ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পশুর হাট টার্গেট করে জাল টাকার কারবারিরা তৎপর

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ২৯ আগস্ট ২০১৭

 পশুর হাট টার্গেট করে জাল টাকার কারবারিরা তৎপর

রহিম শেখ ॥ ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানালেন, এক হাজার টাকার একটি নোট জাল। কিন্তু কিভাবে এই নোট হাতে এসেছে জানেন না বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাসিবুর রহমান। তার মতো সাইফুর রহমান নামের এক ব্যবসায়ী কারওয়ান বাজারে সবজি কিনে টাকা দিলে সেটি জাল বলে ফেরত দেন দোকানি। নোটটি দেখে সাধারণভাবে জাল হিসেবে শনাক্ত করতে পারেননি তিনি। এমন ঘটনার সাক্ষী প্রতিদিনই কেউ না কেউ। জাল নোট চক্রের প্রতারণায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সারা বছর জাল টাকার বিস্তার থাকলেও এবার কোরবানির ঈদ উপলক্ষে পশুর হাট টার্গেট করে তৎপর হয়ে উঠেছে জাল টাকার কারবারিরা। ঢাকা ও আশপাশের এলাকার অন্তত ৩০টি চক্র প্রচুর পরিমাণ জাল নোট ছড়িয়ে দিচ্ছে বাজারে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সুবিধা নিয়ে তারা এমন নিখুঁত নোট তৈরি করছে যে, সাধারণভাবে সেগুলোকে জাল বলে ধরার উপায় নেই। ফলে পশুর হাটসহ ঈদবাজারের অন্যান্য কেনাকাটার ক্ষেত্রে এ ধরনের নোট হাতবদল হতে পারে খুব সহজে। গোয়েন্দাদের তথ্য মতে, ঢাকা ও আশপাশের জেলায় জাল টাকা তৈরির ৩০ চক্র তৎপর হয়ে উঠেছে। এসব সিন্ডিকেটের সদস্যদের বেশির ভাগ র‌্যাব-পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর জামিনে মুক্ত হয়ে জাল টাকার জাল বিস্তার করছে। তাদের তৈরি কোটি কোটি টাকা মূল্যমানের জাল নোট অর্ধশতাধিক গ্রুপের মাধ্যমে এরই মধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। জাল টাকাগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়, সেগুলো আসল না নকল তা বোঝা অনেক ক্ষেত্রে মুশকিল হয়ে পড়ে। এসব টাকা কোরবানির পশুর হাটসহ ঈদ-পূজা উৎসবের কেনাকাটায় সুযোগ বুঝে গছিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নেয় চোরাকারবারিরা। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ২১ আগস্ট ফার্মগেট ও মোহাম্মদপুর থেকে ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকার জাল নোট এবং ৩৭ লাখ ৬০ হাজার জাল বিদেশী মুদ্রা জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় আটক করা হয় ৭ প্রতারক চক্রকে। এ সময় তাদের কাছ থেকে জাল টাকা ও রুপী তৈরির ল্যাপটপ, প্রিন্টার, কাঠের ডাইস, বিভিন্ন রং, সাদা স্কচটেপ, লেমিনেটিং মেশিন, ডেকোরেটিং পাউডার, এ্যাডাপ্টার ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় মুদ্রাসহ অন্যান্য দেশের মুদ্রা তৈরির জন্য বিশেষায়িত কাগজ গোপনে বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে সিন্ডিকেট। গ্রেফতারকৃতরা সিন্ডিকেটের তৃতীয় সারির সদস্য বলে দাবি গোয়েন্দাদের। একটি কাগজ দিয়ে চারটি মুদ্রা তৈরি করে থাকেন কারিগররা। জাল নোট তৈরির জন্য কাগজে জলছাপ দেয়ার জন্য ঢাকার বাইরেও অফিস খুলে সিন্ডিকেট। সেখানে জলছাপ দেয়া সম্পন্ন হলে