ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

আমার বাবা, আমার পথচলার প্রেরণা

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৩০ আগস্ট ২০১৭

আমার বাবা, আমার পথচলার প্রেরণা

(শেষাংশ) চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর দেশে ফিরে আসি। স্বাধীন প্রিয় স্বদেশে সবার তখন বঙ্গবন্ধুর মুক্তির অপেক্ষা। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শুরু হয় সামনে এগিয়ে যাওয়া। শুরু হয় আমাদের লেখাপড়াও। দেশে ফেরার পর দাদুর সঙ্গে আমাদের আর দেখা হয়নি। আমরা মেঘালয় থেকে ফিরে আসার ক’দিনের মধ্যেই তিনি তার বাবার বাড়ি খালিয়াজুরী থানাধীন বল্লী গ্রামে ইন্তেকাল করেন। আব্বা ব্যস্ত হয়ে পড়েন ভারত থেকে দেশে ফিরে আসা শরণার্থীদের পুনর্বাসন কার্যক্রমে। একই সঙ্গে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে মাঝে মাঝে তিনি ঢাকায় গিয়ে অধিবেশনে যোগদান করে সংবিধান রচনায় অংশ নেন। ১৯৭২-এর ৪ নবেম্বর সংবিধান গৃহীত হয় যা একই বছরে ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। রচিত এই সংবিধানে অনেক গণপরিষদ সদস্যের সঙ্গে আমার বাবাও ১৪ ডিসেম্বর স্বাক্ষর প্রদান করেন। সম্মানিত স্বাক্ষরকারীদের তালিকার ২৮ ক্রমিকে রয়েছে আমার বাবার স্বাক্ষর। (সূত্র : ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ ১৯৭২’, প্রকাশকাল অক্টোবর ১৯৮৯)। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩-এর ৭ মার্চ। আমার বাবার নির্বাচনী আসন ও আব্দুল মমিন (সাবেক খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী)-এর নির্বাচনী আসন একীভূত হয়ে যাওয়ায় এই আসনে মনোনয়ন দেয়া নিয়ে দল দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু আব্বাকে ডেকে বলেছিলেনÑ ‘আব্দুল মমিন তোমার চেয়ে নেতা হিসেবে সিনিয়র, এ পর্যায়ে তাকে মনোনয়ন দিতে চাই, ভবিষ্যতে তোমার ব্যাপারে চিন্তা করব। তুমি কিছু মনে কর না’ (আমার বাবার বাচনিক)। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবনে আমার বাবাকে নিয়ে ভাববার দিনটি আর আসেনি। ঘাতকরা ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। জাতির পিতা এবং নেতাকে এভাবে হারিয়ে আব্বা স্বভাবতই চরম শোকাহত ও বিচলিত হয়ে পড়েন। আমি তখন নটর ডেম কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্র। ঢাকায় থাকি। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞের ৩-৪ দিন পরে আমি মোহনগঞ্জ যাই। বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক যখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তখন আমার বাবাসহ নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের বেশ ক’জন আওয়ামী লীগ নেতা কাদের সিদ্দিকীর ডাকে সাড়া দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যাবেন কি-না এ বিষয়ে স্থির কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না। এ সময় নেত্রকোনা জেলার অনেক যুবক বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে সংগঠিত হওয়ার জন্য সীমান্তের ওপারে ভারতে পাড়ি জমান। আমার আব্বাসহ জেলার বেশ ক’জন নেতা এ বিষয়টি জানতেন। এ কারণে ওই সময় সামরিক বাহিনীর হাতে আমার আব্বাকে নিগৃহীত হতে হয়েছিল। এমনকি তাকে কিছু দিন গৃহবন্দী করেও রাখা হয়। আব্বা আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত একজন মানুষ ছিলেন। আমি আজও অনুভব করি বঙ্গবন্ধু এবং তার আদর্শই ছিল আমার আব্বার ধ্যান-জ্ঞান। আব্বা একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক হিসেবে একাগ্র মনে মানুষের সেবা করে গেছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন নির্মোহ ও কর্তব্যপরায়ণ। ১৯৮৬/৮৭ সালের শেষের দিকে আমি সবেমাত্র ওকালতি পেশায় যোগ দিয়েছি। একদিন একটি ছোট প্রকৃতির মামলার শুনানি করার জন্য আমার সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান আমাকে মুন্সীগঞ্জ যেতে বললেন। ওই সময় আমি ও আমার বন্ধু এম ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে বিচারপতি) একসঙ্গে ঢাকার জিগাতলার একটি বাসায় থাকতাম। সেখান থেকে বেরিয়েছি মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে