ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

কার্যকর সংসদ কী রকম?

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ২৯ আগস্ট ২০১৭

কার্যকর সংসদ কী রকম?

সম্প্রতি অনেক সুশীল, বোদ্ধাজনের মুখে কার্যকর সংসদ ও অকার্যকর সংসদের কথা খুব বেশি শোনা যাচ্ছে, বিশেষত আপীল বেঞ্চে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত ‘পর্যবেক্ষণ’ প্রকাশ পাবার পর বর্তমান সংসদকে কটাক্ষ করে উপরোক্ত শব্দ দুটি আলোচনায় প্রাধান্য লাভ করেছে। সেজন্য মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছে, এই সুশীলরা প্রকারান্তরে ‘কার্যকর’ সংসদ বলতে সম্ভবত ‘প্রকৃত’ বিরোধী দল বোঝাতে ‘বিএনপির’ অবস্থান সে সংসদে থাকে তা বোঝাতে চাচ্ছেন। বিএনপি কি কখনও সংসদে কিংবা বাইরে কার্যকর এবং যথার্থ গণতান্ত্রিক আচরণ করেছে? দলটি নিজ ইচ্ছায় অর্থাৎ খালেদা-তারেকের নির্দেশে বিগত ২০১৩’র নির্বাচন বর্জন করে নির্বাচন ঠেকানোর নামে সারাদেশে অসংখ্য ভোটকেন্দ্র প্রাইমারী স্কুল আগুনে পুড়িয়ে ছাই করেছিল, এলাকার সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ধ্বংস করেছিল, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, এমনকি প্রিসাইডিং অফিসার পর্যন্ত খুন করা হয়েছিল! এরপর খালেদার অস্বাভাবিকভাবে দলীয় অফিসে অবস্থান করে বিএনপি-শিবিরের ক্যাডারদের দিয়ে রাজপথ, হাইওয়েতে চলন্ত গাড়ি, বাস, ট্রাক, সিএনজি ইত্যাদি পরিবহনের ওপর পেট্রোলবোমা হামলা চালিয়ে চরম বর্বর ও অমানবিক শুধু নয়, অদৃষ্টপূর্ব অগণতান্ত্রিক জনবিদ্বেষী আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল- এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য এক শ্রেণীর সুশীল যারা গণতন্ত্রের মুখস্থ এক রূপের জন্য হায় হোসেন, হায় হোসেন করছেন, অথচ ওইসব অপরাধের বিচার দাবি করেন না! সেলুকাস! কি বিস্ময়কর নির্লজভাবে খালেদার প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করে চলেছে এই বাঙালী মুসলিম সুশীলরা! যাই হোক, জানি এরা আছে, থাকবে। কিন্তু এদেরই কতগুলো প্রশ্ন করতে চাই- ১) ’৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদে বিরোধী দল কি ‘কার্যকর’ ভূমিকা রেখেছিল? ২) কতদিন বিএনপি সংসদে উপস্থিত ছিল? ৩) তারা কয়টি প্রশ্নোত্তর পর্বে, বিলের ওপর গঠনমূলক আলোচনা করেছিল? ৪) ওই পাঁচ বছরে তারা কতগুলো অগণতান্ত্রিক, বিদ্বেষমূলক নাশকতার ঘটনা সংঘটিত করেছিল? যেমন, বিদ্যুত কেন্দ্র অকার্যকর করে দেয়া, ১৫ আগস্টের শোক দিবসের দরিদ্রদের জন্য রান্না করা খিচুড়িতে বিষ মেশানো ইত্যা॥ি ৫) তাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল কোন্ বিলগুলো? ৬) সংসদ অধিবেশনে দীর্ঘকাল অনুপস্থিত থেকে একদিনের জন্য তারা কেন উপস্থিত হয়েছিল? ৭) ২০০১-এর নির্বাচনে সে সময়ের প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দীন আহমদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রধান লতিফুর রহমান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু সাঈদ, নির্বাচনের দিন নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রীয় অফিসে চার সচিব, তারেক রহমান, বিদেশী এক কূটনীতিকের অবস্থান ও তাদের কার্যাবলী এবং ভূমিকা কি ছিল? এগুলো কি গণতান্ত্রিক রীতি? বরং এগুলো কি গণতন্ত্র দখল ছিল না? ৮) সে নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে তাদের দিয়ে কত ধরনের নির্যাতন করা