ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গরু এখন হটকেক, আলোচনার কেন্দ্রে...

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ২৯ আগস্ট ২০১৭

গরু এখন হটকেক, আলোচনার কেন্দ্রে...

সমুদ্র হক জাতি ভেদে মানব বন্দনায় বলা হয়, ‘নানান বরণ গাভি রে ভাই একই বরণ দুধ, জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুত....।’ প্রাচীন ইতিহাস থেকে পুরাণ হয়ে আজ পর্যন্ত গরুকে নিয়ে বহু ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। কোরবানির ঈদের আগের এই সময়টায় গরু এখন ‘হটকেক’। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বহুকাল থেকেই অন্য মৌসুম ছাড়াও বিশেষত কোরবানির ঈদের এই সময়টায় মানুষ আর গরু মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। কৃষির বিবর্তনে আদিকাল থেকেই মানুষ আর গরুর বাস পাশাপাশি। মানুষ থাকে বাসগৃহে আর গরু থাকে সংলগ্ন গোয়াল ঘরে। দেশজুড়ে এখন গরু দেখা যাবে ট্রাকে, মিনি ট্রাকে, পিকআপে, শ্যালো চালিত যানবাহন ও নৌকায়। প্রতিটি এলাকার হাটে গরু জড়ো হচ্ছে। বাদ নেই রাজধানী ঢাকা। গরুকে সাজানোও হয়েছে। কপালে লাল কাপড়ের টিকলি, শিঙে রঙের প্রলেপ, গলায় জরির ও রঙিন কাগজের মালা। যানবাহন থেকে নেমেই হাটে। সেখান থেকে বাসাবাড়িতে। গরুকে আদর আপ্যায়নের কোন ঘাটতি নেই। সকলের মুখে এখন গরু। টিভির পর্দায়, সংবাদপত্রের পাতায় গরুর ছবি। লোকমুখে সাংকেতিক কথা ‘ভাই আপনি গরু না ছাগল!’ এই কথা অন্য সময় বললে পিটুনির অভাব হতো না। ঈদের আগের এমন কথায় বুঝে নেয়া যায়- তিনি কি কোরবানি দেবেন গরু না ছাগল। গরুর খাটুনি এখন অনেক কমেছে। খায়-দায়, বসে থাকে, ঘুরে বেড়ায়, চড়ে বেড়ায়। আগের মতো লাঙলের হালে জোয়াল টানতে হয় না। সরিষা ভাঙার ঘানি টানতে হয় না। আঁটি থেকে ধান বের করতে কয়েক পাক ঘুরতে হয় না। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা দিয়ে গাড়ি (গরুর গাড়ি) টানতে হয় না। এসেছে কলের লাঙল, যন্ত্র চালিত যান, পাকা সড়ক। গরুর এখন মহানন্দ। শুধু কোরবানির ঈদের সময় ওরা নিরানন্দ। গরু জবাই করা হয়। বলা হয় কোরবানি। গরু কোরবানি হয়। তবুও গরু থাকে মানুষের মুখে, সংসার জীবনে, কাগজে কলমে, কি-বোর্ডে, ছাপার অক্ষরে। বলা হয়- গরুর মতো খাটতে খাটতে জীবনটাই বরবাদ। পরিবারে কলুর বলদের মতো খাটতে হচ্ছে। কোন কিছু হারিয়ে গেলে খোঁজার সময় বলা হয় গরু খোঁজা। গবেষণা করার আরেক অর্থ গরু খোঁজা। বাগি¦বিধিতে আছে- কাজীর গরু খাতায় আছে গোয়ালে নেই, দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল, গরু মেরে জুতা দান, ধর্মের ষাঁড়, দানের গরু বাড়ি পর্যন্ত গেলেই হলো, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, গরু জরু ধান রাজ্য বিদ্যমান, কানা গরু বামুনকে দান, গোধন, শকুনের শাপে গরু মরে না ... কত যে কথা গরুকে নিয়ে ...। কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহেষ নামের গরুর প্রতি গফুরের ভালবাসার যে কাহিনী তা কালজয়ী হয়ে আছে। বাংলা ভাষায় গরু এসেছে নানা ভাবে। গো অর্থ গাড়ি, গো-রুত অর্থ গরুর ধ্বনি (হাম্বা হাম্বা)। গরুর নাম অনেক। স্ত্রী বাচক হলো- গাভী, গাই, ধেনু। পুরুষবাচক- ষন্ডা, ষাঁড়, দামড়া, বৃষ, বলদ, বলীর্বাদ, রোমন্থক ইত্যাদি। গরুর সঙ্গে সম্পৃক্ততা মানবকূলেও এসেছে। কন্যাকে কখনও বলা হয় দুহিতা। দুহিতা এসেছে একটা সময় নারী গাভী দোহন করত। তাদের বলা হতো দুহিতা। গো নিয়ে অনেক শব্দই এসেছে। যেমন গোয়ালা, গোবেচারা (নিরীহ মানুষ), গোপ, গবাক্ষ, গোগ্রাস, গোধূলী, গোধন ইত্যাদি। পঞ্চগব্য কাকে বলে! দুধ, দই, ঘি, গোময় (গোবর) ও গোমূত্র এই পাঁচ পদে পঞ্চগব্য। মিলল। গোবর জ্বলানি ও সার হিসেবে এবং গোমূত্র বা গোচোনা এক ধরনের সার। কত ধরনের গরু পোষা হয় তার ইয়ত্তা নেই। ফ্রিজিয়ানা, সিন্ধি, লাল সিন্ধি, সাহিওয়াল, হলস্টোন, হরিয়ানা, লোলা, অমৃতমহল, সুলতানি, মন্টগোমারী, আয়ারশায়ার, থরপর্কার, জার্সি, গীর, কাথিয়াবাড়ি, কাঙবেজ .....কত যে নাম। হালে দেশে অনেক নামের গরু পালন করা হচ্ছে। কিছু গরু বিদেশী গরুর সিমেনে কৃত্রিম প্রজননে ডেইরি ফার্মগুলোতে পালিত হচ্ছে। পুরাণে গরুকে নিয়ে নানা কাহিনী বর্ণিত আছে। সুমের সভ্যতা থেকে গরু তার শ্রম থেকে শুরু করে অস্থি মজ্জা, মাংস, চর্ম, মলমূত্র যাবতীয় কিছু মানব কল্যাণে দান করে আসছে। প্রাচীন ভারতে গরুকে সম্পদ মনে করে নামকরণ হয় গোধন। প্রাচীন আমলে রাজা মহারাজারা গরু পুষতেন। মহাভারতে আছে- দুর্যোধন দ্রোনাচার্য ও ভীষ্মকে সঙ্গে নিয়ে বিরাট রাজার গোধনে হানা দিয়েছিল। বর্তমানে টেলিভিশন চ্যানেলে স্টার সার্চ ও ট্যালেন্ট হান্টিং কিন্তু হাল আমলের নয়। সীতার পিতা জনক রাজা শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মর্ষি খুঁজতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। প্রতিযোগীরা আসতে থাকে নানা স্থান থেকে। এক ঋষির সঙ্গে কেউই টিকতে পারেনি। সেই ঋষি প্রবর খেতাব পেলেন শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মর্ষির। তাকে যে পুরস্কার দেয়া হলো তা ছিল, সোনা দিয়ে শিং বাঁধানো এক হাজার গরু। কালিদাসের মেঘদূতে যে যে চর্মস্বতী নদীর কথা আছে তাও গরুকে নিয়ে। মেঘদূতে সেই কাহিনী বর্ণিত আছে। গরুকে দেবতার আসনে প্রথম বসিয়েছে মিসরীয়রা। মিসরের রানী ক্লিওপেট্রা গরু পুষতেন। গরুকে তিনি পরম যতেœ পালন করতেন। গরুর জন্য ছিল বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা। তিনি পদ্মফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখতেন গরু রাখার স্থান। আর্যদের কাছেও গরু ছিল পূজিত। বিষ্ণুর প্রতীক ছিল গরু। মহাদেবের সবচেয়ে পছন্দের বাহন ছিল বৃষ। যা গরু। কোরবানির ঈদে গরু হয়ে আসে আলোচিত পশু হয়ে। তখন দেশজুড়ে গরু দেখা যায় হাটগুলোত। সেখান থেকে গরু কয়েক ঘণ্টার জন্য শেষ আশ্রয় পায় নগরী শহর ও গ্রামের বাড়ি ঘরের সামনে। তারপর কোরবানি।
×