ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সীমান্তের ওপারে জিরো পয়েন্টে খোলা আকাশের নিচে অগণিত রোহিঙ্গা নর-নারী-শিশু অনুপ্রবেশ বেড়েই চলেছে মিয়ানমার গণমাধ্যমে উল্টো প্রচার

রাখাইনে গণহত্যা ধর্ষণ জ্বালাও পোড়াও চলছেই ॥ রোহিঙ্গা বিতাড়নই লক্ষ্য

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ৩০ আগস্ট ২০১৭

রাখাইনে গণহত্যা ধর্ষণ জ্বালাও পোড়াও চলছেই ॥ রোহিঙ্গা বিতাড়নই লক্ষ্য

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাবিরোধী সেনা নেতৃত্বাধীন যৌথ অভিযান আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে। ফলে জ্বলছে রাখাইন রাজ্য, মরছে রোহিঙ্গারা, বাড়ছে অনুপ্রবেশ। ব্রাশ ফায়ারে গণহত্যার পাশাপাশি যুবতী ও নারীদের গণধর্ষণও শুরু হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের সূত্র মতে রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করার লক্ষ্যে এবারের অভিযান শুরু হয়েছে বলেই প্রতীয়মান। রাখাইন রাজ্যে তিন টাউনশিপে অর্থাৎ মংডু, বুচিদং, রাচিদং এলাকাগুলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত। রোহিঙ্গাদের এদেশে অনুপ্রবেশে নেপথ্যে অর্থের বিনিময়ে সহযোগিতা করার কারণে মঙ্গলবার চার পুলিশসহ ২৬ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। অপরদিকে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, দমন নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনাবলীকে সেদেশের গণমাধ্যমসমূহে উল্টোভাবে প্রচার করা হচ্ছে। সংবাদ প্রকাশে সেদেশের সরকারী কঠোর নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা গণমাধ্যমগুলো যেন অসহায়ত্ব বরণ করে আছে। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হওয়া সে দেশের সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এই নারকীয় অভিযানে মৃতের সংখ্যা যে ঠিক কি কত তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা না গেলেও বর্তমানে তা কমপক্ষে দেড় হাজার হবে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে। দমন নিপীড়ন, নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনায় ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস রোহিঙ্গাদের জানমাল প্রার্থনা করেছেন। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ ধর্মগুরু বলেছেন রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের যে দুঃসংবাদ আসছে ঈশ্বর যেন তাদের রক্ষা করেন, তারা যেন মানবিক সহায়তা পান। তিনি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সকলের প্রতি মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার আবেদন জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, এ বছরের ২৭ থেকে ৩০ নবেম্বর মিয়ানমার এবং ৩০ থেকে ২ ডিসেম্বর এ ধর্মগুরু বাংলাদেশ সফর করার কথা রয়েছে। অপরদিকে সন্ত্রাসী ঘটনাসহ যুদ্ধ বিগ্রহের ঘটনা নিয়ে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো সাধারণত যেভাবে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে থাকে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম কেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মিয়ানমারের নাগরিক হয়েও তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে বহু আগে। ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার নেই। এমনকি এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াতেও অনুমতি বাধ্যতামূলক। বছরের পর বছর চলছে এ অবস্থা। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সুনির্দিষ্টভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ও তাদের যানমাল রক্ষার জোরালো আহ্বান জানালেও তাতে কোন সফলতা আসেনি। অপরদিকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া আগের মতোই সোচ্চার হয়েছে। আর বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ প্রদর্শন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যম সোচ্চার হলেও এ পর্যন্ত এ নিয়ে কোন কার্যকর সুফল দৃশ্যমান নয়। