ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণ বিতরণ ও আদায়ে অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচকের অবস্থা খারাপ হচ্ছে

সরকারী ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৯ আগস্ট ২০১৭

সরকারী ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সরকারী ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার কোনভাবেই উন্নতি হচ্ছে না। ঋণ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার পাশাপাশি এই ব্যাংকগুলোতে সুশাসন না থাকা এর অন্যতম কারণ। সরকারী ব্যাংকগুলোর বিপর্যয়ের পেছনে অসৎ কর্মকর্তাদের ভূমিকাও কম নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সরকারী ব্যাংকগুলোতে বিদ্যমান খেলাপী ঋণ, প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি বর্তমানে পুরো ব্যাংকিং খাতের জন্য সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রসঙ্গত, বর্তমানে সরকারী মালিকানাধীন ব্যাংকের সংখ্যা আটটি। এর মধ্যে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল)- এই ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বিশেষায়িত খাতের। সরকারী এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, ঋণ বিতরণ ও আদায়ের ক্ষেত্রে অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচকের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। চলমান সংকটে উদ্বিগ্ন হয়ে সরকার সংকট সমাধানের উপায় খুঁজছে। এরই অংশ হিসেবে শনিবার (২৬ আগস্ট) একটি কর্মশালার আয়োজন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ‘রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের অবস্থা পর্যালোচনা: চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায়’ শীর্ষক ওই কর্মশালায় ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণের হালচাল, মূলধন পরিস্থিতি, ঋণ আদায়ের অবস্থা, শীর্ষ খেলাপীদের অবস্থা, লোকসানি শাখার বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। অবশ্য ব্যাংকগুলোর বিপর্যয় নিয়ে এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনে ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতিকেই দায়ী করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও মনে করেন, ‘ব্যাংকারদের কারণেই খেলাপী ঋণ বাড়ছে।’ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের অবস্থা পর্যালোচনা শীর্ষক কর্মশালায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারী ব্যাংকগুলোতে ব্যাংকাররাই ডিফল্ডার তৈরি করেন। এ জন্য ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহকের চরিত্র বিবেচনা করে ঋণ দিতে হবে। কোন ব্যাংকার যখনই ঋণ দেবেন, তখনই তাদের চিন্তা করা উচিত যে, এটা ফেরত আসবে কিনা।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জুন (২০১৭) পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৭৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪০ হাজার ৯৯ কোটি টাকাই সরকারী ব্যাংকগুলোর। মোট খেলাপী ঋণের ৫৪ শতাংশ সৃষ্টি হয়েছে সরকারী মালিকানার আট ব্যাংকের দুর্নীতির কারণে। এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ একটি অনলাইনকে বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির মহোৎসব চলেছে। তার রেশ হয়ত এখনও রয়েছে। সেটি কাটিয়ে উঠতে আমরা চেষ্টা করছি।’ এ প্রসঙ্গে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ বলেন, ‘সরকারী ব্যাংকগুলোর উচ্চ পর্যায়ে জনবল নিয়োগ দেয়ার সময় বিষয়টি খেয়াল রাখা হলে ব্যাংকের অনিয়ম কমতে পারে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘যাদের বদনাম আছে, তাদের এমডি বা শীর্ষ পদে নিয়োগ দিলে দুর্নীতি তো হবেই।’ বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির জন্য ব্যাংকটির সাবেক শীর্ষ ম্যানেজমেন্ট আর পরিচালনা পর্ষদকে দায়ী করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত জুন পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ৫৩ শতাংশই খেলাপী হয়ে গেছে। বিডিবিএলের খেলাপী ঋণ ৫২ শতাংশ, সোনালীর খেলাপী হয়ে যাওয়া ঋণের পরিমাণ ৩৪ শতাংশ, রূপালীর খেলাপী ঋণ ২৭ শতাংশ, অগ্রণীর ২০ শতাংশ, জনতার ১৪ শতাংশ, কৃষি ব্যাংকের ২৩ শতাংশ এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ২৪ শতাংশ ঋণ খেলাপী হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সরকারী ব্যাংকগুলোতে ঋণ আদায় হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, খেলাপী ঋণ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ। ঋণখেলাপী বাড়ায় মূলধনের ঘাটতিতে পড়ছে সরকারী ব্যাংকগুলো। সরকারের মূলধন যোগানের ওপর বর্তমানে এই ব্যাংকগুলোর ভাগ্য নির্ভর করছে। সরকারী ব্যাংকগুলোকে বাজেটের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার মূলধন যোগান দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে মার্চ পর্যন্ত হিসেবে আট ব্যাংকের মধ্যে সাতটিরই মূলধন ঘাটতি রয়েছে। মোট ঘাটতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। কৃষি ব্যাংকের ৭ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা, বেসিকের ২ হাজার ৯৬২ কোটি, সোনালীর ২ হাজার ৫৫৮ কোটি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৭৭৮ কোটি, রূপালীর ৬৩৮ কোটি, অগ্রণীর ৪৪২ কোটি ও জনতা ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে ৭০ কোটি টাকা। এছাড়া সরকারী ব্যাংকগুলোর বিপুল পরিমাণ লোকসানি শাখা রয়েছে। সোনালীর ২৮৫টি, অগ্রণীর ১১৬টি, জনতার ৫৮টি, রূপালীর ৭৪টি, বেসিকের ২৯ ও বিডিবিএলের ১৯টি লোকসানি শাখা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত জুন মাসের শেষে ৬ সরকারী ব্যাংকের খেলাপী ঋণের ৮৯ শতাংশই আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জুনের শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপী ঋণ বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণই ১০ হাজার ২১৩ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপী ঋণের ৮৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। শুধু তাই নয়, মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় আয় দিয়ে পুরো প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি সোনালী ব্যাংক। জুনের শেষে ব্যাংকটির সাত হাজার ৫০ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়েছে চার হাজার ২৪১ কোটি টাকা। এতে প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে দুই হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। গত জুন মাসের শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপী ঋণ বেড়ে হয়েছে চার হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণই প্রায় সাড়ে ৮৮ শতাংশ বা চার হাজার ২০১ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে এক হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের সাড়ে ৮৪ শতাংশ খেলাপী ঋণই মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। জুনের শেষে ব্যাংকটিতে চার হাজার ৯০৪ কোটি টাকা খেলাপী ঋণের চার হাজার ১৩০ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপী ঋণের প্রায় শতভাগই মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। জুনের শেষে ব্যাংকটির সাত হাজার ৩৯০ কোটি টাকার খেলাপী ঋণের মধ্যে সাত হাজার ৮৬ কোটি টাকাই মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে, যা মোট খেলাপী ঋণের প্রায় ৯৬ শতাংশ। ব্যাংকটির এ সময়ে প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে তিন হাজার ৮০ কোটি টাকা। সমস্যা কবলিত ব্যাংক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) ৭৬৪ কোটি টাকার খেলাপী ঋণ। এর মধ্যে ৮৮ ভাগই মন্দ ঋণ। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোন ঋণের কিস্তি পরপর তিন মাস আদায় না হলে ওই ঋণকে নিম্নমানের ঋণ বলা হয়। আবার কোন ঋণ পরপর ছয় মাস আদায় না হলে তাকে সন্দেহজনক ঋণ বলা হয়। সন্দেহজনক ঋণ ৯ মাস অতিক্রান্ত হলে তাকে মন্দ ঋণ বলা হয়।
×