ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সম্প্রীতির আবাহনে পালিত নজরুল প্রয়াণবার্ষিকী

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ২৮ আগস্ট ২০১৭

সম্প্রীতির আবাহনে পালিত নজরুল প্রয়াণবার্ষিকী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া থেমে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান-এভাবেই মানুষে মানুষে সমতার স্বপ্ন জাগিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সৃষ্টির আলোয় ধারণ করেছিলেন প্রেম ও মানবতাকে। কবিতার ছন্দে কিংবা গানের সুরে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বিভেদের সীমারেখা। অন্যায় কিংবা শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে বিদ্রোহী কবির কলম। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধেও অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ধরা দিয়েছে তার সৃষ্টিসমগ্র। এভাবেই দ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবতার কবি হিসেবে ঠাঁই করে নেন বাংলা সাহিত্য ও শিল্পের অনুরাগীদের মননে। তাই তো সঙ্কট কিংবা দুঃসময়ে আজো তিনি বাঙালীর আলোর দিশারী। রবিবার ছিল গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াকু কবি নজরুলের ৪১তম প্রয়াণবার্ষিকী। জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকীর আনুষ্ঠানিকতায় গান, কবিতা কিংবা বক্তৃতায় বার বার উচ্চারিত হয়েছে সাম্যের চেতনা। ধর্মের বিভেদ পেরিয়ে সম্প্রীতির আবাহনে পালিত হলো কবির প্রয়াণবর্ষিকী। অনুরাগীদের হৃদয় উৎসারিত ভালবাসার সঙ্গে কবির অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী চেতনার অনুরণন ছিল গোটা জাতির অন্তরে। ধর্মান্ধতার আস্ফালনের সঙ্কটময় সময় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশ গড়ার শপথ নিয়ে পালিত হলো তার মৃত্যুবার্ষিকী। কবির সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদনের পাশাপাশি নানা আয়োজনে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয় তাকে। জাতীয় পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর সংবাদ। সরকারী-বেসরকারী টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত হয়েছে নজরুলকে নিবেদিত গান-কবিতায় সাজানো অনুষ্ঠানমালা। এছাড়া নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিকে স্মরণ করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ পুব আকাশে সূর্যের রক্তিম আভার দেখা মিলতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবির সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদনের মাধ্যমে শুরু হয় জাতীয় কবিকে স্মরণে দিবসের কর্মসূচী। কবি পরিবারের সদস্যদের পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে সূচনা হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বের। সর্বসাধারণের সঙ্গে সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কবির নাতনি খিলখিল কাজী। কিছুক্ষণের মধ্যেই সর্বস্তরের মানুষসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নিবেদিত ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত হয়ে যায় সমাধিসৌধ। আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এনামুল হক শামীম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। বিএনপির পক্ষে শ্রদ্ধা জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিকভাবে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, শিশু একাডেমি, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী পরিষদ, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, নজরুল একাডেমি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি সমাধি প্রাঙ্গণে ছিল আলোচনাসভা এবং কবির গান-কবিতায় সাজানো সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে কবির নাতনি খিলখিল কাজী বলেন, আমরা এখনও সর্বস্তরের মানুষের কাছে কাজী নজরুলকে পৌঁছে দিতে পারিনি। এই পৌঁছে দিতে না পারার জন্য আমরাই দায়ী। কারণ আমরা কবিকে নিয়ে সেভাবে চর্চা করছি না। কাজী নজরুল ছিলেন সবার কবি, মানুষের কবি। গ্রাম থেকে শহরে, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নজরুল পড়াতে হবে, তার জীবনদর্শন জানাতে হবে। এই সময় বিশ্বে যেখানে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তখন নজরুল দর্শনের চর্চা খুবই জরুরী। ওবায়দুল কাদের বলেন, যে অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই একই চেতনা নিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ নির্মূল করতে নজরুলের সাহিত্যচর্চার কোন বিকল্প নেই। সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ নির্মূল করতে কবি কাজী নজরুল চর্চার কোন বিকল্প নেই। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রতিটি পর্যায়ে আমরা জাতীয় কবিকে চিন্তা-চেতনায় নিয়েছি। তিনি সদাজাগ্রত। নজরুল চর্চার যথাযথ সম্প্রসারণ করতে পারাই তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উপায়। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতীয় কবি আমাদের আদর্শের প্রেরণা। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যে প্রেরণা তা তিনি আমাদের দিয়েছেন। তার শিল্প-সাহিত্য-গল্প-কবিতা সবকিছুতে তিনি যেমন অবদান রেখেছেন তেমনি মানুষের মুক্তি কামনা করেছেন নিজের কর্মের মধ্য দিয়ে। আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বাংলাদেশের যে অসাম্প্রদায়িক দর্শন, তা কাজী নজরুলের গান-কবিতায় রয়েছে। তিনি মানবতা ও সত্যের জয়গান গেয়েছেন, যা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজী নজরুলের সাহিত্যকর্ম ই-বুকে পরিণত করতে হবে। এটা একটা বড় কাজ। সে সঙ্গে সমস্ত গানের আদি রেকর্ড ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিতে হবে। সে সঙ্গে নজরুল রচনাবলী বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত করতে হবে। একুশ শতকে নজরুলকে শুধু আমাদের মাতৃভাষায় বন্দী রাখলে হবে না। বিশ^ময় ছড়িয়ে দিতে হবে। নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস আরা বলেন কাজী নজরুলের চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। তার গানের চর্চার পাশাপাশি তার অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেও ছড়িয়ে দিতে হবে। নজরুল পদকে ভূষিত তিন গুণী শিল্পী নজরুল ইনস্টিটিউট প্রবর্তিত ‘নজরুল পদক ২০১৬’ পেলেন নজরুল সঙ্গীতের তিন গুণী শিল্পী ফাতেমা-তুজ-জোহরা, ফেরদৌস আরা ও ড. লীনা তাপসী খান। নজরুলের প্রয়াণ দিবসের বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত নজরুল ইনস্টিটিউটের অনুষ্ঠানে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেয়া হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব ইব্রাহীম হোসেন খান ও আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার। আলোচক ছিলেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কবি নাতনি খিলখিল কাজী ও স্বাগত ভাষণ দেন নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ভূঞা। পদক প্রদান ও আলোচনা শেষে ছিল সাংস্কৃতিক পর্ব। যাতে নজরুলের গান পরিবেশন করেন সালাউদ্দিন আহমেদ, মইদুল ইসলাম, রাহাত আরা গীতি, বদরুন্নেছা ডালিয়া, শহীদ কবির পলাশ ও শারমিন সাথী ইসলাম। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে নজরুল ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষণার্থী শিল্পীরা ও গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থীরা। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। নজরুল : সম্প্রীতির সন্ধান বাংলা একাডেমির আয়োজনে বিকেলে একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ছিল একক বক্তৃতানুষ্ঠান। নজরুল : সম্প্রীতির সন্ধান শীর্ষক বিষয়ে বক্তৃতা করেন অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। একক বক্তৃতায় সৌমিত্র শেখর বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে পৃথিবীজুড়েই আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে। আর এক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টি আলোকপাত করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ নজরুল তার ব্যক্তিজীবন ও সৃজনকর্ম দিয়ে পৃথিবীর নানা ধর্ম-সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির সেতুবন্ধনে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, চেয়েছেন সাম্য ও মৈত্রীময় এক সুন্দর পৃথিবী। তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতে যেখানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত, পরমতসহিষ্ণুতা হিংসার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত সেখানে নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টি এবং এর মিথস্ক্রিয়া থেকে উঠে আসা দর্শনে পাওয়া যায় মানবপ্রেমের সু¯িœগ্ধ জলপ্রপাত, পরমতসহিষ্ণুতার বাতায়ন, সৌহার্দ্যরে অমিয়ধারা। একক বক্তা বলেন, নজরুলের জন্মের মাত্র ছয় বছর পর বঙ্গভঙ্গ হয়, তার বয়স যখন বার তখন তা রদ হয়। এরপর সশস্ত্র আন্দোলন, অহিংস আন্দোলন এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তাক্ত ছিল ভারতবর্ষের রাজনীতি। সেই হলাহলের মধ্যে বসেই নজরুল সম্প্রীতির পুষ্পহাসি হেসেছেন। ‘মানুষ’ পরিচয়কে মুখ্য করতে গিয়ে নজরুল সবাইকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন। হিন্দু বা মুসলিম অথবা অন্য কোন ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে ‘মানুষ’ পরিচয়ই যে আমাদের কাছে প্রধান হওয়া উচিত, নজরুলের সমগ্র জীবন ও সাহিত্যের মূল বার্তা তা-ই। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নজরুলের সমকালে এবং আজকেও সবাই তাকে নিজের কাঠামোতে অবলোকন ও ব্যাখ্যা করে। কারণ নজরুলের মতো মৌলিক ও বৃহৎ প্রতিভাকে সবাই নিজের মতো করে ভাবতে চায়, বিশ্লেষণ করতে চায়। তিনি বলেন, নজরুলের সম্প্রীতি সাধনার মূলে ছিল তার প্রবল ইহজাগতিকতার বোধ। ভারতে যখন স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিণত হচ্ছিল সাম্প্রদায়িক সংঘাতে তখন নজরুল একদিকে যেমন সম্প্রীতির বাণী প্রচার করেছেন অন্যদিকে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের মুক্তিসংগ্রামের পথানুসন্ধান করেছেন। শামসুজ্জামান খান বলেন, এ বছর বিশ্বব্যাপী রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্যাপিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে নজরুলকে স্মরণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই বিপ্লবের মানবিক আভায় ছিলেন তরুণ নজরুল। এই বিপ্লবী, মানবিক দর্শনই নজরুলকে চালিত করেছে সম্প্রীতির সন্ধানে।
×