ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

মানবদেহে প্রাণীর অঙ্গ স্থাপনে আরেক বাধা দূর

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ২৯ আগস্ট ২০১৭

মানবদেহে প্রাণীর অঙ্গ স্থাপনে আরেক বাধা দূর

মানবদেহে অঙ্গ প্রতিস্থাপন চিকিৎসায় বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে। যকৃৎ, কিডনি থেকে শুরু করে হেন অঙ্গ নেই যা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে। শুধু একটাই সমস্যা। তা হলো প্রতিস্থাপন করার মতো অঙ্গের ঘাটতি। তার ফলে ট্রান্সপ্লান্টেশনের অপেক্ষায় থাকা রোগীদের তালিকা যেখানে এমন চিকিৎসা আছে সেখানে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েই চলেছে। গত জুলাই মাসে শুধু আমেরিকায় উপযুক্ত ডোনারের অপেক্ষায় থাকা রোগীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার। এই যখন অবস্থা তখন অঙ্গ সরবরাহের একটা বিকল্প উৎস থাকা দরকার। মার্জিন জৈব প্রযুক্তি কোম্পানি ইজনেসিসের লুহান ইয়াং এবং তার সহকর্মীদের রচিত ও সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে সেই উৎসের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। ড. ইয়াং ও তার দল শূকর নিয়ে নানা পরীক্ষা চালাচ্ছেন। মানব অঙ্গের বিকল্প হিসেবে শূকরের অঙ্গ ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা বেশ আগে থেকেই শোনা যাচ্ছে। শূকর নিয়ে গবেষণা প্রচুর হয়েছে। এদের প্রজননও সহজ। আকার-আয়তনের দিক দিয়ে এরা মানুষের অনুরূপ। তার অর্থ এদের শরীরের ভেতরকার অঙ্গগুলোর আকারও সে রকমই হওয়ার কথা। শূকরের কিডনি নিজের শরীরে ধারণ করতে অনেকেই হয়ত নাক সিটকাবেন। কিন্তু কিডনি বিকল হয়ে যারা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তারা হয়ত করবেন না। তবে ঘেন্নার ব্যাপারটা ছাড়াও এ জাতীয় ট্রান্সপ্লান্টেশনের ব্যাপারে আপত্তির কিছু বাস্তব কারণও আছে। একটা হলো মানবদেহে ইমিউন ব্যবস্থা এমন অঙ্গ দ্রুত প্রত্যাখ্যান করতে পারে। দ্বিতীয়ত এই অঙ্গ তার নিজের সঙ্গে অভিনব কিছু ইনফেকশনও নিয়ে আসে। ইনফেকশনগুলোর কারণ এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস। ড. ইয়াংসের দলটি এই সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে কাজ করছেন। এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস হলো ভাইরাল ডিএনএর একটা সিকোয়েন্স যা শূকরের জেনোমে চলে এসেছে এবং তারপর এর ডিএনএর অবশিষ্টাংশের সঙ্গে বংশপরম্পরায় বাহিত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হলো এই ভাইরাসগুলোর কোষ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার ও স্বাধীন হওয়ার এবং আবারও সংক্রমণের বাহনে পরিণত হওয়ার ক্ষমতা থাকে। উপরন্তু কোষ কালচার ব্যবহার করে পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে যে এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস এভাবে এক প্রজাতির কোষ থেকে আরেক প্রজাতির কোষে ছড়িয়ে পড়ে তাদের সেই রোগে সংক্রমিত করতে পারে। বিশেষ করে পোরসাইন এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস বা সংক্ষেপে পার্ভস মানবদেহ কোষে ছড়াতে পারে। এখন পার্ভস প্রতিস্থাপিত অঙ্গ থেকে সেই অঙ্গের নতুন ধারকের কোষে সরাসরি লাফ মেরে চলে আসে, নাকি পরীক্ষাগারে থাকা