ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

৫ মে ২০১৩ হেফাজতে ইসলামের তান্ডব

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ২৯ আগস্ট ২০১৭

৫ মে ২০১৩ হেফাজতে ইসলামের তান্ডব

(গতকালের পর) পরে এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বিএনপি তাদের ভাষায় এ ‘গণহত্যার’ বিষয়ে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানায় (দ্রষ্টব্য: প্রথম আলো ৭.০৫.১৩)। জনগণের সমর্থনের অনুপস্থিতিতে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃঢ় কার্যক্রমের ফলে তাদের ডাকা হরতাল সফল হতে পারেনি। ঢাকার হেফাজতীদের তা-বের সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের হাটহাজারি, ফটিকছড়ি, বাঁশখালী, বাগেরহাট ও নারায়ণগঞ্জে হেফাজতীরা আইনশৃঙ্খলার প্রতিকূলে আঘাত আনে। হাটহাজারিতে সেনাবাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জের সার্জেট সাইদুর রহমানকে হেফাজতীরা পিটিয়ে হত্যা করে। তারা বাগেরহাটে কয়েকটি বাজারে হামলা এবং কয়েকটি এ্যাম্বুলেন্সসহ শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় পুলিশের গুলিতে হাফিজ ও সাইফুল নামে দু’জন হেফাজতীর মৃত্যু হয়। সেখানে সহকারী পুলিশ সুপার শহিদুল ইসলামসহ ১০ জন পুলিশ আহত হন। বরিশালে হেফাজতীরা কয়েকটি যাত্রীবাহী বাস ভাঙচুর করে; সীতাকুন্ডে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একাধিক স্থানে তারা অবরোধের অপচেষ্টা চালায়। এ সময় এই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ১৩টি গাড়িতে তারা আগুন দেয় ও ভাঙচুর করে। নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁও এবং কাঁচপুর এলাকায় হেফাজতীরা সেখানকার কর্তব্যরত পুলিশ ও বিজিবি কে আক্রমণ করে। তারা পুলিশ ফাঁড়ি ও ক্যাম্পে চড়াও হয়, বিদ্যুত অফিস ও দোকানপাট ভাঙচুর করে ও আগুন লাগিয়ে ২০টি যানবাহন বিনষ্ট করে। প্রায় ৫ বছর পরে হেফাজতে ইসলাম এর ঢাকা শাপলা চত্বরে তান্ডব এবং তাদের দমন করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম যখন ফিরে দেখি তখন কয়েকটি তথ্য আমার বিবেচনায় সুস্পষ্ট ও প্রকটভাবে ধরা দেয়। এক, হেফাজতে ইসলামের নেতা ও কর্মী বা তাদের ভাবাপন্ন সমর্থকদের ধর্মীয় গোঁড়ামিকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং প্রতিপত্তি বাড়ানো ছাড়া বস্তুনিষ্ঠুভাবে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া অনুধাবন করতে পারেনি। এবং ফলত কেবল নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করণে প্রযুক্ত তাদের মনোযোগ এবং কর্মকান্ড- সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও কল্যাণের অনুকূলে প্রযুক্ত হয়নি। এ বিবেচনা করলে সরকার ও সমাজের তরফ থেকে এদেরকে প্রতিহত করা এবং গোঁড়ামিকে উন্নয়নের পথে অন্তরায় হিসাবে বিবেচনা করে সকল শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া জনস্বার্থিক হবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। দুই, হেফাজতে ইসলাম ও তাদের সমর্থকদের ধর্মীয় গোঁড়ামিভিত্তিক এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থ প্রসারনীয় কর্মকা- কোন দিনই মূলত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হবে না। যেহেতু এরা তাদের বক্তব্য ও আচরণে ধর্মান্ধতার মোড়কে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে উদগ্রীব সেহেতু তারা কোন দিনই ন্যায়ানুগ সমাজ প্রশাসন ও উন্নয়নে নিবেদিত কর্মী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে না। তিন, দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরণে ও বিশৃঙ্খলা দমনে গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক বেসামরিক সুশীল বাহিনীর বিকল্পে কথায় কথায় সামরিক বাহিনীকে প্রযুক্তকরণ যেমন সেই বাহিনীর ভূমিকাকে বিতর্কিত করবে তেমন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কার্যক্ষমতা বিনষ্ট কিংবা সীমিত করবে। সংশ্লিষ্ট সকলকে এই ক্ষেত্রে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে সচেতন ভাবে অগ্রসর হতে হবে। চার, বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহযোগে সকল অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রসারণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম প্রযুক্ত করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক এই ঘটনার পরম্পরায় প্রদর্শিত আদর্শিক ও