ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিড়ম্বনার অপর নাম ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ॥ ৬ ঘণ্টার পথ পেরোতেই ১৬ ঘণ্টা

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ২৯ আগস্ট ২০১৭

বিড়ম্বনার অপর নাম ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ॥ ৬ ঘণ্টার পথ পেরোতেই ১৬ ঘণ্টা

রাজন ভট্টাচার্য/ইফতেখারুল অনুপম ॥ টানা বৃষ্টি আর বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঢাকা-টঙ্গাইল মহাসড়ক। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা বলছেন, টঙ্গী থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত পুরো মহাসড়কের অবস্থা নাজুক। সড়কে ছোট বড় অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। পিচ ওঠে বেড়িয়ে গেছে ইটের মাথা। অনেক পয়েন্টে জমে আছে পানি। দেখে বোঝার কোন উপায় নেই এটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি মহাসড়ক! এই পরিস্থিতিতে গাড়িও চলছে ধীর গতিতে। প্রতিদিন যানজটের ভোগান্তি তো আছেই। তাই ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন উত্তরাঞ্চলের যানবাহনগুলোকে ছয় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগছে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদ কেন্দ্র করে মহাসড়কে দিন দিন গাড়ির চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে পশুবাহী ট্রাক আসছে রাতদিন। অথচ মহাসড়কে নসিমন, করিমন, ভটভটি, ব্যাটারিচালিত বাইক, অটোরিক্সা, লেগুনাসহ নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। উচ্ছেদ হয়নি সড়কের পাশে থাকা বাজারসহ অবৈধ স্থাপনা। নতুন উপদ্রব হিসেবে সড়কের পাশে পশুর হাট বসতে শুরু করেছে। পরিবহন নেতারা জানান, ঈদে দুর্ভোগমুক্ত যাত্রা নিশ্চিত করতে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই মহাসড়কের সংস্কার কাজ যে কোন মূল্যে শেষ করতে হবে। অযান্ত্রিক ও নিষিদ্ধ যানবাহন সড়কে উঠতে দেয়া যাবে না। পুরোপুরি ফোরলেন নির্মাণের কাজ বন্ধ করতে হবে। সরিয়ে নিতে হবে রাস্তার ওপর রাখা নির্মাণ সামগ্রীও। বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনসহ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এরকম ব্যবস্থা নেয়া হলে কোনরকম গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা হবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে এই মহাসড়কে গাড়ি চলাচলের আশাও করছেন না পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও যাত্রীরা। গত ৯ আগস্ট সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আকস্মিকভাবে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক পরিদর্শনে যান। সেখানে গিয়ে ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে সড়ক সংস্কারে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মন্ত্রীর বেঁধে দেয়া সময় শেষ হয়েছে। কিন্তু সড়ক সংস্কারের কাজ শেষ হয়নি। যদিও রবিবার মন্ত্রী ঢাকার বাইরে আরেকটি অনুষ্ঠানে দেশের সকল সড়ক মহাসড়ক সংস্কারে নতুন করে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছেন। টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নুর-ই-আলম জানান, মন্ত্রী মহোদয় ১০ দিনের মধ্যে মহাসড়ক চলাচল উপযোগী করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা বৃষ্টির কারণে এই সময়ের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করতে পারিনি। এরই মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে। যতটুকু দরকার ঘরমুখো মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের জন্য ততটুকু সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনে টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নুর-ই-আলমের কথার মিল পাওয়া যায়নি। টাঙ্গাইল থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে সংস্কার কাজ করতে দেখা যায়। টাঙ্গাইল শহর বাইপাস থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন স্থানে সবচেয়ে বেহাল সড়কটির সদর উপজেলার বিক্রমহাটি ও রসুলপুর, কালিহাতী উপজেলার পৌলী, এলেঙ্গা এলাকাও বেহাল। এসব এলাকায় সংস্কারের কাজ করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। বেশ কয়েকজন গাড়ি চালক জানান, ঈদ সামনে রেখে গরুবাহী ট্রাকসহ যানবাহন চলাচল বেড়ে গেছে। আর এর মধ্যে সংস্কার কাজের কারণে মাঝে-মধ্যেই যানজট হচ্ছে। এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে নারায়ণগঞ্জ থেকে জামালপুরগামী বাসের চালক হুমায়ুন কবির জানান, রাস্তা সংস্কারের কারণে এখন যানজটে পড়তে হচ্ছে। এরই মধ্যে যানবাহনের চাপ বেড়ে গেছে। যানজট তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পৌলী এলাকায় ট্রাক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক চালক জানান, রাস্তা খারাপ থাকার কারণে নির্ধারিত সময়ে তারা গন্তব্যে পৌঁছতে পারছেন না। ঈদের সময় এ দুর্ভোগ আরও বেড়ে যাবে বলে তারা মনে করেন। ঢাকা থেকে বগুড়াগামী কয়েক বাসযাত্রী জানান, এখনই যানজটের যে অবস্থা, যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে যাত্রীদের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে। রাজশাহীগামী দেশ ট্রাভেল্সের যাত্রী জাহাঙ্গীর আলম জানান, আরও আগেই মহাসড়ক মেরামতের কাজ হাতে নেয়া উচিত ছিল। টাঙ্গাইল জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মীর লুৎফর রহমান লালজু জানান, ঈদের সামনে যানবাহন চলাচল অনেক বেড়ে যায়। এবার রাস্তার যে অবস্থা তাতে যাত্রী সাধারণের ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মাহবুব আলম জানান, ঈদের আগে মানুষের যাতে যানজটে দুর্ভোগ পোহাতে না হয় সেজন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার (এসপি) মাহবুব আলম বলেন, মহাসড়কের যানজট নিরসনে এবারের ঈদে সাড়ে ৭ শতাধিক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৫টি মোবাইল পেট্রোল, ৪৫টি পিকেসহ মোটরসাইকেল টিম রয়েছে। এছাড়া মহাসড়কের টাঙ্গাইল অংশের পাশে মির্জাপুরের দেহাটায় একটি গরুর হাট রয়েছে। এই গরুর হাটে আমাদের বিশেষ টিম মোতায়েন করা হয়েছে। আশা করছি গত ঈদের মতো এবারের ঈদে মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হবে না। স্বস্তিতেই মানুষ বাড়ি যেতে পারবেন। মহাসড়কের সার্বিক চিত্র মহাখালী আন্তঃজেলা পবিহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক জনকণ্ঠকে বলেন, টঙ্গী থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত পুরো সড়কের অবস্থাই বেহাল। একাধিক পয়েন্টের অবস্থা খুব বেশি নাজুক। এই পরিস্থিতিতে দুর্ভোগ অনিবার্য। তিনি বলেন, স্বাভাবিক গতিতে এই সড়কে যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। তবে সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু এলাকায় কোনরকম সংস্কার চলছে। সড়কটিতে কোনরকমভাবে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো, অযান্ত্রিক যানবাহন চলতে না দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা জানান, টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তার পথে গাজীপুরা, তারগাছ, মালেকের বাড়ি, সাইনবোর্ড ও ভোগড়া এলাকায় মেরামত চলছে। ভোগড়া বাইপাসের কাছে