ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও ৫ উইকেট, ৯ টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে ৫ উইকেট নেয়ার নতুন ইতিহাস

অনন্য উচ্চতায় সাকিব

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৯ আগস্ট ২০১৭

অনন্য উচ্চতায় সাকিব

মোঃ মামুন রশীদ ॥ রাতভর সবার মাথায় ভর করে ছিলেন স্টিভেন স্মিথ। বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া দল, ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকরা এবং ক্রিকেট বিশ্লেষকরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন তাকে নিয়ে। কারণ মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম টেস্টের প্রথমদিন শেষে বিপদগ্রস্ত অসিদের ত্রাণকর্তা হিসেবে তাকেই মনে করেছেন সবাই। তবে দ্বিতীয়দিনের শুরুতেই সবাইকে নির্ভার করে দিয়েছেন বাংলাদেশের স্পিন নির্ভরতা মেহেদি হাসান মিরাজ। স্মিথকে সরাসরি বোল্ড করে ভারমুক্ত করেছেন স্বাগতিকদের। এরপর ম্যাট রেনশ ও পিটার হ্যান্ডসকম্ব দারুণ এক জুটি গড়ে অসিদের অবস্থান দৃঢ় করছিলেন। হ্যান্ডসকম্বকে তাইজুল ইসলাম ফেরানোর পর স্পিন ভেল্কি দেখাতে শুরু করেন সাকিব। তার ঘূর্ণি মায়াজালে সবমিলিয়ে ৫ ব্যাটসম্যান সাজঘরে ফেরেন। এর ফলে অনন্য এক রেকর্ডের মালিক হয়েছেন সাকিব। ৯ টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিরুদ্ধেই ৫ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব দেখালেন। এর আগে ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র তিন বোলারের এই রেকর্ড থাকলেও সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন সাকিব বিরল এক কীর্তি দেখিয়ে। সবচেয়ে কম টেস্ট খেলে তিনি সবগুলো টেস্ট খেলুড়ে দেশের পক্ষে ৫ উইকেট নেয়ার অভূতপূর্ব ঘটনার জন্ম দিয়েছেন সাকিব। যদিও বর্তমানে টেস্ট দল বেড়েছে- কিন্তু আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তান এখন পর্যন্ত কোন টেস্ট ম্যাচই খেলেনি। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক দ্বিতীয়দিন ব্যাট হাতে কি করবেন সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়। কারণ তার ব্যাটিং নৈপুণ্য উপমহাদেশে বরাবরই বেশ ভাল। বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানও তিনি। তাই বাংলাদেশ দল যেমন তাকে নিয়ে প্রথমদিন শেষে সমীহ প্রকাশ করেছিল, তেমনি অস্ট্রেলিয়াও দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়লেও অধিনায়কের ব্যাটের দিকে তাকিয়ে ছিল আস্থা নিয়ে। কিন্তু মাত্র ৩ ওভার তাকে টিকতে দিয়েছেন স্পিন বিস্ময় মিরাজ। স্মিথ দ্রুত ফিরে যাওয়ার পর রেনশ’ আর হ্যান্ডসকম্ব জুটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে বাংলাদেশের। পঞ্চম উইকেটে ৬৯ রান তুলে ফেলেন তারা। ওই সময় একমাত্র জেনুইন স্পিনার তাইজুল ইসলাম আঘাত হেনে ফিরিয়ে দেন হ্যান্ডসকম্বকে। ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ের সুতো দিয়ে জাল বুনতে থাকা অসিদের দৃঢ়তায় ছেদ পড়ে। এরপর থেকেই জ্বলে ওঠেন সাকিব। তার বাঁহাতি ঘূর্ণির ইন্দ্রজালে প্রথম ফাঁদে পড়েন রেনশ। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিলেন এ ওপেনার। এরপর উইকেটরক্ষক ম্যাথু ওয়েডকে অবশ্য মিরাজ ফিরিয়েছেন দ্রুতই। আরেক আঘাত হেনে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে শিকার করেন সাকিব। জমে ওঠেন ঘূর্ণি জাদুর প্রদর্শনী। কিন্তু এ্যাশটন এ্যাগার ও প্যাট কামিন্স বিরক্তির উদ্রেক করে অস্বস্তিতে ফেলেন বাংলাদেশী বোলারদের। নবম উইকেটে ৪৯ রানের জুটি গড়ে তারা হতাশায় ফেলেন স্বাগতিকদের। কিন্তু আবারও ত্রাণকর্তা হয়ে আসেন সাকিব। চা বিরতির পরই ৯০ বলে ২৫ করা কামিন্সকে বোল্ড করে সাজঘরের পথ দেখান তিনি। পাঁচ উইকেট শিকারের গন্ধ পেয়ে যান তখনই। সেজন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। জশ হ্যাজলউডের উইকেট শিকারের মধ্য দিয়ে সাকিব ঢুকে যান ইতিহাসের পাতায়। ৮ দেশের বিপক্ষে হয়ে গিয়েছিল আগেই। বাকি ছিল কেবল অস্ট্রেলিয়া। হয়তো অনেক আগেই সেটা হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু হয়নি কারণ সাকিবের সুযোগই হয়নি অসিদের বিরুদ্ধে টেস্ট খেলার। ১১ বছর অপেক্ষার পর অবশেষে অসিদের ঘরের মাটিতে টেস্ট অঙ্গনে মখোমুখি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ দল। অপ্রাপ্তিটা বেশি আর দীর্ঘায়িত হতে দিলেন না সাকিব। অপূর্ণতা ঘোচালেন প্রথম সুযোগেই। মিরপুর টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসেই নিলেন ৫ উইকেট। ২৫.৫ ওভারে ৭ মেডেন দিয়ে ৬৮ রানে ৫ উইকেট। দুর্দান্ত একটি স্পেল। তার কারণেই শেষ পর্যন্ত অসিরা ২১৭ রানে গুটিয়ে যাওয়াতে লিড নিতে পেরেছে বাংলাদেশ দল। সবগুলো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব মাত্র তিনজন বোলারের ছিল এর আগে। শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি অফস্পিনার মুত্তিয়া মুরলিধরন, দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার ডেল স্টেইন ও লঙ্কান বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার রঙ্গনা হেরাথের। অর্থাৎ বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে সবগুলো টেস্ট দলের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখালেন সাকিব। আর এশিয়ার তৃতীয় বোলার হিসেবে এমনটা করলেন তিনি। তবে একটা জায়গায় সাকিব সবাইকে ছাড়িয়ে নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন। সেটাও এক বিশ্বরেকর্ড। ৯ দেশের বিপক্ষে ৫ উইকেট নিতে আগের ৩ জনেরই খেলতে হয়েছে সাকিবের চেয়ে বেশি টেস্ট। মুরলিধরনের লেগেছিল ৬৬ টেস্ট, স্টেইন ও হেরাথের লেগেছে ৭৫টি করে টেস্ট। সাকিব সেই অনন্য কীর্তি গড়লেন ক্যারিয়ারের মাত্র ৫০তম টেস্টে নেমেই। সবকয়টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে ৫ উইকেটের রেকর্ড হিসেবে বলা যেত কিছুদিন আগেও। তবে গত জুনে টেস্ট মর্যাদা পেয়েছে আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তান। অবশ্য এখন পর্যন্ত কোন টেস্ট ম্যাচই খেলেনি তারা। সাকিব প্রথমবার ৫ উইকেটের দেখা পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের ৭ম টেস্টে। অথচ প্রথম ৬ টেস্টে তাকে বোলার হিসেবে চেনাই যায়নি। কারণ ওই ৬ টেস্টে নিতে পেরেছিলেন মাত্র ৩ উইকেট। ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রামে ৭ উইকেট পান ৩৬ রানে। সেই থেকে এবার নিয়ে ইনিংসে ৫ উইকেট পেলেন ১৬ বার। সবচেয়ে বেশি তিনবার ৫ উইকেট নিয়েছেন জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে। ২ বার করে নিয়েছেন ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে পেয়েছেন ১ বার করে। ঘরের মাটিতে একেবারেই অদম্য সাকিব। তার বিরুদ্ধে বিদেশী দলগুলো কতটা অসহায় সেটা পরিসংখ্যানই বলে দেয়। কারণ ক্যারিয়ারে যে ১৬ বার ৫ উইকেট পেয়েছেন তার মধ্যে ১২ বারই নিয়েছেন দেশের মাটিতে, দেশের বাইরে পেয়েছেন মাত্র ৪ বার। সেটাও কম অর্জন নয়। কারণ পেসবান্ধব উইকেটে ৫ জন ব্যাটসম্যানকে শিকার করা কঠিন ব্যাপার। তিনি এ কৃতিত্ব ২ বার দক্ষিণ আফ্রিকায়; ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ডে ১ বার করে দেখিয়েছেন। এখন অপেক্ষা শুধু আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট শিকারের। যেভাবে এগিয়ে চলেছেন তাতে করে ৩০ বছর বয়সী এ বাঁহাতির খুব বেশি সময় হয়তো লাগবে না।
×