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, মিয়ানমার সরকারের এবারের নারকীয় অভিযান রোহিঙ্গা মুক্ত রাখাইন রাজ্য প্রতিষ্ঠারই রক্তাক্ত অভিযান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ১১ লাখ। এবারের সামরিক অভিযানে প্রতীয়মান হচ্ছে এদেরকে ‘বাঙালী সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে আর কাউকে থাকতে না দেয়া পথই বেছে নিয়েছে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচির সরকার। কেননা, অভিযানের পর আউং সান সুচি সামরিক অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেয়ার পর তা আরও জোরালো রূপ নিয়েছে। এদিকে সীমান্তের ওপারে জিরো পয়েন্টের ৮ এলাকায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ৩০ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশু জমায়েত হয়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির কড়া নজরদারির কারণে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ইতোপূর্বেকার চেয়ে অনেকাংশে থমকে গেছে। তবে ইতোমধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে বহু রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশু। এদের সংখ্যা স্থানীয় পর্যায়ে দেড় হাজারেরও বেশি বলা হলেও মূলত এ সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি হবে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা আধিক্যে টেকনাফ থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা এপারের বসবাসকরতদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় রীতিমতো বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। মঙ্গলবার সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাচিদং জেলার সোহাগপ্রাং রোহিঙ্গা পল্লীতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো ছাড়াও গণধর্ষণও শুরু হয়েছে। মিয়ানমারের পুলিশ, লুন্টিং, সেনা ও বিজিপি সম্মিলিতভাবে এ বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার ভোরে নৃশংসতা আরও বেড়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। শত শত সেনা সদস্য গ্রামটি ঘেরাও করে চিরুণী অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা পুরুষদের পাকড়াও করেছে। পাকড়াওকৃত পুরুষদের দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করেছে। আর রোহিঙ্গা নারী ও যুবতীদের ধরে নিয়ে ওই গ্রামের একটি স্কুলঘরে গণধর্ষণ চালানো হয়েছে। তাদের এ অমানবিক বর্বরতা থেকে উঠতি বয়সের কন্যা শিশু পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। স্কুল ঘরটিতে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বহু নারী ও যুবতীর লাশেরও স্তূপ হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, হত্যার পর গাড়িতে তুলে অনেক লাশ নিয়ে গেছে। তবে বেশ কিছু মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। যাওয়ার সময় অগ্নিসংযোগ করার ফলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বসতঘরগুলো। পুড়ে মরেছে গবাদিপশুও। গ্রামটি এখন জনশূন্য ও নিস্তব্ধ। এছাড়া এ গ্রামের আশপাশের সব রোহিঙ্গা পল্লী ঘিরে রেখেছে সেনা সদস্যরা। আরাকানের রোহিঙ্গা পল্লীতে হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য ইতোমধ্যে সে দেশের নাগরিকদের সরানোর কাজ প্রায় সম্পন্ন করেছে। বর্বরতার এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সপ্তাহের মধ্যে পুরো রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গা শূন্য হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে গত ৫ দিনে রাখাইনে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অন্তত ২১ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যেসব এলাকায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে, ওসব এলাকাগুলো হেলিকপ্টারের সাহায্যে গান পাউডার ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে সেনা সদস্যরা। সীমান্তের ওপারের বিভিন্ন সূত্র মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তথ্য দিয়েছে বিকেল ৩টায় মংডু থেকে আকাশে উড়ে একটি হেলিকপ্টার প্রথমে ফকিরাবাজার এলাকার দিকে যায়। ১৫-২০ মিনিটের মাথায় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে একাধিক রোহিঙ্গা পল্লী। ওপার থেকে পাওয়া তথ্যে আরও জানা গেছে, পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রুর ফকিরা বাজার, রাইমনখালী ও ঘুমধুম-বালুখালী বরাবর ঢেকিবনিয়া এলাকার ৫-৬টি পাড়া গান পাউডারে জ্বলে ছাই হয়ে গেছে। ওসব বসতবাড়িতে থেকে ২-৩ দিন আগে সেনাবাহিনীর ভয়ে সরে অবস্থান নিয়েছিল বহু রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। পাহাড়ের পাদদেশে ঘরের পাড়াগুলোতে রোহিঙ্গাদের পাহারা ছিল। যার ফলে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বসতবাড়ি, গোলার ধান এমনকি গৃহপালিত গবাদি পশুও। পোপের নিন্দা ক্যাথলিক খ্রীস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস রোহিঙ্গা নিপীড়নের নিন্দা জানিয়ে তাদের পূর্ণ অধিকারের জন্য প্রার্থনা করেছেন। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের দুঃসংবাদ কেবলই আসছে। ঈশ্বর যেন তাদের রক্ষা করেন এবং তারা যেন মানবিক সহায়তা পায়। বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমি রোহিঙ্গাদের প্রতি পূর্ণ একাগ্রতা ঘোষণা করছি। আসুন আমরা সবাই প্রার্থনা করি যেন ঈশ্বর তাদের রক্ষা করেন। রোহিঙ্গারা যেন তাদের পূর্ণ অধিকার ফিরে পায়। সেজন্য শুভবুদ্ধির নারী-পুরুষদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। উল্লেখ্য, চলতি বছরের শেষ নাগাদ এ ধর্মগুরুর মিয়ানমার সফরে কথা রয়েছে। বিশ্বের ১২০ কোটিরও বেশি ক্যাথলিক খ্রীস্টানের প্রধান এই ধর্মগুরু আগামী ২৭ থেকে ৩০ নবেম্বর মিয়ানমার এবং ৩০ নবেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করার কর্মসূচী রয়েছে। পোপ ফ্রান্সিসের এই সফর হবে মিয়ানমারে প্রথম কোনো পোপের গমন। বাংলাদেশে অবশ্য ১৯৮৬ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল সফর করেছিলেন। খ্রীস্টানদের প্রধান এই ধর্মগুরু বরাবরই রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ফ্রান্সিস এর আগেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, সংখ্যালঘু এ জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের নিরাপত্তা দেয়া প্রয়োজন। মঙ্গলবার বিকেলে পাওয়া শেষ খবর অনুযায়ী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে এবং তা বেড়েই চলেছে। সহিংসতার মুখে মংডু ও বুচিডং শহর থেকে বেসরকারী সংস্থা ও সেখানকার নাগরিকদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সহিংসতাপ্রবণ এলাকা থেকে প্রায় চার হাজার মিয়ানমার নাগরিককে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠন আল ইয়াকিনকে (আরসা) হামলার জন্য দোষারোপ করলেও কিছু কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার ইন্ধনে সেখানকার অনেকে ‘রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সঙ্গে জড়িত’ বলে অভিযোগ এনেছে দেশটির সরকার। রাখাইনে পুলিশ ও সামরিক জান্তার সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষে মাত্র ৯৭ জন নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করা হলেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে এমন বিভিন্ন সংস্থা ও সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, দেড় সহস্রাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর শরীর বুলেটে ঝাজরা হয়ে গেছে। মিয়ানমার সরকারের দাবি অনুযায়ী শুক্রবার ভোরে দেড় শতাধিক হামলাকারীরা ৩০টি পুলিশ ও সেনা চৌকিতে পরিকল্পিত হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেনশন আর্মি (আরসা)। বন্দুক, চাপাতি ও গ্রেনেড নিয়ে হামলা চালানো শতাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে বলে সরকার পক্ষে বিবৃতিতে জানিয়েছে মিয়ানমার। তাদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রের ছবিও বিভিন্ন অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেনশন আর্মি (এআরএসএ) তথা আরসা হামলার দ্বায় স্বীকার করে নিজেদের মিয়ানসার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক বাহিনী হিসেবে কাজ করছে বলে দাবি করা হয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে উৎকণ্ঠা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, জলপাইতলী, তুমব্রু পশ্চিমকূল, উত্তরকূল, কলাবাগান, বাইশপাড়ি, চাকমাপাড়া, হেডম্যান পাড়া, রেজু