স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুনাফালোভী এজেন্সিগুলোর প্রতারণার দরুন শুধু টিকেটের অভাবে শেষ পর্যন্ত ৮১ জন হজে যেতে পারেননি। বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে এসে গত সাত দিন ধরে তারা আশকোনা হজক্যাম্পে অপেক্ষার পর সোমবার শেষ ফ্লাইটেও তাদের পক্ষে সৌদি আরব যাওয়া সম্ভব হয়নি। দিনভর সেখানেই তারা চিৎকার করে বুক চাপড়িয়ে কান্নাকাটি করেন। তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ ছিল না। ধর্মমন্ত্রী, সচিব, মন্ত্রণালয়ের পিয়ন চাপরাশিসহ হজ অফিসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী হজে চলে যাওয়ায় প্রতারিত হজযাত্রীদের আবেদনে সাড়া দেয়ারও কেউ ছিল না। এটা জানতে পেরে ধর্মবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি বজলুল হক হারুণ হজ ক্যাম্পে ছুটে গিয়ে তাদের জন্য শেষ মুহূর্তে টিকেটের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সৌদিয়ার ফ্লাইট জেদ্দায় নামার অনুমতি না পাওয়ায় সে চেষ্টাও বিফলে যায়।
এদিকে এজেন্সিগুলোর প্রতারণার এমন চিত্র দেখে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এ ঘটনায় জড়িত প্রতিটি এজেন্সির লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে হজক্যাম্প থেকেই গতকাল তিনজন দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মন্ত্রী জানান, মক্কা মদিনায় বিলম্বে বাড়ি ভাড়া করা, হঠাৎ মুয়াল্লেম ফি বৃদ্ধি ও ই ভিসা জটিলতার কারণেই এবার বড় সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে বিমান তার ওপর অর্পিত কঠিন দায়িত্ব বেশ আস্থার সঙ্গেই পালন করেছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিমান নিজস্ব কোটার সব যাত্রীর বাইরেও সৌদিয়ার যাত্রী বহন করেছে। এজন্য বিমানের পারফর্মেন্সে খুশি হয়ে প্রধানমন্ত্রী সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।
সোমবার সচিবালয়ে হজযাত্রী পরিবহন কার্যক্রমের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ। তাদের দুজনকেই কঠিন দায়িত্ব পালনের আত্মতৃপ্তিতে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা যায়।
মেনন বলেন, এবার এক লাখ ২৭ হাজার ৫০০ হজযাত্রী পাঠানোর প্রস্তুতি ছিল। সেখানে সরকারীভাবে যাওয়ার কথা ছিল ৪ হাজার ২০০, এজেন্সিরা পাঠাবে এক লাখ ২২ হাজার, আর ডেলিগেট যাবে এক হাজার ২৫০ জন। চুক্তি অনুযায়ী ৫০ ভাগ পাঠাবে সৌদিয়া এয়ারলাইন্স আর বাকি ৫০ ভাগ পাবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সেই হিসাবে বিমান ও সৌদিয়ার ৬৩ হাজার ১২৫ জন করে হজযাত্রী বহনের কথা। এর বাইরে গবর্নমেন্ট ডেলিগেট এক হাজার ২৫০ যাত্রী অতিরিক্ত বহন করেছে। এটা একটা বড় ধরনের সাফল্য। এজন্য বিমানকে সিডিউল ফ্লাইটের ওপর অনেক ধকল গেছে।
মন্ত্রী বলেন, বিমান ৬৪ হাজার ৮৭৩ জন যাত্রী বহন করেছে। সৌদিয়া ৬২ হাজার ২৩০ যাত্রী পরিবহন করেছে, যেখানে তাদের ৬৩ হাজার ১২৫ জন পাঠানোর কথা ছিল। বিমান ও সৌদি মিলিয়ে ১ লাখ ২৭ হাজার ১০৩ হজযাত্রী পাঠিয়েছে। আর ৩৯৭ জন রয়েছেন যাদের সবারই ভিসা হয়নি, কিংবা তারা পাসপোর্ট বা টিকেট করেনি, তারা রয়ে গেছেন, তারা আমাদের হিসাবের মধ্যে আসেনি। কাজেই বলা যায়- এবার মোট ৩৯৭ জন হজে যেতে পারেননি।
কান্না থামেনি তাদের
বাড়ি থেকে সবার কাছে বিদায় নিয়ে এসেছি হজে যাচ্ছি বলে। কিন্তু হজে যাওয়া নিয়েই অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছি। এখন আমি কোন মুখ নিয়ে ফিরে যাব? আশকোনার হজ ক্যাম্পে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর আব্দুল মান্নান। ২১ আগস্ট থেকে তিনি হজ ক্যাম্পে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। হজের ভিসা পেলেও রাজশাহীর আতাউর রহমান নামের এক দালালের মাধ্যমে টাকা জমা দেয়া আব্দুল মান্নান পাননি সৌদি আরবের উড়োজাহাজের টিকেট।
