ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অশ্রু-রক্তে ভেজা রাখাইন

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ২৮ আগস্ট ২০১৭

অশ্রু-রক্তে ভেজা রাখাইন

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ ‘মগের মুল্লুক’ নাম অর্জনকারী মিয়ানমার (সাবেক বার্মা) সরকারের সেনাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সে দেশের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘বাঙালী সন্ত্রাসী ও জঙ্গী’ আখ্যায়িত করে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে যেন যুদ্ধই শুরু করেছে। মিয়ানমার সেনাসদস্যদের গুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের শব্দে তিনদিন ধরে প্রকম্পিত হচ্ছে উভয় দেশের সীমান্ত এলাকা। শুধু তাই নয়, কখনও কখনও তাদের ছোড়া গুলি একেবারে কাছাকাছি সীমান্তের এপারেও এসে পড়ছে প্রতিনিয়ত। বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে শুরু হওয়া এ অশান্ত পরিবেশ যেন কেবলই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে প্রাণহানি ও রোহিঙ্গাদের দেশান্তরী হওয়ার সংখ্যা। রবিবার গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী ২ শিশুসহ ৬ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগে শনিবার গুলিবিদ্ধ এক রোহিঙ্গা যুবক চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছে এ হাসপাতালে। এছাড়া সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় অনুপ্রবেশের চেষ্টায় প্রায় ৮ হাজার রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশুকে কর্ডন করে রেখেছে বিজিবি সদস্যরা। এ যেন পুরো সীমান্ত এলাকাজুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা। সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে রবিবার বিজিবিপ্রধান বলেছেন, যে কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার বিরুদ্ধে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। সীমান্তজুড়ে বাড়ানো হচ্ছে আরও ১৫ হাজার বিজিবি সদস্য। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সদস্যদের বিভিন্ন সূত্র প্রতিনিয়ত ভারি গুলি বর্ষণের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন বলে স্বীকার করেছে। মিয়ানমার সরকার দাবি করেছে, সে দেশের ২৪টিরও বেশি পুলিশ ও সেনা চৌকি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর মিয়ানমার সরকারের পক্ষে বলা হয়েছে, তারা ‘বাঙালী সন্ত্রাসী ও জঙ্গী তৎপরতা’ দমনে নেমেছে। পক্ষান্তরে, রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার ও নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে তাদের সশস্ত্র সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)’ মিয়ানমার সেনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে। অধিকার আদায় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের লড়াই থামবে না। দুই পক্ষের সশস্ত্র তৎপরতার জের হিসেবে প্রতিমুহূর্তে ঝরছে অসহায় রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশুদের প্রাণ। আর দলে দলে গৃহহারা হচ্ছে ক্ষুদ্র এই জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা। এ অবস্থায় বিজিবিপ্রধান মেজর জেনারেল আবুল হোসেন রবিবার কক্সবাজার ও বান্দরবানের ঘুমধুম বরাবর দু’দেশের সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট পরিদর্শন করেছেন। ঢাকা থেকে দুপুরে কক্সবাজার এসে বিজিবিপ্রধান প্রথমে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে যান এবং সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এর আগে সীমান্তের ওপার থেকে এপারে ছোড়া গুলি এসে পড়ার ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। বিপরীতে মিয়ানমারের পক্ষে এ জন্য দুঃখও প্রকাশ করা হয়েছে। উভয় দেশের সীমান্ত এলাকায় সীমান্ত রক্ষীদের তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে নজরদারিও সীমান্তরক্ষী সদস্য সংখ্যা। বাংলাদেশী সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সঙ্গে কোস্টগার্ড এবং পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টা নজরদারি বলবৎ রয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বহু দেশের সকল অনুনয়-বিনয় ও আবেদন-নিবেদনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে রোহিঙ্গা নিধনের যে বর্বরতা গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে নতুনভাবে শুরু হয়েছেÑতা যেন প্রণীত গোপন নীলনক্সার নাটকের শেষ পর্ব। কারণ, গত দু’দশকেরও বেশি সময়জুড়ে আরাকান রাজ্যের নাম বদলিয়ে করা হয়েছে রাখাইন রাজ্য। এর পাশাপাশি শুরু করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, দমন-নিপীড়ন ও নানামুখী বর্বরতা। আর