নির্ভীক সিদ্ধান্তায়ন নীতিগতভাবে প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুসরণ করা সঙ্গত। সুশীল প্রশাসন এবং বিরোধী শক্তির সহায়তাকারী কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে এ ক্ষেত্রে ভিন্নতর পন্থা অবলকন করে সফল হতে পারবে না বলে সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতন থাকা ঈপ্সিত। পাঁচ, হেফাজত ও সংশ্লিষ্ট মৌলবাদীদের বিশৃঙ্খলা দমন করণে ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, দমকল বাহিনীর অফিসার ও সদস্যরা যে নির্ভীকতা ও গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য নিয়ে আর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন তা এদের সকল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের অফিসার ও বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা কর্মানুগ হবে। এবং এ করলে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে ভাবে ও মাত্রায় গণতান্ত্রিক সরকার ও সুশীল প্রশাসনের আইনী নির্দেশ মেনে দেশ ও সমাজের প্রতি তাদের অনুগত্য প্রমাণিত করে আসছেন তা আমরাও এদেশে অর্জন করতে সক্ষম হব। এবং ছয় ও সর্বশেষ, হেফাজতে ইসলাম ও তাদের ধর্মান্ধ অনুসারীদের প্রতিহত করণের প্রক্রিয়ায় তাদেরকে যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কাঠামোর আওতায় জাতীয় জীবনের মধ্যস্রোতে আনা ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট করা যৌক্তিক ও জন স্বার্থিক হবে। শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতীরা সেদিন পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা সময় ও সুযোগ মতো বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে বিরত হয়নি। পরে ২০১৪ সালে জানুয়ারি ১৬ তারিখ আমি যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে ছিলাম না তখনই হেফাজতের অনুসারীরা আমার উপজেলা কচুয়ার উজানী মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে আমাকে আমার কর্মীদিগকে আক্রমণ করে। এসব বিক্ষোভ ও নৈরাজ্যকর ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও হেফাজতে ইসলাম তাদের অনুসারীদের জাতীয় জীবন ও দেশ গঠনের মধ্যে স্রোতে আনার জন্যে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। এর ফলশ্রুতিতে সাম্প্রতিককালে মূলত ২ টি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়: (১) ধর্মচেতনায় আঘাত আনতে পারে বা ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে পারে এমন সব রচনা কিংবা মতামত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ব্যবহার্য পাঠ্যপুস্তক থেকে সরিয়ে দেয়ার বা সংশোধন করতে কাজ হাতে নেয়া হয়। এতে বস্তুগতভাবে পাঠ্যসূচীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক গুরুত্বের কোন নেতিবাচক পরিবর্তন হওয়া প্রত্যাশিত বা আশঙ্কিত নয়। (২) হেফাজতে ইসলাম পরিচালিত কওমি মাদ্রাসা সমূহকে রাষ্ট্র স্বীকৃত শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় এনে ক্রমান্বয়ে তাদের থেকে গ্রহণীয় শিক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক করার উদ্দেশ্যে একটি বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে সারাদেশের কওমী মাদ্রাসা সমূহকে তার তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে জনস্বার্থ রক্ষা করণে সহায়ক হিসাবে গ্রহণ করা যৌক্তিক বলে বিবেচনা করা হয়। দেশের শিক্ষিত ও সুশীল সমাজ এই যুক্তিকে সমাজের লক্ষ্য ও কর্মানুগ হবে বলে বিবেচনা করছে। এই দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলশ্রুতিতে হেফাজতীদের সঙ্গে সরকারের নেতৃবৃন্দের ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ দূর হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে একটি তাৎপর্যমূলক সংখ্যার ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীকে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট করণের প্রাথমিক কাজ সফলতার সঙ্গে সম্পূর্ণ করা হয়। আশা করা যায় যে সরকার এই দু’ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলশ্রুতিতে এখন থেকে কেবল মাত্র ধর্মের মোড়কে বিএনপি, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির জনস্বার্থবিরোধী নেতৃত্বে দেশে বা দেশের প্রশাসনের তেমন কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে না। (সমাপ্ত) লেখক : সাবেক সচিব ও মন্ত্রী
×