বাস ধরব বলে। এ্যাডভোকেট বজলুর রহমান ছানাও (যিনি পরবর্তীতে বিচারপতি) আমার সঙ্গে যাবেন। দু’জনই এক রিক্সায় যাওয়ার পথে এলিফ্যান্ট রোডে একটি ছোট দুর্ঘটনায় পড়ি। আমি রিক্সা থেকে ছিটকে পড়ে সামনের রিক্সার পেছনের লোহার পাতের সঙ্গে ডান চোয়ালে সামনে আঘাত পাই। প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করি। কি করব ভেবে ওঠার আগেই মোটরসাইকেলে ওই পথে আসা এক আইনজীবীকে বজলুর রহমান আমাকে তুলে নিয়ে রিক্সার পেছন পেছন যেতে বলেন। সেদিনের সেই মোটরসাইকেল আরোহী ছিলেন আকরাম হোসনে চৌধুরী (বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি)। এদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আঘাত পাওয়ার স্থানে ব্যথার মাত্রাও বাড়ছে। মুন্সীগঞ্জে পৌঁছানোর পর খেয়াল করি আমি ব্যথায় কাতর, মুখ খুলতেই পারছি না। সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরে ইস্কাটনে মামার বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে দেখি মোহনগঞ্জ থেকে আব্বা-আম্মা বেড়াতে এসেছেন। আমার চোয়ালের আঘাত দেখে আম্মা একটু বিচলিত হলেও আব্বা বলেনÑ‘ব্যথা পেয়েছ সেটি কষ্টের, তবে তুমি যে এই অবস্থায়ও সিনিয়রের নির্দেশ মেনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছ সেটি অত্যন্ত ভাল কথা। কর্তব্য সবার আগে, তবে শরীর ও স্বাস্থ্যের প্রতিও নজর রেখ।’ আমি আজও আব্বার ওইদিনের অনুশাসনের মোড়কে আবৃত উচ্চারণগুলো বিস্মৃত হইনি। তখন এটি অনুভব করেছিÑ জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে এলেও আমি বাবার অনুশাসন ও নির্দেশনা থেকে মুক্ত হইনি। আমি যেন তার কাছে তখনও এক শিশু! একজন পিতার চিরন্তন বৈশিষ্ট্যই বুঝি এটি! আব্বার সেদিনের ওই কথাগুলো কেবল সরল উচ্চারণ ছিল না, বচনগুলো ছিল ¯েœহমাখা দিকনির্দেশনা যা আমাকে এখন কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে প্রেরণা দেয়, উৎসাহ দেয়। আমার ছেলেকেও ওই কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করি যেন তার মাঝেও কর্তব্য পালন সম্পর্কে আমার আব্বার ধ্যান ও দর্শন প্রতিফলিত হয়। আব্বার অনুশীলিত অনেক কিছুই তাকে চিনতে ও জানতে সাহায্য করে। আব্বা ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ অসাম্প্রদায়িক মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ ধর্মীয় আচার-আচরণ যেমন আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করতেন ঠিক পাশাপাশি এলাকার অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গেও তার ছিল দৃশ্যমান এক সম্প্রীতির বন্ধন। ভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় তিনি ছিলেন আন্তরিক। এটি দৃশ্যমান হতো যখন দেখতাম প্রতি ঈদে মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দুু সম্প্রদায়ের লোকদেরও আমাদের বাসায় নিমন্ত্রণ করা হতো এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রীতি ও অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আমাদের বাসায় তাদের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হতো। বাবা ছিলেন ধর্মীয় সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমাজে সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টিতে সচেষ্ট একজন মানুষ। আব্বা ছিলেন একজন খাঁটি রবীন্দ্রপ্রেমিক। কবিগুরু ও গানের প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ ও অনুরাগ। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে...’ গানটি ছিল আব্বার সবচেয়ে পছন্দের। শান্তি নিকেতনের সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ ড. শৈলজা রঞ্জন মজুমদারের সঙ্গে আব্বার ছিল আন্তরিক হৃদ্যতার সম্পর্ক। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে শৈলজা বাবু একবার তার পিতৃভূমি মোহনগঞ্জে এসেছিলেন। গ্রামের বাড়ি বাহামে পিতৃ ভিটেটা দেখে আমাদের বাসায় তিনি দুই রাত যাপন করেছিলেন। আব্বা তখন স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে আমাদের বাড়ির আঙিনায় তার প্রতি ভালবাসায় এক সংবর্ধনা আসরের আয়োজন করেছিলেন। আমি দেখেছি, যতদিন শৈলজা রঞ্জন মজুমদার বেঁচে ছিলেন ততদিন আমার বাবার সঙ্গে তার নিয়মিত পত্রালাপ ছিল। আমি এটি বলতেই পারি যে, পারস্পরিক সম্মান ও ভালবাসার বন্ধনের কারণেই এটি হয়েছিল। আব্বা ছিলেন সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষকে তিনি ভালবাসতেন। ১৯৮৭ সালে শৈলজা বাবু যখন শেষবারের মতো বাংলাদেশে আসেন তখন আব্বার সঙ্গে আমিও নেত্রকোনায় যাই। উদ্দেশ্যÑশৈলজা বাবুর সঙ্গে সাক্ষাত করা। বলে রাখি, শৈলজা রঞ্জনের জীবনীগ্রন্থ ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’-এ আমার আব্বার লেখা একটি পত্র ছাপা হয়েছে। আব্বাকে নিয়ে অনেক অনেক কথাই বলার আছে। শেষ হওয়ার নয় এসব কথা। তারপরও তার চরিত্রের আরেকটি দিক তুলে না ধরলে তাকে চিত্রিত করাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আব্বা ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী মানুষ। দেখেছি, মোহনগঞ্জের কোন ছাত্র পরীক্ষায় ভাল ফল করলে আব্বা তার বাড়িতে যেতেন এবং অবশ্যই খালি হাতে নয়। সঙ্গে একটি বই বা একটি কলম নিয়ে যেতেন ওই কৃতী ছাত্রটিকে উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য। এভাবে এক সময় বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, এলাকার কোন ছাত্র ভাল ফল করলে তার বাবা-মা নিজে থেকেই আব্বার কাছে এসে তা জানাতেন। এমনটি করার পেছনে ওই অভিভাবকদের বিশ্বাস ছিল আব্বার আশীর্বাদ মিশ্রিত কোন উপহার তাদের সন্তানের পথচলায় প্রেরণা দেবে। এলাকায় এরপর এই বিষয়টি যেন একটি রুটিনে পরিণত হয়। পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফল করা কোন ছাত্রের নাম পরিচয় কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হলে আব্বা সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিঠি লিখতেন। এই চিঠির মাধ্যমে বাবা মূলত ওই কৃতী ছাত্রকে ভবিষ্যতে দেশের জন্য ভাল কাজে নিবেদিত হতে প্রেরণা দিতেন। আমার মনে হয়েছে, দেশের ভবিষ্যত নির্মাণে আব্বার এই প্রেরণা সমৃদ্ধ কাজটি তার অন্যান্য চরিত্রের আরেকটি প্রতীক। আমার জানামতে, কাছের ও দূরের স্বজনদের সঙ্গে বাবার ছিল আন্তরিক যোগাযোগ। নিজেকে কখনও বিচ্ছিন্ন করে রাখেননি তিনি। আব্বা ছিলেন বন্ধু বৎসল। মোহনগঞ্জের সকল মানুষকে তিনি আপনজন মনে করতেন। জীবনের শেষের দিনগুলোতে আব্বা ঢাকায় আমার বাসায় থাকতেন। সেই সময় মোহনগঞ্জ বা নেত্রকোনা থেকে কেউ এলে তার সঙ্গে আব্বা কথা বলতে চাইতেন। কিন্তু ‘পারকিনসন’ রোগের কারণে জীবন সায়াহ্নের দিনগুলোতে তার কথা খুব ধীর হয়ে গিয়েছিল। তারপরও এলাকার মানুষের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার আকুলতা লক্ষ্য করতাম। এটা আব্বার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কত স্মৃতি মনে পড়ছে! আম্মা আব্বার নামে একটি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমি, আমার অপর দুই ভাই সাজ্জাদুল হাসান, সাইফুল হাসান এবং আমাদের নিজ নিজ স্ত্রী এই ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণ এবং এলাকার হতদরিদ্র মানুষের কল্যাণ ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করাই এই ট্রাস্টের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। প্রতি বছরের মতো এ বছরও আব্বার মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয় গ্রামের বাড়ি মোহনগঞ্জে। এই আগস্ট মাসে আমরা বাঙালী জাতি হারিয়েছি আমাদের জাতির পিতাকে। আর আমরা ভাই-বোনেরা এই আগস্ট মাসেই হারিয়েছি জাতির পিতার আদর্শে বিশ্বাসী তারই একনিষ্ঠ একজন কর্মী আমাদের বাবাকে। তাই আগস্ট মাসটি জাতীয় জীবনে এবং একই সঙ্গে আমাদের পারিবারিক জীবনে একটি শোকাবহ মাস। আজ আগস্টের এই দিনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের দরবারে জাতির পিতা ও তার পরিবারের সদস্যগণ যারা ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বর্বর ঘাতকদের হাতে নিমর্মভাবে নিহত হন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। একই সঙ্গে আমাদের প্রেরণা, পথপ্রদর্শক এবং একজন আদর্শ পুরুষ আমাদের প্রিয় আব্বার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ যেন তাদের সবাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস এনায়েত করেন। লেখক : বিচারপতি
×