অবস্থায় সেই যাত্রা শুরু করে তা এখনও প্রমাণিত হয়নি। তবে এমনটা ঘটার সামান্যতম ঝুঁকিও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এগিয়ে যেতে পারবেন না। যেভাবেই হোক এই সংক্রমিত শূকর সম্ভাবনা নির্মূল করার জন্য ড. ইয়াং ও তার দল ক্রিস পারকাস ৯ নামে জিন এডিটিংয়ের একটি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। মানব প্রাণের ডিএনএর পরিবর্তন ঘটিয়ে ত্রুটিপূর্ণ জিন বাদ দেয়ার এই কৌশলটি বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। ড. ইয়াং পার্ভস ভাইরাসটিকে শূকরের ডিএনএ থেকে দূর করে সেই প্রাণীটির অঙ্গ মানবদেহে প্রতিস্থাপনের কাজটা নিরাপদ করে তুলতে এই কৌশল কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। প্রথমে ইয়াংয়ের দলটিকে তাদের ব্যবহৃত শূকরের জেনোমে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি পার্ভকে খুঁজে বের করতে হয়েছিল। তার জন্য সেই জেনোমগুলো নির্ভুলভাবে সিকুয়েন্সিং করতে হয় এবং যে জিনগুলো ভাইরাল জিনের মতো দেখতে লাগে সেগুলোর সন্ধান করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় তারা ২৫টি পার্ভ খুঁজে পান। তারপর তারা ক্রিসপার কার ৯ কৌশলটি প্রয়োগ করে ডিএনএর সেই জায়গাটি কেটে দিয়ে সেই শূকরের দেহকোষের সকল পার্ভ ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে দেন। যেসব কোষে এই ভাইরাস থাকে সেগুলোকে বলা হয় ফাইব্রোব্লাস্ট। কাজটা করতে গিয়ে তাদের প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারা লক্ষ্য করেন যে, একটা নির্দিষ্ট ফাইব্রোব্লাস্টের তারা সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পার্ভ ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করতে করতে পেরেছেন, বাকিগুলো নয়। পরে তারা বুঝতে পারেন যে ডিএনএ বেশিমাত্রায় এডিটিং করতে গিয়ে ক্ষতি হয়েছে। এতে করে কোষে এপোপটোসিস নামে একটি আত্মবিধ্বংসী ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। তারা বিভিন্ন রাসায়নিকের মিশ্রণ প্রয়োগ করে এপোপটোসিস বন্ধ করতে সক্ষম হন। এর ফলে সেই শূকরের কোষের প্রতিটি পার্ভ ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করে দেন। এরপর পার্ভ মুক্ত সেই কোষগুলো অন্যান্য শূকরের ডিম্বাশয় থেকে আহরিত ডিম্বাণুুর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেন। এভাবে তারা পার্ভমুক্ত বেশকিছু শূকরের ভ্রণ তৈরি করেন যা থেকে ৩০টি শূকরের জন্ম হয়। এসব শূকরের অর্ধেক সাড়ে চার মাস পর এখনও বেঁচে আছে এবং তাদের অঙ্গ মানবদেহে প্রতিস্থাপন করার মতো আদর্শ বয়সে এসে গেছেন অবশ্য। এ থেকে এমন মনে করার কারণ নেই যে এই শূকরগুলোর অঙ্গই প্রতিস্থাপনে ব্যবহৃত হবে। সেটা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ পার্ভমুক্ত এই শূকরগুলোর গোটা জীবন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে তাদের শরীরে কোন ধরনের অস্বাভাবিকতার লক্ষণ দেখা যায় কিনা দেখার জন্য। পার্ভ নির্মূল করার কাজ জিন এডিটিং ব্যবহার করার পর পরবর্তী অধ্যায়টা হবে অঙ্গ প্রত্যাখ্যান সমস্যা সমাধানে জিন এডিটিংকে কিভাবে ব্যবহার করা হয়। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলেই তারপর মানবদেহে শূকরের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×