বন্যা প্লাবিত বাংলাদেশে এলো ঈদ-উল-আযহা। বাস্তবতা মেনেই চলছে উৎসবের প্রস্তুতি। কেনাকাটা, সাজসজ্জা, ঘরে ফেরার তাগিদ। রেলওয়ে ও বিআরটিসি বাসের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকে। তিন-চার দিনের ছুটি কাটাতে গ্রামের দিকে যাত্রাও শুরু হয়েছে। জনবহুল ঢাকা হবে সুনসান ফাঁকা। ট্রাফিক জ্যাম নেই, হকার, রিক্সাওয়ালার হাঁকডাক নেই। এমন ঢাকা চিরস্থায়ী হোক- এ আকাক্সক্ষা দানা বাঁধতে না বাঁধতে আবার কোলাহল, আবার যানজট উর্ধশ্বাস ছুটে চলা। এই দৃশ্য বদলে একটা বিষয় পরিষ্কার ঢাকার মোট জনসংখ্যার কমপক্ষে আশি ভাগ খেটে খাওয়া মানুষ ঢাকায় বাস করে অনিচ্ছায়। শুধু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। এ প্রয়োজন যদি তারা নিজের গাঁয়ে বা পাশের শহরে মেটাতে পারত তাহলে ঢাকা শহরে আসত না-তা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়। তাদের মানসিক প্রশান্তির জায়গা নিজ গ্রাম, যেখানে রয়েছেন বুড়ো মা-বাবা আর ছোট ভাইবোনেরা। তাদের সাধ্য নেই এদের ঢাকায় এনে একসঙ্গে বাস করার। মনটা তাই স্বাভাবিকভাবে পড়ে থাকে আপনজনের কাছে। উচ্চ ও মধ্যবিত্তের বিরক্তি যতই বাড়ুক ঢাকা শহরে এদের উপস্থিতি অস্বীকার করার বাস্তবতা নেই। কারণ শহরটি শুরু থেকেই বেড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। লুটেরা পুঁজি আর রাজনৈতিক কূপম-ূকতা এ শহরকে প্রতিদিন একটু একটু করে তুলছে একটি অচলায়তন, বদ্ধ শহর। শহর ছেড়ে ঈদের আগে রাস্তায় পা বাড়ানো আরেক বিড়ম্বনা। ঈদের অন্যান্য আনুষঙ্গিকতার সঙ্গে গত ক’বছরে যোগ হয়েছে রাস্তা মেরামতের মহাযজ্ঞ। মানুষ এখন মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, ঈদের আগে রাস্তা মেরামতের দক্ষযজ্ঞ চলবে আর যোগাযোগমন্ত্রী পরিপাটি পোশাকে প্রতিদিন টিভি ক্যামেরায় ধরা দিয়ে দার্শনিকের মতো বাণী দেবেন। রাস্তায় নেমে একে চড়, ওকে থাপ্পড় মেরে বীরের ইমেজ প্রতিষ্ঠা করবেন। এ এখন ঈদ প্যাকেজের অনিবার্য তামাশা।
অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্যবসায়ীরা এবার ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির যে আকার ধারণা করছেন তা গত ঈদের চেয়ে দশ হাজার কোটি টাকা বেশি। ষোলো কোটি মানুষের মধ্যে বারো কোটি পঞ্চাশ লাখ মানুষের ঈদ বাজারে ঢোকার সামর্থ্য নেই। ঈদের বাজার থেকে শুরু করে ভ্রমণ ইত্যাদিতে অংশ নেন তিন কোটি পঞ্চাশ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে ধনীর সংখ্যা বেয়াল্লিশ লাখ। ঈদ বাজারের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ লেনদেন হয় এদের কেনাকাটায়। এদের মধ্যে এক লাখের বেশি মানুষ কেনাকাটার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড বা পছন্দসই অন্য দেশে ছোটেন। এদের গড় খরচ পঞ্চাশ হাজার করে ধরলেও মোট খরচ পঞ্চাশ কোটিতে দাঁড়ায়। দেশের বাজারের এক লাখ টাকা দামের শাড়ি কিংবা দুই লাখ টাকা দামের লেহেঙ্গা কেনার গর্বিত রেকর্ড এরাই করতে পারেন। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা কিংবা জোড়াতালির বাস ট্রেন লঞ্চের ভোগান্তি তাদের স্পর্শ করে না। এদের বিচরণ ভূমির চেয়ে আকাশে বেশি। প্রশ্ন উঠতে পারে- এত বিপুল যাদের ব্যয় তাদের আয়ের উৎস কি?