তখন থেকেই রোহিঙ্গারা দলে দলে দেশান্তরী হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান অবস্থায় এমন যে রীতিমতো যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে সে দেশের সেনা, পুলিশ, বিজিপি সদস্যরা রোহিঙ্গাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হেনে চলেছে হিংস্র ছোবল। যা বর্বরতার চূড়ান্ত সীমাকেও হার মানাচ্ছে। ফলে নিমিষেই ঝরে যাচ্ছে অসহায় অগণন রোহিঙ্গাদের প্রাণ। ফলে প্রশ্ন উঠেছে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আউং সান সু চির এনএলডি সরকার কি রোহিঙ্গাদের সমূলে উৎখাতের পথ বেছে নিয়েছে? দীর্ঘকালের বাপ-দাদার বসতভিটা ছেড়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে, পালাতে বাধ্য হচ্ছে। অধিকাংশের গন্তব্য অবৈধ পথে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ। মিয়ানমার সরকারের এ ধরনের অমানবিক আচরণ ও বর্বরতার বিপরীতে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি যে মানবিক আচরণ প্রদর্শন করে চলেছে তা বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে সত্য, কিন্তু অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ ক্রমাগতভাবে দেখাতে গিয়ে বাংলাদেশের সহ্যের সীমাও যেন অতিক্রম করতে চলেছে। ওরা আসছে সহায়-সম্বল সবকিছু ফেলে এমনকি গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ও শুধু প্রাণটুকু নিয়ে। ফলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ঢাকায় নিয়োজিত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছে এবং এ নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বেছে নেয়া আহ্বান জানানো হয়েছে। রাখাইন রাজ্য ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিসংঘের কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট গত বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমার সরকারের কাছে পেশের চার ঘণ্টা পরেই শুরু হয়ে যায় সে দেশের সেনাবাহিনীর বর্বরতম আচরণ। ইতোমধ্যে নিন্দা জানিয়েছে, জাতিসংঘ, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ। কিন্তু কোন কিছুরই থোরাই কেয়ার করছে না মিয়ানমার। সেনা বর্বরতায় প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা অসম্ভব একটি ব্যাপার। তবে রাখাইন রাজ্যজুড়ে সর্বত্র পড়ে আছে লাশ আর লাশ। এ যেন লাশের মিছিল। অপরদিকে, দেশান্তরী হতেও রোহিঙ্গাদের মিছিল থামছেই না। সীমান্তের ওপার জুড়ে প্রতিটি পয়েন্টে হাজার হাজার রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে জড়ো হয়ে আছে। রাতের আঁধারে বা দিনের আলোতে সুযোগ পেলেই চলে আসছে বাংলাদেশে। সীমান্তের ওপার থেকে রবিবার সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের মংডুর কইল্যভাঙ্গা এলাকায় সেনা, বিজিপি, লুন্টিং ও রাখাইন সন্ত্রাসীরা সম্মিলিতভাবে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন বসতি পল্লীতে আগুন দিয়ে ছাই করে দিয়েছে। এতে কয়েকশ বাড়িঘর জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। অগ্নিদগ্ধ হয়েছে নারী শিশুসহ অগণিত মানুষ। সরকারী বাহিনীর তা-বে গৃহপালিত গবাদিপশুর প্রাণও রক্ষা পাচ্ছে না। রবিবার সকাল ৮টা থেকে চাকমাকাটসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকার রোহিঙ্গা পল্লীতে সেনা ও পুলিশের গুলিবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। ফলে প্রাণহানিও ঘটেই চলেছে। মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের গণমাধ্যমসমূহে বর্বরতার এ চিত্র প্রকাশ করছে না। গণমাধ্যম কর্মীদের রাখাইন রাজ্যে প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে বহু আগে থেকে। সেখানকার সূত্রগুলো মুঠোফোনে জানিয়েছে, শহরতলির অদূরে কইল্যভাঙ্গা গ্রামের রোহিঙ্গারা শিক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অন্য এলাকার রোহিঙ্গাদের চেয়ে তুলনামূলক পিছিয়ে ছিল। গ্রামটির বেশিরভাগ মানুষ কৃষি কাজে জড়িত থেকে আয় রোজগার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। সেনা অভিযানে অধিকাংশ মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও, অগ্নিদগ্ধ হয়ে কঙ্কাল হয়েছে বহু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধ নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও। উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার রাতে সেনাসদস্যরা দলে দলে রোহিঙ্গা জনঅধ্যুষিত এলাকাগুলো ঘিরে ফেলে শুক্রবার ভোর রাত থেকে তারা রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণে নামলে স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে জড়িত রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরসা ও প্রতিরোধে নেমেছে। ফলে দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি সশস্ত্র অভিযানটি পরিণত হয়েছে কিলিং অপারেশন। ক্ষমা চাওয়া উচিত মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী আউং সান সু চিকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে এবং সকল রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি। কমিটির সেক্রেটারি নুর মোহাম্মদ সিকদার রবিবার মিয়ানমারের এনএলডি নেত্রী আউং সান সু চিকে উদ্দেশ করে সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানান, ‘আপনার দেশের একজন নাগরিককেও বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করবেন না। কারণ আমাদের ছোট্ট এ দেশে আপনার দেশের নাগরিকদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও সিকিৎসা দেয়ার মতো বড় কোন ক্ষমতা নেই। বিশেষ করে সীমান্ত জনপদ কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গার কারণে এখন তিল পরিমাণ জায়গা নেই। যারা ইতোপূর্বে পালিয়ে এসে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে, ওদের কারণে যত সব অপরাধ আর মাদকদ্রব্য পাচারের সবই করছে আপনার দেশের নাগরিক রোহিঙ্গারা। উখিয়া-টেকনাফের শান্তির এই জনপদটি অশান্তিতে পরিণত করেছে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।’ কমিটির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, নতুন করে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে রাখাইন রাজ্যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে রোহিঙ্গাদের ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করার বিষয়টি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে অবগত হয়েছে। সুতরাং নিজ দেশের অসহায় মানুষগুলোকে নাগরিকত্ব ও স্বাধিকার না দিয়ে বার বার ‘বাঙালী’ বলে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে কেন? মানবাধিকারের কথা বলে প্রায় ২১ বছর নির্বাসনে থাকা নেত্রী আপনি ক্ষমতায় এসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যে বর্বর আচরণ শুরু হয়েছে সেটা পৃথিবীর কোন সভ্য দেশ মেনে নিতে পারে না। আপনার জন্য শোভাও পায় না। নতুনভাবে লেলিয়ে দেয়া সেনাবাহিনীর সদস্যদের হামলার ঘটনাকে উল্টো বাঙালীদের সন্ত্রাসী হামলা বলে আখ্যা দেয়া মেনে নেয়া যায় না। কোন সাহসে ও কোন অধিকারে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনী সোনার বাংলার ভূখন্ডের ওপর গুলিবর্ষণ করল? এখনই বাংলাদেশের কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত। এখনও মানবিকতা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার ও দেশের জনগণ আপনার দেশের অপরাধ জগতের মানুষগুলোকে আশ্রয় ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। তার বিপরীতে জান্তা বাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করা কি উচিত নয়। আপনার দেশের নাগরিক রোহিঙ্গাদের নিয়ে যান। ফিরিয়ে দিন তাদের নাগরিক অধিকার। স্বাধিকার আদায়ে সংঘবদ্ধ ওপারে (মিয়ানমার) রবিবার সকালেও প্রচ- গোলাগুলি চলেছে। জীবন বাঁচাতে আবারও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। অনুপ্রবেশকারীদের বেশিরভাগই নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ। তরুণ এবং যুবক নেই বললেই চলে। এর কারণ হচ্ছে- রাখাইনে সরকারী বাহিনী সব সময় রোহিঙ্গা জাতির ওপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে, এর প্রতিরোধে সংঘবদ্ধ হয়ে রোহিঙ্গা যুবক-তরুণরা রোহিঙ্গা জাতির ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে। রোহিঙ্গা তাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসার পতাকাতলে ভিড়ে স্বাধিকার আদায়ে লড়তে শুরু করেছে। তারা অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে বলে আরসার দাবি রয়েছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আদি বাসিন্দা ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা স্বাধীনতা লাভের কয়েক যুগ আগে থেকে আরাকানে রোহিঙ্গাদের বসবাস। তৎকালীন সমৃদ্ধশালী আরাকান রাজ্যে ওড়িষ্যা, বিহার, পাঞ্জাব, দিল্লী ও বঙ্গ থেকে লোকজন জীবিকা নির্বাহের জন্য আসত। ভিনদেশি ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও পর্যটকদের বেশ সমাদর করত রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা। সে সূত্রে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আঞ্চলিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে উপমহাদেশের ভারতীয় বাঙালীদের। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির পরও পূর্ব পাকিস্তানের লোকজনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট থাকে রোহিঙ্গাদের। ১৯৭১ সালে পাক-বাঙালী যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার লোক আরাকানে আশ্রয় নেয়। রোহিঙ্গারা তাদের আশ্রয়ও সেবা যতœ দেয়। এতে সম্পর্ক আরও গভীরতম হয়। সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গা পরিবার ও বাংলাদেশী মুসলিম পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের ভুরি ভুরি নজিরও রয়েছে। বাঙালীদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার মানে এই নয়, রোহিঙ্গারা বাঙালী বা বাংলাদেশী। ১৯৫৮ সালে তৎকালীন বার্মার সিংহাসনে সামরিক সরকার দখলে নেয়ার পর থেকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বৈষম্য নীতি প্রয়োগ করতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী অভিবাসী আখ্যা দিয়ে কেড়ে নেয় তাদের নাগরিক অধিকার। পর্যায়ক্রমে মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করে। নীলনক্সা প্রণয়ন করে আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব বিনাশের অপতৎপরতা চালাতে থাকে। আরাকানকে মিয়ানমার পরবর্তীতে রাখাইন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়। রোহিঙ্গা নেতাদের নামকরণ করা উত্তর আরাকানের মহকুমা শহর আকিয়াবকে বদলে সিটওয়ে করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। জান্তা সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২৫টিরও বেশি কিলিং অপারেশন চালিয়েছে। অতীতে নির্যাতনের মাত্রা অসহনীয় হয়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গারা বেশ কয়েকটি সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলে। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যায় সেসব মুক্তিকামী কমিটি। ২০১৫ সালে গণতন্ত্রের লেবাস পরে এনএলডি ক্ষমতায় আসে। দলটির প্রধান আউং সান সুচির ওপর অনেক আশা ভরসা ছিল রোহিঙ্গাদের। কিন্তু সব আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে। আগেকার জান্তা সরকারের মতো সুচিও রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালী’ ও ‘বাংলাদেশী অভিবাসী’ হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করে। এমনকি রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার না করার জন্য জাতিসংঘসহ বিদেশী সংস্থাগুলোকে অনুরোধ জানায় সুচির সরকার। কিন্তু সরকারী দফতর ছাড়া কোন সংস্থা রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ বলা থেকে বিরত থাকেনি। ২০১৬ সালে আবারও সহিংসতা শুরু করে সরকারী বাহিনী। ১০ অক্টোবরের পর থেকে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, নারীদের ধর্ষণ, ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ এমন কোন অপরাধ বাকি নেই, যা মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা করেনি। জাতিসংঘ এটাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ৮৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা ২০১৬ সালে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় রোহিঙ্গা যুবকরা আত্মরক্ষী দল গঠন করে। নিজেদের মা-বোনদের ইজ্জত বাঁচাতে সঙ্কল্পবদ্ধ হয়। গত ২৩ আগস্ট আনান কমিশন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার সুপারিশ উত্থাপন করায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি সামরিক বাহিনী। ২৫ আগস্ট ভোর রাত্রে আবারও গণহত্যা চালানোর জন্য সৈন্যরা মাঠে নামে। তখন তাদের প্রতিরোধের জন্য দাঁড়ায় রোহিঙ্গা আত্মরক্ষী দল। আর তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে রাখাইন প্রদেশকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। এখন পর্যন্ত ১২৭টি রোহিঙ্গার লাশ পাওয়া গেছে বলে ওপার থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে। ২৫টিরও বেশি রোহিঙ্গা গ্রামের শ’য়ে শ’য়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এখনও বিচ্ছিন্নভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে সরকারী সৈন্যরা। প্রতিবাদী রোহিঙ্গা সংগঠনের সদস্যদের সন্ত্রাসী বা জঙ্গী হিসেবে প্রচার করছে মিয়ানমারের গণমাধ্যম। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অফিস থেকেও “বাঙালী সন্ত্রাসী” হিসেবে রোহিঙ্গাদের আখ্যা দেয়া হয়েছে। এতে বাংলাদেশেরও সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি মিয়ানমার সরকারের একটি অপকৌশল। রোহিঙ্গাদের বাঙালী হিসেবে পরিচিত করতে পারলে মিয়ানমার সরকারের নীলনক্সা বাস্তবায়নে পরিপূর্ণতা পাবে। তারা চাইছে, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের যেন আর ফিরিয়ে আনতে না হয়। বাংলাদেশে আশ্রিত ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বোঝা বাংলাদেশের কাঁধ থেকে নামতে দিবে না মিয়ানমার সরকার। সে সঙ্গে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের শেকড় উচ্ছেদ করতে পারলে তবেই তাদের ‘রাখাইন স্টেট’ গড়ার স্বপ্ন