ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই লাখ কোটি টাকা লেনদেনের আশা

বড় হচ্ছে ঈদের অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২৮ আগস্ট ২০১৭

বড় হচ্ছে ঈদের অর্থনীতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মুসলিমদের ধর্মীয় বড় উৎসব দুই ঈদ। দুই ঈদকে কেন্দ্র করে চাঙ্গা হয়ে ওঠে অর্থনীতি। ঈদে কেনাকাটা, ভ্রমণ, বিনোদনসহ নানা খাতে মানুষের ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে বেড়ে যায় অর্থের প্রবাহ। বিশেষ করে ঈদ-উল-আযহায় কোরবানির পশু বাবদ ব্যয় হয় বিপুল অর্থ। নির্বাচনের বছর হওয়ায় এ অর্থ ব্যয়ের হারও বাড়বে। এতে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে বাড়তি প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। আগামী ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতারা নির্বাচনী এলাকায় বেশি বেশি যাতায়াত শুরু করেছেন। কোরবানির ঈদে সবচেয়ে বেশি চাঙ্গা হয়ে ওঠে গবাদিপশুর খামার খাত। একই সঙ্গে বেড়েছে গৃহসামগ্রীর চাহিদাও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোরবানির ঈদে পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ গরম মসলার চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সব ঈদেই বাড়তি খরচ মেটাতে প্রবাসীরা দেশের স্বজনদের কাছে বাড়তি অর্থ পাঠিয়ে থাকেন। তাই বেড়ে যায় রেমিটেন্স প্রবাহ। এবারও হয়েছে তাই, গত জুলাইয়ে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে আর্থিক প্রবাহ বেড়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ঈদে দেশের অর্থনীতিতে আর্থিক লেনদেন বেড়ে যায়। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে দেশীয় ডেইরি, পোল্ট্রি, গৃহসামগ্রী, বুটিক, তাঁত, কামার, জুতা ইত্যাদি শিল্পে বড় ধরনের একটি পরিবর্তন আসে। এ সময়ে মানুষ উৎসবের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অনেক সামগ্রীও কিনে থাকে। জানা যায়, গত বছর দেশে পশু কোরবানি হয়েছে প্রায় এক কোটি পাঁচ লাখ। চলতি বছর দেশের বাজারে সরবরাহের জন্য প্রস্তুত রয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার পশু। এর সঙ্গে যদি চাহিদা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় তাতেও সঙ্কট হবে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে গরু আমদানি হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সূত্রমতে, দেশে গবাদিপশুর পালন বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছর কোরবানিযোগ্য গরু-মহিষ রয়েছে ৪৪ লাখ ৫৭ হাজার, ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭১ লাখ। গত বছর দেশে পশু কোরবানি হয়েছে প্রায় এক কোটি পাঁচ লাখ। এ হিসাবে এ বছর গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ মিলিয়ে কোরবানির পশুর সংখ্যা বাড়বে প্রায় ১০ শতাংশ। এ হিসাবে এবার এক কোটি ২০ লাখ পশু কোরবানি হবে। কোরবানির পশুর হাটগুলোতে গরুর দাম সর্বনিম্ন ৪০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। প্রায় ১৫ লাখ গরু আসতে পরে ভারত, মিয়ানমার, ভুটান থেকে। গত বছর কোরবানির পশুর হাটগুলোতে গরুর দাম সর্বনিম্ন ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২২ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। যদিও গরুর দাম বেড়েছে। দেশে কোরবানিযোগ্য ছাগল-ভেড়া রয়েছে ৭১ লাখ। বর্তমানে ছাগলের বাজারদর সর্বনিম্ন ১৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। গড়ে প্রতিটি ছাগল ২০ হাজার টাকা ধরা হলে এ বাবদ প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হবে। এ হিসাবে কোরবানির পশু বেচাকেনা বাবদ লেনদেন হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। দেড় লাখ কোটি টাকার চামড়া বাণিজ্য ॥ যে পরিমাণ পশু কোরবানি হবে তা থেকে কিছু চামড়া নষ্ট হবে। এ হিসাবে এক কোটি ১৫ লাখ পশুর চামড়া আসার কথা (বেশিও হতে পারে)। প্রতি পিস চামড়ার দাম গড়ে এক হাজার টাকা ধরা হলে চামড়া ক্রয়-বিক্রয় বাবদ লেনদেন হবে এক হাজার ৫শ’ কোটি টাকা। তবে বড় একটি অংশ পাচার হয়ে যায় আবার সংরক্ষণও করা যায় না। সংরক্ষণ ও পাচার রোধ কমাতে পারলে চামড়ার বাজারমূল্য আরও বাড়বে। ৯০০ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ ॥ কোরবানি উপলক্ষে ব্যাংকিং লেনদেনও বেড়ে যায়। এবার কোরবানি উপলক্ষে চামড়া কেনার জন্য ব্যাংকগুলো কমপক্ষে ৯০০ কোটি টাকার ঋণ দিচ্ছে। রফতানির অর্থও দেশে আসছে। এছাড়া ঈদে গ্রাহকদের নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঈদ অর্থনীতিতে বড় অঙ্কের অতিরিক্ত নোট ছেড়েছে। পশুর হাটে হাসিল ॥ হাটে পশু কেনাবেচায় ৫ শতাংশ হারে হাসিল দিতে হয়। সে হিসাবে হাসিলের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৬ লাখ কোটি টাকা। এছাড়া হাটের অবকাঠামো তৈরি, পরিবহন খরচ, বেপারীদের থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদও প্রচুর অর্থ ব্যয় হবে। চাঙ্গা হয়ে উঠবে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য। কোরবানির উপকরণ ॥ কোরবানির পশু সাজাতে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার হয়। এর মধ্যে কাগজ ও জরির মালা, ঘুণ্টি মালা, নানা ধরনের কাপড়ের মালা এবং রং-বেরঙের দড়িসহ নানা উপকরণ রয়েছে। কোরবানির ঈদের প্রাক্কালে তাই চাঙ্গা হয়ে ওঠে এসব তৈরির ক্ষুদ্র শিল্পগুলো। জানা গেছে, শুধু রাজধানীর গাবতলী হাটেই এসব উপকরণ প্রতিদিন বিক্রি হয় ১২ থেকে ১৬ লাখ টাকার। এ হিসাবে ঈদের আগের ১০ দিনে এক কোটি ২০ লাখ থেকে এক কোটি ৬০ লাখ টাকার উপকরণ বিক্রি হচ্ছে। প্রবাসী অর্থ ॥ ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর হার বাড়িয়ে দেন। চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে ১১১ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় দাঁড়ায় প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। জুনে এর পরিমাণ ছিল ১২১ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। এছাড়া হুন্ডি ও নগদ আকারে এসেছে ৬০ শতাংশ, যার বেশিরভাগই ঈদ অর্থনীতিতে খরচ হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা ॥ এফবিসিসিআইয়ের হিসাব অনুসারে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা, পণ্য পরিবহন মিলে এ খাতে বাড়তি লেনদেন হবে আরও ৬০০ কোটি টাকার। এর বাইরে ভ্রমণ ও বিনোদন খাতে আরও বাড়তি ব্যয় হবে চার হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সাড়ে ২০ লাখ সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ঈদ বোনাস বাবদ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা, দেশব্যাপী ৬০ লাখ দোকান কর্মচারীর বোনাস চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা, পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের সম্ভাব্য বোনাস দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা যোগ হবে চলমান অর্থ প্রবাহে। এর বাইরে ব্যাংক কর্মকর্তারা চার থেকে ছয়টি করে বোনাস পেয়েছেন। ঈদে পাদুকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, বৃহৎ শিল্প, গৃহসামগ্রী, কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়ে। ফলে এসব খাতও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। মসলাসহ নিত্যপণ্যের বাজারে কোরবানির প্রভাব ॥ কোরবানি এলেই হুড়মুড়িয়ে বাড়ে বিভিন্ন ধরনের মসলার দাম। এর মূল কারণ চাহিদা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে প্রতি বছর কোরবানি উললক্ষে দেশে হাজার হাজার টন গরম মসলার আমদানি হয়ে থাকে। এছাড়া কোরবানির পশু জবাই ও মাংস তৈরিতে অবশ্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হলো ছুরি, বঁটি, দা, চাপাতি, রামদা ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মামুন রশিদ বলেন, আগে শুধু কোরবানি দেয়াটাই ছিল মুখ্য। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পর্যটন। যুক্ত হয়েছে ঈদ বোনাস। সব মিলিয়ে একটি ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে অর্থনীতিতে। ধীরে ধীরে আনুষ্ঠানিক পেশার বিস্তার ঘটছে। সেটাকে কেন্দ্র করে কোরবানির অর্থনীতিও বড় হচ্ছে। তিনি বলেন, ফ্রিজ, টিভি প্রভৃতি পণ্যের বিক্রি বাড়ছে। অনেক সেলফোন কোম্পানি ঈদ ধামাকার ব্যবস্থা করছে। ঈদকে কেন্দ্র করে টাকার লেনদেন বাড়ছে। নতুন নোটের সার্কুলেশন বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগছে। ফলে ঈদের অর্থনীনিতিটা ফিবছর বড় হচ্ছে।
×