হয়েছিল? ৯) হিন্দুদের ওপর, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থকদের ওপর পাঁচ বছর যাবত ক্ষমতাসীন খালেদা-নিজামী-তারেক সরকার যে ভয়ঙ্কর নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ পরিচালনা করেছিল, সমস্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও দলীয়করণ করেছিল, সেজন্য কি ২০০১ অক্টোবর থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর গণতন্ত্রকে ‘ডাইনি-দানবের’ হাতিয়ার হতে দেখা যায়নি? এ সময়টিকে গণতন্ত্রের কবর রচনার জন্য সুশীলরা খালেদা-নিজামী-তারেককে দায়ী করার কথা নয় কি? ১০) ২০০৪-এর ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে চিরকালের জন্য নিঃশেষ করে দিতে খালেদা-তারেক-মুজাহিদ-মুফতি হান্নানদের দ্বারা যে ভয়াবহ, বর্বর গ্রেনেড হামলা চালানো হলো তার পরিকল্পক তারেক-খালেদাকে দায়ী করে তাদের গণতন্ত্র হত্যার জন্য কখনও দায়ী করেন না কেন সুশীলরা? তাদের ষড়যন্ত্রকে চিরদিনের জন্য বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন না কেন? ১১) জঙ্গী বাংলাভাই, আব্দুর রহমান, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদসহ বিভিন্ন জঙ্গী তাদের প্রশ্রয়ে, আর্থিক সাহায্যে যেসব তা-ব, বোমাবাজি, শাহ কিবরিয়াসহ শত শত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী হত্যার নেপথ্য শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল তার জন্য নিজামী-খালেদা-তারেককে দায়ী করেন না কেন এই বিজ্ঞ সুশীলরা? তাদের কাছে প্রশ্ন করি- এর চাইতে অন্ধকার সময় বাংলাদেশে জিয়ার আমলের পর জাতি আর কখনও দেখেছে কি? ১২) বর্তমানে, বছর দুয়েক আগে সংঘটিত ব্লগার হত্যা, হিন্দু, শিয়া, আহমদীয়া, লালন ভক্ত, প্রগতিশীল লেখক, কবি হত্যা, বিদেশী হত্যার নেপথ্যে কোন্ দলের আশ্রয়-প্রশ্রয় আছে বলে এই সুশীলরা মনে করেন? ১৩) বর্তমান সরকার ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করার পর ক্ষমতায় কোন শূন্যতা সৃষ্টি না হবার জন্য, যখন অশুভ শক্তিকে ক্ষমতায় বসার জন্য একদল সুশীল রাজনীতিক, সেনা, আমলা, আইনজীবীর একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে বিশেষ সূত্রে জানা যায়, তখন এই প্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টির সঙ্গে একটি কৌশলী গণতন্ত্রের কাঠামো তৈরি করা হয়, যাতে জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ জাতির ওই ক্রান্তিকালে বিরোধী দল গঠন করেন আবার সরকারেও অংশগ্রহণ করেন। এ পদ্ধতিতে গঠিত বর্তমান সংসদই একমাত্র দেখা গেল কার্যকরভাবে সরকারী ও বিরোধী দল উভয়ের দ্বারা জাতির জন্য কল্যাণকর বিলগুলো গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্রমনা বিরোধী নেত্রী রওশনের সঠিক গণতান্ত্রিক, জনকল্যাণকর ভূমিকা গ্রহণের ফলে। বিরোধী নেত্রী খালেদার সঙ্গে রওশনকে, রওশনের দলের ভূমিকাকে বিএনপির অতীত ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করে দেখুন, খালেদার বিএনপি কি এক মুহূর্তের জন্য গণতান্ত্রিক জনকল্যাণকর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল? ১৪) নাকি গণতন্ত্র মানে সংসদে ঢুকেই চিৎকার, হৈ চৈ করে এক ঘণ্টার মধ্যেই সংসদ থেকে বেরিয়ে যাওয়া, ফাইল ছুড়ে ফেলাকেই গণতন্ত্র বলে? প্রতি নির্বাচনের আগে তথাকথিত ‘আপোসহীন’, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিবেচনাবোধহীন, অমানবিক, দেশ ও জাতির প্রতি প্রেমহীন