয়ামে। তবে স্পিনাররা কতখানি বেশি কার্যকর সেটা বোঝার জন্য জানতে হবে পেসারদের পরিসংখ্যানও। ১৬ টেস্টে পেসাররা ঝুলিতে পুরেছেন ১৯৩ উইকেট। তবে সেজন্য অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে তাদের। বোলিং গড়টাই সেটা বলে দিচ্ছে। পেসারদের বোলিং গড় ৩৫.১৬। ৯ বার ইনিংসে ৫ উইকেট নিতে পেরেছেন তারা এবং ম্যাচে ১ বার ১০ উইকেট দখলের ঘটনাও আছে। স্পিনাররা যত উইকেট পেয়েছেন তার সিংহভাগই গেছে বাংলাদেশের ঝুলিতে। বাংলাদেশের স্পিনাররা ৩৭.৭৪ গড়ে নিয়েছেন ১৩২ উইকেট। ১০ বার ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেছেন বাংলাদেশী স্পিনাররা এবং এক ম্যাচে ১০ উইকেটও নিয়েছেন একবার। এ কারণে মিরপুরের উইকেটে স্পিনের দাপট থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আর তেমনটাই দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে। ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্টে খেলতে নেমে সাকিব দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। প্রথম ইনিংসে তিনি দখল করেন ৫ উইকেট। ৯ টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট শিকারের ঘটনা টেস্টের ইতিহাসে চতুর্থ বোলার হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি। সবগুলো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব মাত্র তিনজন বোলারের ছিল এরআগে। শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি অফস্পিনার মুত্তিয়া মুরলিধরন, দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার ডেল স্টেইন ও লঙ্কান বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার রঙ্গনা হেরাথের। অর্থাৎ বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে সবগুলো টেস্ট দলের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখালেন সাকিব। আর এশিয়ার তৃতীয় বোলার হিসেবে এমনটা করলেন তিনি। একটা জায়গায় সাকিব সবাইকে ছাড়িয়ে নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন। সেটাও এক বিশ্বরেকর্ড। ৯ দেশের বিপক্ষে ৫ উইকেট নিতে আগের ৩ জনেরই খেলতে হয়েছে সাকিবের চেয়ে বেশি টেস্ট। মুরলিধরনের লেগেছিল ৬৬ টেস্ট, স্টেইন ও হেরাথের লেগেছে ৭৫টি করে টেস্ট। সাকিব সেই অনন্য কীর্তি গড়লেন ক্যারিয়ারের মাত্র ৫০তম টেস্টে নেমেই। অর্থাৎ তিনি হয়ে গেছেন দ্রুততম ৯ টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিরুদ্ধেই ৫ উইকেট নেয়ার ক্ষেত্রে। ক্যারিয়ারে যে ১৬ বার ৫ উইকেট পেয়েছেন তার মধ্যে ১২ বারই নিয়েছেন দেশের মাটিতে, দেশের বাইরে পেয়েছেন মাত্র ৪ বার। সেটাও কম অর্জন নয়। কারণ পেসবান্ধব উইকেটে ৫ জন ব্যাটসম্যানকে শিকার করা কঠিন ব্যাপার। তিনি এ কৃতিত্ব ২ বার দক্ষিণ আফ্রিকায়; ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ডে ১ বার করে দেখিয়েছেন। এরমধ্যে শুধু মিরপুরেই তিনি ৬ বার ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেছেন। মিরপুরে স্পিন কেমন দাপট দেখাচ্ছে সে বিষয়ে এ্যাশটন ম্যাচের দ্বিতীয় দিনশেষে বলেন, ‘খুব ঘুরছে বল। ব্যাটসম্যানদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে স্কোর করা। বল এখানে স্পিন করছে, হঠাৎ লাফিয়ে উঠছে। আমরা অবশ্য জানতামই যে এমন হবে।’ স্পিনস্বর্গে অসি স্পিনাররাও দারুণ হাত ঘুরিয়েছেন। প্রথমদিনেই বাংলাদেশকে ২৬০ রানে গুটিয়ে দেয়ার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল নাথান লিয়ন ও এ্যাগারের। দ্বিতীয় ইনিংসেও লিয়ন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন। তার কারণেই শেষ পর্যন্ত বড় লিড নিতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশী স্পিনাররাও কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন অসি ব্যাটসম্যানদের। এ কারণে প্রথমদিন শেষে সাকিব বলেছিলেন, ‘এখানে রান করা অনেক কঠিন। আমরা দেখছিলাম খুব ভাল স্পিন হচ্ছে। তখনই ভেবেছিলাম যদি এখানে আড়াই শ’ রানও করতে পারি সেটাই আমাদের জন্য অনেক ভাল সংগ্রহ হবে।’
×