ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নৌকা দেখলেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসে ব্রহ্মপুত্রপারের মানুষ

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ২৯ আগস্ট ২০১৭

নৌকা দেখলেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসে ব্রহ্মপুত্রপারের মানুষ

ওয়াজেদ হীরা ॥ তখনও পাড়ে ভেড়েনি শ্যালো নৌকাটি। ইঞ্জিনের শব্দে মুহূর্তের মধ্যে শত শত নারী-পুরুষ জমায়েত হয়ে গেছে। বাদ যায়নি বৃদ্ধ ও স্কুলপড়ুয়া শিশুরাও। সবাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নৌকার দিকে। অপেক্ষায় আছে কেউ বুঝি তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে সেই আশায়। জমায়েত হওয়া মানুষগুলো সবাই বানের জলে ঘরবাড়ি হারানো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। নৌকা দেখলেই মনে করে কেউ হয়ত ত্রাণের সহায়তা নিয়েছে তাদের জন্য। এটি কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের প্রত্যাহিক চিত্র। শুধু নয়ারহাট নয় একই দৃশ্য দেখা গেছে অষ্টমীরচর ইউনিয়নেও। উপজেলায় চিলমারী, নয়ারহাট, অষ্টমীরচরসহ ৬ ইউনিয়ন কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। পানি কমে যাওয়ায় ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে বন্যার ক্ষতির চিহ্নগুলো। এক সপ্তাহের বেশি সময় পানিতে ভেসেছে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা। শুধু কি চিলমারী নয় কুড়িগ্রামের প্রত্যেকটি উপজেলাই হয়েছে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মারা গেছে ২৩ জন। বন্যার পানি এ এলাকার বাসিন্দাদের স্বপ্নও ভাসিয়ে দিয়েছে। তবুও জীবন যুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বন্যার্ত মানুষগুলো। চরের বাসিন্দা শাজাহান (৫০) বলেন, ‘কি খামু, আর কি করুম, থাকমই বা কই। বাড়ি ভাসাই নিছে ঐ নদী’ হাত দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ দেখিয়ে দু’চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলেন তিনি। দীর্ঘদিনের বাড়িটি বন্যার পানিতে। পরিবার দিন কাটাচ্ছে অন্যের বাড়িতে। খাওয়ার চেয়ে থাকার চিন্তাই তার আগে। শাজাহানের মতো রাজ্জাক, হাসমত আলী, রাবেয়া বেগমদের দিন রাত শুধু ভাবতে ভাবতেই চলে যাচ্ছে। ধরলা, তিস্তা আর ছোট ছোট শাখা নদীগুলোও এসে মিলেছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে। ব্রহ্মপুত্রের তীব্র স্রোতে যোগ হয় উজানের অথৈ পানি। ভাসিয়ে দিয়ে যায় গোটা কুড়িগ্রাম। আর বন্যার পানিতে ক্ষত-বিক্ষত জনপদ। ল-ভ- হয়েছে গ্রামীণ অবকাঠামো। বন্যার ক্ষতগুলো স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির তালিকাও। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বানে শুধু ঘরবাড়িই নয়, স্কুল-কলেজ, কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা মসজিদ-মাদ্রাসাও হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। বিলীন হয়ে গেছে রাস্তাঘাটও। ভেঙ্গে গেছে একাধিক সেতু-কালভার্ট। বাদ যায়নি রেললাইনও। গত ১২ দিন পূর্বেও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৮৭ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সেই ব্রহ্মপুত্রের পানি কমেছে। তবে পানি বেড়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা এখন স্পষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে বানভাসিরা চালাচ্ছে জীবন সংগ্রাম। যেখানে সরকারের পর্যাপ্ত সহযোগিতা ও ত্রাণের ব্যবস্থা থাকলেও বানভাসিরা আর কতটুকুই বা পাচ্ছেন সেটা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। সরকারী ত্রাণের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও যাচ্ছে অসংখ্য সহযোগিতা, তবে বন্যার্ত মানুষ বলছে, যে পাচ্ছে সে একাধিকবার আবার কেউ আবার একবারও পাচ্ছে না। পর পর দুই দফা বন্যায় কুড়িগ্রামের ৯ উপজেলায় পাকা ও কাঁচা সড়ক ভেঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাও স্থবির। বর্তমানে পানি কমার পর দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, জ্বালানি ও গো-খাদ্যের চরম সংকট। চিলমারীর রমনা ইউনিয়নের বাসিন্দা হাসমত আলী জানান, পানি বাড়লে স্ত্রী ও নাতিকে নিয়ে উঠেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে। এখন পানি কমলেও খাবারে সংকট আছে। সদ্য রোপণকৃত রোপা আমন ধান, বীজতলা ও শাকসবজি পানিতে নিমজ্জিত হয়ে মরে গেছে। বন্যার পানি পুকুরে ঢুকে পড়ায় মৎস্য চাষীরাও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার মোট ৯৩ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫০ স্কুলে পানি ঢুকে পড়ায় স্কুলগুলোয় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। উপজেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, ৪৮০০ হেক্টর সদ্য রোপণকৃত রোপা আমন ধান, ১৭৮ হেক্টর বীজ তলা, ২১০ হেক্টর শাকসবজি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে এলেও সে আনন্দ নেই কুড়িগ্রামের মানুষের মধ্যে। জেলার নয়টি উপজেলাই ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে বন্যার পর থেকে তিন উপজেলার সঙ্গে এখনও সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলা। সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল বরকত মোঃ খুরশীদ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘রাস্তাগুলো এখনো ঠিক হয়নি। রাস্তা পুরো ডুবে গিয়েছিল। পানি কমার পর আমরা কাজ শুরু করেছি। আশা করছি ঈদের আগে কিছুটা ঠিক করতে পারবো।’ জানা গেছে, তিন উপজেলার যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারনে ঐসব অঞ্চলে ত্রাণ সুবিধাও পৌঁছাতে পারছে না ঠিকমতো। এদিকে বন্যার পানি নেমে গেলে বাঁধ ও পাকা সড়কে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলো ভিটে-মাটিতে ফিরে সব হারানোর দৃশ্য দেখে শুধুই আর্তনাদ করছে। কোন কোন পরিবারের বাড়ির জায়গায় এখন অথৈ পানি। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও ভেসে যাওয়া পরিবারের সংখ্যাই প্রায় শতাধিক। এছাড়া সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের চর সারডোব গ্রামেও ভেসে যাওয়া ও বিধ্বস্ত হওয়া বাড়ির সংখ্যা প্রায় অর্ধশতর বেশি। যাত্রাপুর ইউনিয়নের ময়না বেগমের বাড়ির জায়গায় শুধু নলকূপটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সব হারিয়ে এখন সন্তাদের বাঁচানোর তাগিদে ছুটে বেড়াচ্ছেন ত্রাণের আশায়। সরকারী ত্রাণের পাশাপাশি অব্যাহত আছে বেসরকারী ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী কুড়িগ্রামে সম্প্রতি ত্রাণ দিয়ে এসেছেন। এছাড়াও মাত্র দুদিন আগেই শুধু চিলমারীতেই ১৬০০ পরিবারকে প্রায় চার লাখ টাকার ত্রাণ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে গাজীপুর মহানগরের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রায় ৫০ জন নেতাকর্মী চরগুলোতে ঘুরে ঘুরে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে হাতে দিয়ে যায় খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ।
×