অগণতান্ত্রিক শক্তিকে আনার প্রচেষ্টা গ্রহণ প্রকৃতই বিস্ময়কর। পৃথিবীর সব দেশের প্রচলিত নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাকে না মেনে জাতিকে একগুঁয়েমি দ্বারা সঙ্কটে ফেলা কেন এই সুশীলরা মান্য করেন, তা সত্যি বিস্ময়কর! এটি কি কোন গণতান্ত্রিক নেত্রীর কাজ? সব শেষে সবচাইতে বড় প্রশ্নটি বিজ্ঞ সুশীলদের কাছে করব- আপনারা কেন ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন দিতে অনিচ্ছুক? আপনারা খালেদা-তারেকের কাছে কোনভাবে কি দায়বদ্ধ যে, তাদের বর্বরতাকেও আপনারা গণতন্ত্র বলেন? উল্টো জাতিকে, নির্বাচনকে, গণতন্ত্রকে মূল্য না দিয়ে খালেদা তারেকের অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক আবদারকে সমর্থন দিচ্ছেন? আপনাদের কাছে জাতির কল্যাণ ও গণতন্ত্রের চাইতে কেন খালেদা, তারেকের ইচ্ছাই বড় হয়ে উঠেছে? ভাল করে ইতিহাস স্মরণ করুন, জানবেন খালেদা-তারেক-নিজামী কখনও গণতন্ত্র চায় না, তারা ক্ষমতায় এসে বারবার স্বৈরতন্ত্রই কায়েম করেছে। বাঙালী জাতির স্বাধীনতা, উন্নয়ন, কল্যাণ তাদের লক্ষ্য নয়, কখনোই ছিল না, তারা চলে আইএসআই-এর নির্দেশে। সেজন্য ক্ষমতা পেলে পাকিস্তানকে পরাজিত করা মুক্তযুদ্ধপন্থীদের ধ্বংস সাধনই তারা করে যাচ্ছে। একবার নয়, বারবার করেছে। আরেকবার ক্ষমতা পেলে একেবারে মূল থেকে তারা বাঙালীর অহঙ্কারের সব জায়গা ধ্বংস করবে এতে সন্দেহ নেই। মিডিয়াগুলোকে দেখি কোন মৃত্যুর জন্য শোকবার্তা প্রকাশের সংবাদে অধিকাংশ সময় বিরোধী নেত্রী রওশন এরশাদের নাম বাদ দেয়; কিন্তু কখনও বাদ পড়ে না বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার নাম! বর্তমানে শান্তিপূর্ণভাবে যে সংসদ চলছে, দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়া সত্ত্বেও সরকার এবং ছাত্র-ছাত্রী, বিভিন্ন পেশাজীবী দল প্রত্যেকটি সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট, সক্রিয় আছে, কেউ বিঘœ ঘটাচ্ছে না, এটাই কি কার্যকর সংসদ নয়? একটা প্রবাদ আছে, সুখে থাকলে ভূতে কিলায়, একদল সুশীল, রাজনীতিক, আমলা, আইনজীবী এই শান্তিপূর্ণ রাজনীতি যেন সইতে পারছেন না, অগ্নিসন্ত্রাসী, ধর্মসন্ত্রাসীদের নাশকতা না চললে মনে হয় ওনাদের ঘুম হয় না এবং ওনাদের কাছে রাজনীতি, গণতন্ত্র অচল মনে হয়। তবে সবশেষে বলব, বিএনপি আগামী নির্বাচনও কোন একটা ওজর দেখিয়ে বর্জন করতে পারে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগসহ মহাজোটকে ২০১৪-র মতো বিব্রত এবং সমস্যায় ফেলার জন্য। সেজন্য বাম ঘরানার সব দল, জাতীয় পার্টি, ছোট ছোট মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী দল মিলে এখনই একটি বড় জোট তৈরি করলে ভাল হবে। এরাই নির্বাচনে গেলে জাতির ঘাড় থেকে ওই সিন্দাবাদের মতো বসে থাকা আপদ দূর হতে পারে। বাম ঘরানার রাজনীতিকরা দেশপ্রেম থেকে জাতির কল্যাণে নিজেদের স্বার্থে একটি জোট করে আগামী নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের রাজনীতির মূলস্র্রোতে আসার সুযোগ হবে। জাতীয় পার্টির অন্য ভগ্নাংশ নিয়ে একটা ঐক্যজোট করলে জাতির কল্যাণ হবে। মোট কথা, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী দু’টি জোট আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিলে দেশ, জাতি, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, উন্নয়ন সব রক্ষা পেতে পারে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×