হজে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি হজ ক্যাম্পে থাকা এসব হজযাত্রীর রাজশাহীর আব্দুল মান্নানের মতোই আরও অনেক হজযাত্রীই হজ ক্যাম্পে হজ পরিচালকের দরজায় এখনও ভেজা চোখে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা এখনও জানেন না হজে যেতে পারবেন কিনা। সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোও ফোন ধরছেন না হজযাত্রীদের। এখনও পর্যন্ত হজ ক্যাম্পে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে একশটি। কিন্তু ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বজলুল হক হারুন যখন তাদের জন্য প্রিমিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় টিকেট নিশ্চিত করেন তখন তিনি মাত্র ৪৮ জনের পাসপোর্ট পান।
হজে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন হজ ক্যাম্পে থাকা যশোরের বারাকাত উল্লাহ। তার সঙ্গে রয়েছেন আরও দুজন। তারা শুক্রবার থেকে অপেক্ষা করছেন হজ ক্যাম্পে। রবিবার রাতেও ওলামা আউলিয়া হজ গ্রুপ নামের এজেন্সি তাদের জানিয়েছে যে তারা হজে যেতে পারবেন। কিন্তু সোমবার সকাল থেকেই এজন্সির কেউ ফোন করছেন না বলে অভিযোগ করেন বারাকাত উল্লাহ।
হজ ক্যাম্পে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করছেন হজযাত্রীরা, সোমবার এমন অভিযোগ জমা পড়েছে একশটি। তাদের পাশেই রয়েছেন নূরে আলম সিদ্দিকিসহ ১৬ জন হজযাত্রী। তারাও জানেন না তাদের হজফ্লাইট কয়টায়। খুঁজে পাচ্ছে না হজ এজেন্সি আল সাফা এভিয়েশনের কাউকেই। তাদের মতো অবস্থা আব্দুল মান্নানসহ আরও ৯ হজযাত্রীর। তারা ইকো এভিয়েশন এ্যান্ড ট্যুরিজম নামের একটি হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। ওই সময় হজ ক্যাম্প থেকে তিন দালালকে আটক করেছে পুলিশ। এরা হলো আতাউর রহমান, সুমনা ও ফরিদুর রহমান।
সংসদীয় কমিটির আশ্বাস
দুপুরে ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বজলুল হক হারুণ আশকোনা ক্যাম্পে গিয়ে আটকে পড়া হজযাত্রীদের খোঁজ খবর নেন। তিতি তাদের সবার সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, যেসব এজেন্সির গাফিলতিতে ভিসা পাওয়ার পরও হজযাত্রীরা সৌদি আরব যেতে পারেননি তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করা হবে।
এ সময় ভুক্তভোগী হজযাত্রীরা তাকে ঘিরে ধরে কান্না শুরু করেন। তখন তাৎক্ষণিক তিনি সবার পাসপোর্ট জমা দিতে বললে মাত্র ৪৮ জন পাসপোর্ট জমা দিতে সক্ষম হন। বাকিদের কোন খোঁজ মিলেনি। তিনি এসব পাসপোর্ট নিয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে টিকেটের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ওই সময় সৌদিয়া এয়ার থেকে জানানো হয়, তাদের পরবর্তী ফ্লাইটটা হচ্ছে ঢাকা থেকে সরাসরি রিয়াদ। ওই ফ্লাইট জেদ্দায় যাওয়ার কোন অনুমতি দেয়া হয়নি। এমন সংবাদ পেয়ে হজযাত্রীরা সেখানেই আবার কান্নœায় ভেঙ্গে পড়েন। এ সময় বজলুল হক হারুণ বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। টিকেটেরও ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু সৌদি আরব থেকে কোন অনুমতি না পাওয়ায় সব চেষ্টা বিফলে গেল। তবে আগামী বছর আপনাদের ৮১ জনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাঠানো হবে। এতে কোন ব্যত্যয় ঘটবে না।
এ ব্যাংকগুলোর গাফিলতির প্রসঙ্গে বিএইচ হারুন এমপি বলেন, আগের বছরগুলোর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা নিয়ম করেছিলাম উড়োজাহাজের ভাড়ার টাকা এজেন্সির কাছে থাকবে না, ব্যাংকে জমা হবে। কিন্তু এ বিষয়ে কিছু ব্যাংকের গাফিলতির কারণে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: