ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চলছে পিঠা পুলির আয়োজন

ভাদ্র মাসের গরমে পাকা তাল, মিষ্টি ঘ্রাণে মাতোয়ারা

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ৩০ আগস্ট ২০১৭

ভাদ্র মাসের গরমে পাকা তাল, মিষ্টি ঘ্রাণে মাতোয়ারা

মোরসালিন মিজান কাওরানবাজারের বিক্রেতা বলছিলেন, ‘দ্যাখেন দ্যাখেন। নাকের কাছে নিয়া দ্যাখেন। তার পর কন ঘ্রাণ কেমন পাইতাছেন?’ ভালই পাওয়া যাচ্ছিল ঘ্রাণ। পাকা তালের মিষ্টি ঘ্রাণ। দূর থেকেই নাকে আসছিল। এর পরও বিক্রেতা একটি তাল সামনের দিকে এগিয়ে দিলেন। কী যে নরম শরীর! হাতে নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে সামান্য টিপে দিতেই নতুন করে ঘ্রাণ ছড়াল। এবার আরও মিষ্টি। আরও টাটকা। চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে, সত্যি বলছি। অবশ্য এমন অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যে অনেকের হয়েছে। হওয়ার কথা। কারণ ভাদ্র মাস যে! তাল পাকা গরম এখন। যথারীতি পেকেছে তাল। গ্রামের হাটবাজারে ফলটি খুব দেখা যাচ্ছে। শহর ঢাকাতেও আসছে প্রতিদিন। অলিতে-গলিতে পাকা তাল সাজিয়ে বসেছেন মৌসুমি বিক্রেতারা। এই তাল মানে তালের রস। নানা রকমের পিঠা। সেই পিঠার উৎসব চলছে ঘরে ঘরে। তালগাছটির কথা বলা যাক আগে। এখনও গ্রামে গিয়ে কারও বাড়ি ঘরের খোঁজ করলে লোকে উঁচু তালগাছের গোলাকার মাথাটি দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ওই যে দেখছেন তালগাছ, তার পেছনের বাড়িটি। কিংবা তার দুই বাড়ি পরে অমুকের বাড়ি। সোজা চলে যান। পথিক তালগাছটিকে মূল নিশানা ধরে সহজেই পৌঁছে যান তার গন্তব্যে। এভাবে শত সহস্র বছর ধরে ঠিকানা চিনিয়ে দেয়ার কাজ করছে তালগাছ। তালগাছ যেখানে, সে জায়গাটিও পরিচিতি পায় তালতলা নামে। সারাদেশে কত যে তালতলা গুনে শেষ করা যাবে না! তালগাছ লিকলিকে গড়নের একলা আর নিঃসঙ্গটি। ওপরের দিকে বাড়ে শুধু। দেখে মনে হয় আকাশ ফুঁড়ে বের হবে! পাম গোত্রের অন্যতম দীর্ঘ এই গাছ উচ্চতায় ৩০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সেই ছড়াটির কথা মনে পড়ে গেল। লম্বা গড়নের কথা উল্লেখ করে কবিগুরু লিখেছিলেনÑ তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে/উঁকি মারে আকাশে।/মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়/একেবারে উড়ে যায়;/কোথা পাবে পাখা সে? পাখা ভাগ্যিস ছিল না! বাংলাদেশের নরম মাটিতে শক্ত পায়ে তাই দাঁড়িয়ে আছে তাল গাছ। বহু বহু কাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আদি নিবাস, কেউ কেউ বলেন, আফ্রিকা। তবে উপমহাদেশীয় বৃক্ষ হিসেবেই স্বীকৃত। বাংলাদেশের মোটামুটি সব এলাকাতেই দেখা যায় তালগাছ। গ্রামে আছে সারি সারি তালগাছ। দেখে কী যে আনন্দ হয়! ধানক্ষেতের পাশে সরু আলপথে, পুকুরের চারপাশে তালগাছ লাগানো থাকে। এ তো গ্রামীণ ঐতিহ্য হয়ে গেছে। শহরেও কমবেশি আছে। রাজধানী ঢাকার উঁচু দালান ভেদ করে বের হয়ে যেতে দেখা যায় গাছটিকে। এমনকি শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের গেটে আছে একটি তালগাছ। তবে ফলের উৎপাদন বেশি ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, গাজীপুর ও খুলনা, রাজশাহী অঞ্চলে। উদ্ভিদবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে তালের অনুমোদিত কোন জাত নেই। বিভিন্ন আকারের তাল হয়। নানা রঙের তাল হয়। বারমাসই হয়Ñ এমন তালও আছে। তবে মূলত পৌষের মাঝামাঝি সময় থেকে চৈত্রের মাঝামাঝি সময় গাছে ফুল আসে। তার পর ফল। অসংখ্য ফল ঘন হয়ে ঝুলে থাকে। ভাল গাছে দুই থেকে আড়াইশ ফল হয়। শ্রাবণ মাস আসলে পাকতে শুরু করে। আর এখন তো আসল সময় ভাদ্র মাস। গাছ থেকে কষ্ট করে পারতে হচ্ছে না। পাকা আর বড় বড় তাল টপাটপ পড়ছে। নিচ দিয়ে আনমনে হেঁটে গেলে মহাবিপদের আশঙ্কা। মাথা ফেটে যাবে নিশ্চিত! তবে গ্রামের দুরন্ত ছেলেমেয়েরা নিজেকে বাঁচিয়ে তাল সংগ্রহ করতে জানে বৈকি। গাছের নিচ থেকে তাল কুড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসে তারা। পরের কাজটুকু মজার বটে। পাকা তাল মাটিতে সজোরে ছুঁড়ে মারা হয়। একের পর এক আছাড় দিয়ে নরম করে নেয়া হয় উপরিভাগ। পরে খোসার ভেতর থেকে তালের আঁটি বের করে আনা হয়। একটি তালে দুই থেকে তিনটি আঁটি থাকে। হাতে নিয়ে এগুলো কচলানো হয়। ক্রিয়া কর্মের আরও কয়েকটি ধাপ আছে। ধাপগুলো ধৈর্যসহকারে অতিক্রম করা গেলে রস পাওয়া হয়। এই রস থেকেই হয় পিঠা পায়েস। তাল পিঠা, তাল বড়া, তাল তেল, তাল রুটি, তালের পায়েস, কলাপাতায় তাল পিঠা, তালের রসভরি- কত কত নাম! পিঠা তৈরি করে নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে পাঠানোর রেওয়াজ চালু আছে এখনও। শহর ঢাকার পরিচিত অনেক ঘরেই আসতে দেখা যাচ্ছে তালের পিঠা। আসছে যথারীতি গ্রাম থেকে। অবশ্য তালের স্বাদ ছাড়াও আছে নানা গুণাগুণ। গবেষণা বলছে, পাকা তালের খাদ্য উপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে জলীয় অংশ রয়েছে ৭৭.২ গ্রাম। খনিজ অংশ ০.৭ গ্রাম। আমিষ ০.৭ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম শর্করা ২০.৭ গ্রাম। ক্যালসিয়াম ৯ মিলিগ্রাম ও খাদ্য শক্তি রয়েছে ৮৭ কিলোক্যালরি। এসব উপদান স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী। এর পর আর তালের সঙ্গে তাল না মেলালে চলে? দামও কিন্তু খুব বেশি নয়। কাওরান বাজারের ওই বিক্রেতা, রনি নাম, বলছিলেন, প্রতিটি পাকা তালের দাম মাত্র ২০ থেকে ৪৫ টাকা। ছোট বড় মাঝারি আকারের তাল। আকার যত বড় দাম তত বেশি। গত ১৫ দিন ধরে পাকা তাল বাজারে আসছে বলে জানান তিনি। বলেন, বেশিরভাগই আসছে নরসিংদী থেকে। একই সময় পাওয়া যাচ্ছে ঘোড়াশাল জামালপুরসহ কয়েকটি এলাকার তাল। তা, বিক্রি কেমন? জানতে চাইলে আরেক ফল ব্যবসায়ী তরুণ সাগর বলেন, এখন তো ধরেন ভাদ্র মাস। তালওই তো খাইবো মানুষ। যারা চিনে হেরা খাইবই। রস দিয়া কত কিছু বানায়া খায়! খেয়েছেন তো? অক্টোবর পর্যন্ত পাওয়া যাবে বটে। এখন উৎকৃষ্ট সময়। খান। স্বাদটা গ্রহণ করুন।
×