ঢাকায় নিয়ে এসে নিরাপত্তা সুতা ঢোকান কারিগররা। চাহিদা অনুযায়ী জলছাপ সংবলিত কাগজ সরবরাহ করা হয় ঢাকার বাইরে থেকে। প্রস্তুতকৃত জাল রুপী সীমান্তে গরু কারবারিদের মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ করায় সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ভারতীয় সীমান্তবর্তী প্রতিটি স্থলবন্দরসহ অন্তত ২৫টি পয়েন্ট রয়েছে। এসব সিন্ডিকেটের প্রতিনিধি অবস্থান করেন ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-কমিশনার (পশ্চিম) সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ঈদের মতো বড় উৎসব টার্গেট করে বেশি তৎপর হয়ে ওঠে জাল নোট চক্রের সদস্যরা। বিষয়টি মাথায় রেখে গোয়েন্দারাও আগে থেকেই নজরদারি শুরু করেছেন। ফলে সম্প্রতি দুটি চক্র ধরা পড়েছে। তবে মূলহোতা দুজন এখনও পলাতক। জাল নোটের বিস্তার এখন আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে বলেও দাবি করেন ডিবির এই কর্মকর্তা। ডিবির সহকারী কমিশনার মাহমুদ নাছের জনি বলেন, জাল নোট তৈরির কারিগরি বিষয়টি তেমন জটিল নয়। এ কারণে অর্ধশিক্ষিত, এমনকি অশিক্ষিতরা অল্প সময়ে বেশি টাকা আয়ের উপায় হিসেবে জাল নোট তৈরি করছে। একটি চক্র ধরা পড়লে আরেক চক্র কাজ শুরু করছে। আবার জামিনে মুক্ত হয়ে পুরনোরাও ফিরছে একই পেশায়। তিনি জানান, জাল নোট তৈরির প্রতিটি চক্রে ‘কোম্পানি’ নামে পরিচিত এক ব্যক্তি থাকে, যার কাছে জাল টাকা ছাপার সব সরঞ্জাম রয়েছে। একজন কোম্পানির দুজন ‘হ্যান্ডেল’ বা সহযোগী থাকে। সহযোগীদের কাজ হলো কম্পিউটার প্রিন্টারে কাগজ দেয়া এবং প্রিন্ট বের হলে তা টাকার আকারে কেটে গুছিয়ে বান্ডিল করে রাখা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কারবারিরা ১ হাজার টাকার নোট সবচেয়ে বেশি জাল করে। ১০০ বা ৫০ টাকার জাল নোটও পাওয়া যায়; কিন্তু সংখ্যায় অনেক কম। অন্য নোটগুলো জাল হয় না বললেই চলে। জাল নোট-সংক্রান্ত এক পরিসংখ্যানে দেখায় যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সর্বমোট ২০ হাজার ৭৯০টি জাল নোট ধরতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উদ্ধারকৃত নোটের মধ্যে ১০০০ টাকা মূল্যমানের জালনোটের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭৮০টি, যা মোট ধরা পড়া নোটের ৭৬ শতাংশ। ওই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে ৫০০ টাকার নোট ধরা পড়েছে ৩ হাজার ৮৯৩টি। ১০০ টাকার নোট ধরা পড়েছে ১ হাজার ১১৮টি। ৫০ টাকার জাল নোট ধরা পড়েছে ৭২টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, বেশি মূল্যমানের নোট জাল করে তা চালিয়ে দিতে পারলে দুর্বৃত্তরা বেশি লাভবান হয়। এজন্য বড়মানের নোটগুলোর জাল করার প্রবণতা বেশি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময় জালনোট প্রতিরোধে সক্রিয়। আগামী ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর মার্কেট ও সারাদেশের কোরবানির পশুর হাটগুলোয় জালনোট শনাক্তকরণ মেশিন দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নোট যাচাই করে দিতে হাটগুলোয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বুথ স্থাপন করবে।
×