পূর্ণ হবে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হিমশিম অবস্থা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার ঘটনায় ফের দলে দলে সীমান্তের ২০টি পয়েন্টে স্রোতের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টায় আছে। অনেকে চলে এসেছে, আবার অনেকে আটকা পড়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের বহুমুখী চেষ্টার পরও অনুপ্রবেশ পুরোপুরিভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম তমব্রু, রেজু আমতলী, উখিয়ার বালুখালী, ধামনখালী, রহমতের বিল, আঞ্জুমানপাড়া, ডিগলিয়া, হাতিমুরা, টেকনাফের উলুবনিয়া, হোয়াইক্যং, কাঞ্জরপাড়া, উনটিপ্রাং, হ্নীলা, চৌধুরীপাড়া, খারাংখালী, লেদা, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া ও শাহপরীরদ্বীপের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সীমান্তের ২০টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। দালালচক্র বিজিবির টহলদলকে পাহারা দিয়ে গত তিনদিনে অন্তত ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে পার করিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে কিছু কিছু পরিবার বিজিবি পুলিশের হাতে আটক হয়েছে। অন্যরা ঢুকে পড়েছে উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে। ছোট ছোট নৌকায় করে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। ঘুমধুম নুরুল ইসলামের কলা বাগানে প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও বৃদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুরুল হাসান খান বলেন, সীমান্তে কোন রোহিঙ্গাকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। যেসব রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হয়ে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। মিয়ানমারের সীমান্তের অভ্যন্তরে শতশত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের জন্য জড়ো হয়ে রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়। শুক্রবার ভোর রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত মিয়ানমারের ৭৩ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের আটকপূর্বক স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হুঁশিয়ারি উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় বিজিবি, কোস্টগার্ড টহল জোরদারসহ অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে শনিবার দুপুরে টেকনাফ উপজেলা মিলনায়তনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক বিশেষ আলোচনা সভায় জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন জানান, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। এরা কোনভাবেই যেন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে। এজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক এবং নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে হবে। যারা রোহিঙ্গা পারাপার, অনুপ্রবেশে সহযোগিতা, আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং রোহিঙ্গাদের বহনকারী সিএনজি, টমটম গাড়িসহ যে কোন ধরনের যানবাহনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোপূর্বে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে সরকার। কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। তাই বার বার তাদের সেই সুযোগ দেয়া যায় না। এজন্য সীমান্তে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার জোরদার করতে বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়িত্ব পালনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সুশীল সমাজের ব্যক্তিদেরও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ভূমিকা অতি প্রয়োজন। ধেয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বক্তব্য মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সেনা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংগঠন আল-ইয়াকিন (আরসা) ক্যাডারদের ব্যাপক সংঘর্ষের কারণে পালিয়ে আসা মিয়ানমারে কুমিরখালীর রোহিঙ্গা নারী দিল জোহরা (৪০) জানান, আমাদের আত্মীয়স্বজন ও মেয়েদের মিয়ানমার সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যাচ্ছে ও মেয়েদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তাই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসেছি। রোহিঙ্গা আব্দু সালাম (৫০) জানান, আমার ছেলেকে সেনাবাহিনী সদস্যরা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে নিয়ে গেছে। মেয়েদের ধর্ষণ শেষে গলা কেটে ফেলে দিচ্ছে। পালিয়ে আসা অপর রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থানীয় যুবকদের হাত-পা বেঁধে প্রথমে মাথা নিচু