আমতলী, আচারতলিসহ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী লোকজনের মধ্যে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। মিয়ানমারের ডেকুবনিয়া, ফকিরা বাজার, মিয়া বাজার, উত্তর পাড়া, তুমব্রু থেকে আসা ৫ শতাধিক নারী-শিশু, পুরুষকে খিচুড়ি, মুড়ি ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে বলে ঘুমধুম ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। নারী শিশুর উপস্থিতির হার বেশি মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থানকারী নারী-শিশুর উপস্থিত বেশি। ঘুমধুম, তুমব্রু, বাইশপাড়ি, জলপাইতলী, বেতবুনিয়া, কলাবাগান, ধামনখালী, রহমতের বিল ও টেকনাফের সীমান্তজুড়ে অনুপ্রবেশ করতে আসা বেশিরভাগই নারী শিশু। এ ব্যাপারে সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, সেনা বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লড়তে আল ইয়াকিনের (আরসা) ব্যানারে সমবেত হয়েছে রোহিঙ্গা সশস্ত্র যুবকরা। যার ফলে অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে রোহিঙ্গা যুবক খুব বেশি নেই বললেই চলে। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো আবারও জানিয়েছে, রাখাইনে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি ক্রমাগতভাবে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ফলে সার্বিক অবস্থার অবনতিও ঘটে চলেছে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা। সীমান্তে ক্রিটিক্যাল পয়েন্টগুলোতে বিজিবি পাহারা জোরদার রয়েছে এবং সদস্যও ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। মিয়ানমার সেনা, পুলিশের ওপর হামলাকারী আরএসও এবং আল-ইয়াকিনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন সম্পর্ক নেই দাবি করেছে বিজিবির বিভিন্ন সূত্র। মিয়ানমারে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ নতুন ঘটনা নয়। সর্বশেষ মিয়ানমারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগাতার অভিযানের মুখে গত শুক্রবার বিকেল থেকে রোহিঙ্গারা নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন ফাঁকফোকরে প্রায় ৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে সরকারী পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি জানান, এটি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতির ব্যাপার। কোন পক্ষ এককভাবে চাইলেই এর সমাধান করা যাবে না। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সার্বক্ষণিকভাবে সরকারের উঁচু মহলকে অবহিত করা হচ্ছে। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে উখিয়া হয়ে বান্দরবানের নেত্রাংছড়ি পর্যন্ত ১০-১৫টি পয়েন্ট রয়েছে। যেখানে সীমান্ত থেকে লোকালয়ের দূরত্ব মাত্র কয়েকশ গজ। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হলে রোহিঙ্গারা হেঁটে সহজেই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে এবং করছে। তবে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের ব্যাপক নজরদারি কারণে এবার যত্রতত্র সুবিধা করতে পারছে না। ইতোমধ্যে বহু রোহিঙ্গাকে পুশব্যাকও করা হয়েছে। এবং তা আরও জোরদার করার নির্দেশনাও রয়েছে। সীমান্তে রোহিঙ্গা কিশোরী ধর্ষণ মিয়ানমারে সহিংসতার মুখে মায়ের সঙ্গে পালিয়ে এসেও বাঁচতে পারলোনা রোহিঙ্গা কিশোরী। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে আশ্রয় নেয়া এক কিশোরীকে স্থানীয় নরপশু ধর্ষণের করেছে। খবর পেয়ে সীমান্তের বিজিবি সদস্যরা ধর্ষক বিল্লালকে গ্রেফতার করে উখিয়া সোপর্দ করেছে। সেন্টমার্টিনদ্বীপ নৌপথে বিজিপির তল্লাশি টেকনাফ-সেন্টমার্টিন দ্বীপ নৌপথে চলাচলকারী ট্রলারগুলোতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী পুলিশ বিজিপি তল্লাশি চালাচ্ছে। তাছাড়া নাফ নদীতে বিজিপি টহল জোরদার করেছে। এতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দাগণের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ নূর আহমদ জানান, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সহিংস ঘটনান পর থেকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিনদ্বীপ নৌপথে চলাচলকারী ট্রলারগুলোতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমার বাহিনী সেদেশের উপকূলে অবস্থান নিয়েছে। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ অভিমুখে ট্রলার দেখলে দ্রুত স্পিডবোট নিয়ে বাংলাদেশ সীমানায় এসে থামিয়ে তল্লাশি চালায়। তিনি আরও জানান, নাফ নদীতে বিজিপি টহল জোরদার রয়েছে। রাতদিন মিয়ানমারের সীমান্তে স্পিডবোট এবং ট্রলার নিয়ে টহল দিচ্ছে তারা। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন দ্বীপ নৌপথে চলাচলকারী ১৮টি যাত্রীবাহী ট্রলার রয়েছে। ট্রলারগুলো প্রতিদিনই টেকনাফ-সেন্টমার্টিন দ্বীপ নৌপথে চলাচল করে। মাঝ পথে বিজিপির তল্লাশির কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দাগণের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুর ইসলাম বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে শুনেছি। দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেয়ার তৎপরতা চলছে। রাখাইনের আকাশে হেলিকপ্টার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে থেমে নেই সে দেশের সেনাবাহিনীর তা-ব। প্রতিদিন একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর। যাকে যেভাবে পাচ্ছে হত্যা করা হচ্ছে নির্মম কায়দায়। এ কারণে রাখাইন রাজ্য থেকে ক্রমাগতভাবে পালিয়ে আসছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। মঙ্গলবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়া পালংখালী ধামনখালী সীমান্ত দিয়ে আসা অসংখ্য রোহিঙ্গা নারীপুরুষের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে। ওই সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে আসা রাখাইন রাজ্যের মাদ্রাসার শিক্ষক মৌলভী জুনায়েদ আহমদ বলেন, আমি ঢেঁকিবনিয়ার মিয়ারপাড়া গ্রামের একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করি। সোমবার হঠাৎ করেই একদল সেনাবাহিনী (তার ভাষায় লুণ্ঠিত বাহিনী) এসে মাদ্রাসা থেকে তাকে আটক করে। মুহূর্তে মাদ্রাসাটি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আমাকেসহ আরও অনেককেই আটক করে একসঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে ধামনখালী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসি। উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারে দেখা মেলে ৬০ বছর বয়সী মেহেরুন্নেছার। তিনি জানান, রাখাইনে আর যাওয়া হবে না। কারণ সেনাবাহিনী পুরো রাখাইনজুড়ে তা-ব চালাচ্ছে। হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে গান পাউডার ছিটানো হচ্ছে। এ কারণে একের পর এক গ্রাম জ্বলে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। রাখাইনের অবস্থা খুবই ভয়াবহ উল্লেখ করে ওই রাজ্যের ঢেঁকিবনিয়া ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ কালুর পুত্র নুরুল ইসলাম জানান, রাখাইনে হয়তো আর বসবাস করা যাবে না। এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন কোথায় যাব, কী করব, ক্যাম্পে গিয়েও কি সহায়তা পাব এ নিয়ে কোন কিছুই চিন্তায় আসছে না। মঙ্গলবার সরেজমিনে সীমান্তের একাধিক পয়েন্ট থেকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আকাশে কিছুক্ষণ পর পর হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে পুনরায় মংডু শহরের দিকে চলে যাচ্ছে। রাখাইনে সহিংসতার পর থেকেই এভাবে হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দেখা গেছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার বিকেলে ঘুমধুম সীমান্তের কাছাকাছি সেদেশের ক্যাম্পে ল্যান্ড করছে একটি হেলিকপ্টার। পরে ওই হেলিকপ্টারটি চক্কর দেয়ার পরপরই সীমান্তের কাছাকাছি রাখাইনের বিভিন্ন জায়গায় আগুনের ধোঁয়া দেখা যায়। শোনা যায় বিকট শব্দের গুলি ও মর্টার শেলের আওয়াজ। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও পি আর বড়ুয়া গণমাধ্যমকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর যে ধরনের হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অমানবিক। পি আর বড়ুয়া আরও বলেন, রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত পরিস্থিতি নিয়ে নিন্দার কোন ভাষা নেই। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারাও মানুষ, তাদের ওপর নির্যাতন চালানো কোনভাবে উচিত নয়।
×