সড়ক এখনও ভাঙ্গা। ভোগড়া থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের ভাঙ্গা অংশ ইটের গাঁথুনি দিয়ে উঁচু করা হয়েছে। তবে এখনও সড়কের বিভিন্ন অংশে ছোটবড় ভাঙ্গন। সড়কের এ অংশ এবড়ো-থেবড়ো হওয়ায় যানবাহন চলে ধীরগতিতে। কোনাবাড়ী বাজারের শুরুতে সড়কে অসংখ্য খানাখন্দ। সড়কের বিভিন্ন অংশে পানি জমে আছে। ভেঙ্গে যাওয়া সড়কে ইট বিছিয়ে দেয়া অংশ আবার ভেঙ্গেছে। উড়াল সড়কের নির্মাণকাজের কারণে এক লেনে যানবাহন চলছে। পরিবহন চালকরা জানান, গাজীপুর চৌরাস্তা থেকেই ভাঙ্গা রাস্তা শুরু হয়। ঝাঁকুনিতে গাড়িতে প্রেসার পড়ে বেশি। এজন্য গাড়ির যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে যায়। রাস্তায় অহরহ যানবাহন নষ্ট হয়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। চন্দ্রা বাজার এলাকায় সড়কে ছোটবড় অসংখ্য খানাখন্দ রয়েছে। সড়কের বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে আছে। সফিপুর বাজারেও সড়কে খানাখন্দ আছে। এ বাজারও পার হতে হয় ধীরে ধীরে। চন্দ্রা চৌরাস্তায় সড়ক প্রশস্তকরণ এবং উড়াল সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। এখানে সড়কের খানাখন্দ মেরামত করা হয়েছে। তবে বৃষ্টি হলে আবার সড়ক ভেঙ্গে গেলে ঝামেলা হবে বলে জানান ঢাকা-রংপুর রুটের এনা পরিবহনের শাহ আলম। এ সড়কের কালিয়াকৈর বাইপাস সড়কের হিজলতলী সেতুর ও লতিফপুর সেতু এবং কালিয়াকৈর রেলওভারপাসের দুপাশের সড়ক ভাঙ্গাচোরা। মির্জাপুরের দেরুয়া রেলক্রংসিয়েও সড়ক ভাঙ্গাচোরা হওয়ায় যানবাহন চলে ধীর গতিতে। লতিফপুর সেতুর দুপাশের সড়ক অনেকটা দেবে গেছে। ভাঙ্গা অংশে ইট বিছিয়ে মেরামত করা হয়েছে। তার ওপর দেয়া হচ্ছে বিটুমিনের প্রলেপ। সেখানে মেরামতকাজ তদারক করছিলেন গাজীপুর সড়ক বিভাগের পরিদর্শক পারভেজ আহমেদ। তিনি দাবি করেন, চালকদের ওভারটেকিং প্রবণতাই যানজটের কারণ। চন্দ্রা থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত সড়কেও অসংখ্য ছোটবড় খানাখন্দ। মির্জাপুরের দেরুয়া লেভেল ক্রসিংয়ে সড়কটি সরু। এখানেও সড়কে খানাখন্দ। বৃষ্টি না হলে ঈদের আগে এ সড়কে কোন সমস্যা হবে না বলে মনে করেন সড়ক ও জনপথের মির্জাপুরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী প্রদীপ সরকার। তিনি বলেন, এখানে ভাল মানের বিটুমিন দিয়ে কাজ হলেও বৃষ্টির পর কী হয় তা বলা যায় না। সড়ক মেরামতে ৪ ভাগ বিটুমিন দিলেই যথেষ্ট। কিন্তু এখানে আমরা ৬ ভাগ বিটুমিটন দিয়ে ঢালাই করছি। আশা করি কিছু হবে না। কিন্তু বৃষ্টি হলে আসলে কিছু করার থাকে না। তবে কোরবানির ঈদে সড়কের পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সোহেল তালুকদার। তিনি বলেন, ঈদের মুভমেন্ট এখনও শুরুই হয়নি। কিন্তু এখনই বিভিন্ন জায়গায় যানজট লাগছে। উত্তরাঞ্চল থেকে যে গাড়ি ৬ ঘণ্টায় আসার কথা সে গাড়ি আসতে এখনই ১৪ ঘণ্টা-১৬ ঘণ্টা সময় লাগছে। “ঈদের সময় আমরা কীভাবে চাপ সামলাব আমি জানি না। ঈদের আগে খানাখন্দে ভরা সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখা বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানান হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারেক আহম্মেদ। তিনি বলেন, সব রাস্তাই কমবেশি ভাঙ্গাচোরা, বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি জমে যায়। বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা বলেন, এই মহাসড়কটি নিয়ে আমরাও চিন্তায় আছি। দ্রুত সংস্কার ও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া না হলে ঈদে ঘরমুখো মানুষকে আরও দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
×