ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোটাতাজা গরু কিনতে সাবধান!

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৯ আগস্ট ২০১৭

মোটাতাজা গরু কিনতে সাবধান!

শংকর কুমার দে ॥ সাবধান! ‘বাহবা’ কিংবা ‘প্রশংসা’ কুড়ানোর জন্য অনেকেই পবিত্র ঈদ-উল-আযহায় কোরবানির জন্য মোটাতাজা গরু বা পশু কেনেন। মোটাতাজা দেখলেই কিনবেন না। কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরু বা পশু কিনলে ঠকতে পারেন। অতি মুনাফালোভী পশু ব্যবসায়ীরা এবারের পশুর হাটগুলোতে নিয়ে এসেছে প্রচুর মোটাতাজা গরু, মহিষ ও পশু। রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া এক শ্রেণীর ধনাঢ্য ব্যক্তি বাহবা ও প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কিনে আনছেন মোটাতাজা গরু বা পশু। মোটাতাজা গরু বা মহিষ কেনার আগে ভাল করে দেখেশুনে, পরীক্ষা করে বাজিয়ে নিন, সুস্থ কি-না। নতুবা শুধু ঠকাই নয়, কোরবানিটাও মাঠে মারা যেতে পারে। মোটাতাজা গরু বা পশু কেনার বিষয়ে সতর্ক ও সাবধান করে দিয়েছেন পশু চিকিৎসকগণও। পশুর হাটগুলোতে সরেজমিন ঘুরে এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করেছেন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, এবারের পবিত্র ঈদ-উল-আযহাকে সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন পশুর হাটে প্রচুর মোটাতাজা গরু, মহিষ ও পশু আমদানি হওয়ার খবর পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিপুলসংখ্যক মোটাতাজা পশুর আমদানির বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। অভিমত সংগ্রহ করেছেন পশু চিকিৎসগনের। অতি মুনাফালোভীরা কিভাবে গরু বা পশুকে মোটাতাজা করছে এবং ক্রেতাদের আকর্ষণ করে কিভাবে ঠকাচ্ছেন সে বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, মোটাতাজা ‘স্বাস্থ্যবান’ পশু দেখে বাহবা দিচ্ছেন অনেকেই। আবার প্রশংসাও করছেন অনেকেই। কিন্তু ঈদের বা কোরবানির আগে পশু অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। বিপুল অঙ্কের টাকায় কেনা পশু অসুস্থ, এমনকি পশুর মৃত্যুও হতে পারে। কোরবানির মুহূর্তের সময়টা যদি এমন হয়, তখন কী হবে? গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, প্রতি বছর কোরবানির ঈদে পশু কেনা হলেও তা যাচাই-বাছাই করার পারদর্শিতা থাকে হাতেগোনা কিছু মানুষের। ফলে কেউ ভাল পশু কিনতে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে বাড়তি টাকা গোনেন। কেউ আবার অসাধু বিক্রেতার ফাঁদে পড়ে কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা পশু ঘরে আনেন। কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা পশুগুলো অনেক সময় ঈদের আগেই অসুস্থ হয়ে কোরবানির অযোগ্য হয়ে যায়, কিছু পশু মারাও যায়। ফলে ক্রেতার মাথায় হাত পড়ে। একজন পশু চিকিৎসক বলেন, গরু বা মহিষ মোটাতাজা করার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি রয়েছে। এ পদ্ধতিতে ইউরিয়া, চিটাগুড়, খড় মিশিয়ে গরুকে খাওয়ানো হয়। মোটাতাজা করতে চার থেকে পাঁচ মাস সময় নেয়। তবে ঈদের বাজারে ভাল দাম পেতে তিন সপ্তাহ থেকে দুই মাসের মধ্যে গরুকে মোটা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করেন অনেক ব্যবসায়ী। ওষুধ বা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে গরু আসলে মোটাতাজা হয় না। বরং শরীরে পানি জমে যাওয়ার কারণে হৃষ্টপুষ্ট দেখায়। এসব ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্য গরুর শরীরের স্বাভাবিক বিপাক প্রক্রিয়া নষ্ট করে। এ রকম মোটাতাজা করা গরু চেনার উপায় সম্পর্কে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ হচ্ছে- স্বাভাবিকভাবেই গরু বা পশুর গায়ে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিলে মাংস একটু দেবে যায়। সুস্থ গরুর ক্ষেত্রে এ চাপ ছেড়ে দিলেই মাংস স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে কৃত্রিম প্রক্রিয়ার মোটাতাজা করা গরুর গায়ে আঙ্গুলের চাপ দিলে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বেশি সময় নেবে। পাশাপাশি দেখতে হবে গরু চটপটে কি-না। শরীরে পানি জমার কারণে কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরুগুলো এক জায়গায় বসে থাকে, নড়াচড়া কম করে। সাধারণত ছাগল বা অন্য পশুর চেয়ে গরুর ওপরেই এ ধরনের মোটাতাজা প্রক্রিয়া চালানো হয়। তবে মহিষের ওপরও মোটাতাজা করার প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। সুতরাং এ রকম গরু সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক থাকার জন্য পরামর্শ দেন পশু চিকিৎসকগণ। পশু চিকিৎসকদের অভিমত হচ্ছে, কোন গরুকে ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছে কি-না তা নিশ্চিত হতে গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দেখতে হবে। ট্যাবলেট খাওয়ানো গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়। মনে হবে যেন হাঁপাচ্ছে আর প্রচ- ক্লান্ত দেখায়। পাশাপাশি ট্যাবলেট খাওয়ানো গরুর গায়ে পানি জমার কারণে মাংস অত্যন্ত নরম হয়ে যায়। এ বিষয়টি নিশ্চিত হতে পেছনের রানের মাংস পরীক্ষা করতে হবে। সুস্থ গরুর রানের মাংস থাকবে শক্ত আর ট্যাবলেট খাওয়ানো গরুর ক্ষেত্রে তা হবে নরম। এ ধরনের গরুর প্রস্রাবের পরিমাণও কমে যায়। হাটের যে চকচকে চামড়ার গরু আপনার নজর কাড়ছে সে গরুই ট্যাবলেট প্রয়োগ করা গরু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মানুষের শরীরের কোন অংশ ফুলে গেলে বা পানি জমলে সে অংশের ত্বক যেমন চকচক করে, ট্যাবলেট খাইয়ে মোটা করা গরুগুলোও তেমনি চকচকে হয়। তাই গরুর স্বাভাবিক উশকোখুশকো চেহারা, চামড়ার ওপর দিয়ে পাঁজরের কয়েকটা হাড় বোঝা যাচ্ছে, এমনটা দেখেই কেনা উচিত। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন ডাক্তার বলেন, গরুর ওপর স্টেরয়েড ট্যাবলেটের যে প্রভাব পড়ে, ওই গরুর মাংস খেলে আমাদের শরীরেও একই প্রভাব দেখা যায়। এর মধ্যে আছে শরীরে পানি জমে যাওয়া, মূত্রনালি ও যকৃতের বিভিন্ন সমস্যা, চামড়া পাতলা হয়ে যাওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি। তবে কোরবানির কয়েকদিন এ মাংস খেলেই যে অসুস্থ হয়ে যাবেন তা নয়। শরীর যদি সুস্থ থাকে তাহলে হয়ত ধাক্কাটা সামলে নিতে পারবে। তবে যাদের আগে থেকেই আর্থ্রাইটিস, হাঁপানি ইত্যাদি রোগ আছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে মানুষের ‘বাহবা’ পাওয়ার জন্য মোটাতাজা গরু বা পশু না কেনাই ভাল, দেখেশুনে ভাল ও সুস্থ পশু কেনার চেষ্টা করাই শ্রেয়।
×