বিশ্ব পুঁজি প্রবাহের দুরন্ত গতির ধাবমান ট্রেনের আরোহী এরা। ছুটে চলছেন দিক চক্রবাল ভেদ করে। তাদের আয়ের উৎস সব সময় খালি চোখে দেখা যায় না। পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছেন তারা।
পুঁজির ইতিহাস আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার ইতিহাস। কর্পোরেট পুঁজির উত্থান ও বিস্তারের যুগে জাতি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের হাতে পুঁজির পতাকা পতপত করে ওড়ে। তাদের ভূমিকা এখনও এ পর্যায় পর্যন্ত সীমিত থাকলেও কেন্দ্রীয় কর্পোরেট পুঁজির ক্ষমতা অপরিসীম। ভূমি থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, বিনোদন সবকিছু এর নিয়ন্ত্রণে। এসবের মুনাফা নিয়ন্ত্রণের স্টিয়ারিং হুইল কেন্দ্রীয় কর্পোরেশনগুলোর হাতে। যাদের শ্লোগান সবার ওপর মুনাফা সত্য তাহার ওপর নাই।
॥ দুই ॥
ভাঙ্গাচোরা সড়ক পেরিয়েই ছুটছে মানুষ। ‘যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ আসিতে তোমার দ্বারে ...।’ সারা বছরের অন্তহীন পথ চলার শ্রান্তি মুছে যায় ক’দিনের আনন্দে। প্রিয়জনের দ্বারে পৌঁছে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে। পেছনে পড়ে থাকে দুঃসময়ের স্মৃতি অন্তত ক’দিনের জন্য হলেও।
আজকের দিনে মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু ও নির্ভরতা তার কাজ। কাজই বাঁচিয়ে রাখে, আবার বিচ্ছিন্নও করে। বিচ্ছিন্নতার সুতোগুলো জোড়া দেয় উৎসব। বারো মাসে তেরো পার্বণের শান্ত গ্রামীণ জীবন পেরিয়ে বিচরণ এখন নগরজীবনে। ভিন্ন রূপে ফিরেছে পালাপার্বণ। বারো মাসে তেরো না হলেও সাত-আট তো হবেই। কৃষিনির্ভর সমাজে পার্বণের ছুতোয় দেখা হতো একের সঙ্গে অন্যের। বিনিময় হতো মনের ভাব। এখনও তাই। উৎসবকে কেন্দ্র করে কাছাকাছি হওয়া। তবে তা নাগরিক ফর্মে। মিউজিক থেকে ফ্যাশন ট্রেন্ড, কিচেন থেকে টেলিভিশন, সবখানে লেগেছে তার ছোঁয়া। ভেতরে উদ্দেশ্য যাই থাক ফেস্টিভ মুড এসেছে নগরজীবনে। যে ঈদ সীমিত ছিল ঈদগাহ্ আর কোলাকুলি, সেমাই-জর্দা আর পোলাও-মাংসের টেবিলে, বড়জোর বৈঠকি আড্ডা পর্যন্ত, তার সঙ্গে এখন জড়িয়েছে অনেক কিছু। মধ্যবিত্ত জীবনের আখ্যান তৈরিতে যা অপরিহার্য। সিনেমা, নাটক, সঙ্গীত, ফ্যাশন, রূপ, রেসিপি, ইন্টেরিয়র- কি নেই সেখানে। ভারতীয় সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকারা ফ্যাশন আইডল হিসেবে ভূমিকা রাখছেন। চতুর ব্যবসায়ী বাঙালীর মন বোঝে। দেশের টাকা ভিন দেশে পাঠিয়ে চটজলদি চালু সিরিয়ালের হিট নায়িকার নামে শাড়ি-গয়নার পসরা সাজিয়ে ফেলে। সেসবের দারুণ কাটতি। দেশীয় বুটিক শপের কর্ণধাররা ভরসা করেন রুচিশীল ক্রেতার ওপর। তারা হতাশ করেন না বিক্রেতাকে। ফ্যাশন ক্যাটালগ দেখে বুটিক শপে ছোটার ক্রেতাও কম নয়। নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্টে বিশ্বাসীরা ওখানেই ভিড় জমান বেশি। আরেক দলের উৎসবে তো থাকেই ব্যান্ডের গান, সঙ্গে নাচ, পিৎজা হাট বা কেএফসিতে স্পেশাল ডিনার, লং ড্রাইভ বা বন্ধুর আড্ডায় সফট ককটেল পার্টি। এসব এসে গেছে শহুরে উৎসবে।
এখন শহর বেড়েছে, মানুষ বেড়েছে, পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বেড়েছে। উৎসবের ধরনও বদলেছে। সুদূর আমেরিকার ডালাস থেকে কিংবা কানাডার টরেন্টো থেকে প্রবাসী ছেলেমেয়েরা মাকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দিন শুরু করে। দিনে আরও কয়েকবার কথা হয় তাদের। শেয়ার হয় ঈদের আনন্দ। শরীরী উপস্থিতি না থাকলেও বিশ্বময় ছড়িয়ে যায় প্রাণের আনন্দ। দেশের সীমানা তো ভৌগোলিক। জীবনে আনন্দ-বেদনার টেক্সট এখন ওয়েবে। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ সবখানে ছড়িয়ে গেছে তা।
ঈদ বা উৎসবের আনন্দ আগের মতোই আছে। আগের প্রজন্মের কাছে তার পাঠ ছিল এক রকম, এ প্রজন্মে তা বদলে যাবে সেই তো স্বাভাবিক। পরিবর্তনকে ধারণ করে চলাই জীবনের লক্ষণ।
[email protected]