করে রাখে। এরপর গুলি করে হত্যা করছে। সে দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে কিছু রাখাইন যুবক। তাদের অত্যাচার সেনাবাহিনীর চেয়েও জঘন্য বলে দাবি তাদের। রোহিঙ্গাদের ওপর বিভীষিকাময় নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে পালিয়ে আসা মোক্তার হোসেন জানান, মিলিটারি রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে অত্যাচার করছে, মা-বোনদের করছে পাশবিক নির্যাতন। ৯১ রোহিঙ্গা পুশব্যাক উখিয়া ও টেকনাফে অনুপ্রবেশকৃত ৯১ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। শনিবার রাতে ও রবিবার ভোরে সীমান্তের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের আটক করা হয়। উখিয়া থানার ওসি মোঃ আবুল খায়ের জানান, শনিবার রাতে নারী-শিশুসহ ৭১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিজিবি তাদের তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে পুশব্যাক করেছে রবিাবর। এছাড়াও টেকনাফের দমদমিয়া ও শাহপরীর দ্বীপ এলাকা থেকে ২০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে ফেরত পাঠানো হয়েছে মিয়ানমারে। এর আগে কোস্টগার্ড পুশব্যাক করেছে ৩১ জন ও বিজিবি ফেরত পাঠিয়েছে ১৪৬ জন রোহিঙ্গাকে। বিজিবি ডিজির সীমান্ত পরিদর্শন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি দেখতে রবিবার কক্সবাজারে গেছেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন। তিনি কক্সবাজার ও বান্দরবানের ঘুমধুম বরাবর মিয়ানমার সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট পরিদর্শন করেন। রবিবার দুপুরে কক্সবাজার এসে বিজিবি’র ডিজি ওখান থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে যান। সেখানে বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট পরিদর্শন করেন। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হওয়ায় দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। সীমান্ত এলাকার লোকজন জানান, ওপাশে হাজার হাজার নারী-পুরুষকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ক্রমাগত গুলির শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইনের সংঘাত ঘিরে কেউ সীমান্তের জিরো লাইন ক্রস করলে সমুচিত জবাব দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিজিবি মেজর জেনারেল আবুল হোসেন। মিয়ানমার বাহিনী এবং সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি এ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সীমান্ত পরিদর্শন শেষে রবিবার বিকেলে বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের ঘুমধুম বিওপিতে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন বিজিবি ডিজি। তিনি বলেন, সীমান্তের ওপার থেকে কোন লোকজন আমাদের এলাকায় আসতে পারবে না। যে কোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির বিপরীতে আমরা ইনশা আল্লাহ সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত। তিনি জোরালো কণ্ঠে বলেন, আমরা প্রস্তুত এবং পুরোপুরি প্রস্তুত। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডিজি আরও বলেন, আপনারা নিশ্চিত হতে পারেন আমাদের এখানে গোলাগুলি তথা আমাদের জিরো লাইন ক্রস করবে না। যদি করে থাকে আমরা সমুচিত জবাব দেব। সীমান্তে বিজিবির পদক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, সীমান্তে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত বিজিবি। বিজিবি আরও ১৫ হাজার সদস্য বাড়াবে। এর আগে বিজিবি ডিজি ঘুমধুম সীমান্তের জিরো লাইন পরিদর্শন করেন। তার মতে, মিয়ানমারের রাখাইনের সংঘাত থেকে বাঁচতে সেখানে বেশ কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। অন্যত্র স্থানান্তরের দাবী মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও বস্তি থাকায় ওপার থেকে কৌশলে রোহিঙ্গারা এসে ওসব বস্তিতে ঢুকে পড়ছে। কেউ কেউ ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম-গঞ্জে। আরএসও ক্যাডাররা, কতিপয় ধান্ধাবাজ নেতা ও এক শ্রেণীর দালাল ওই রোহিঙ্গাদের নিয়ে ফায়দা লুটছে। তারা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিভিন্নভাবে দীর্ঘায়িত করে চলছে। তাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজ দেশের অন্য যে কোন স্থানে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করে উখিয়া-টেকনাফ তথা কক্সবাজার জেলাকে রোহিঙ্গা মুক্ত করতে দাবি জানিয়েছেন। আল ইয়াকিন থেকে ‘আরসা’ শুক্রবার ভোর রাতে রাখাইনে সেনা ও পুলিশ পোস্টে হামলা, হত্যা ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় মিয়ানমার সরকার ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) নামে একটি সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠনকে দোষারোপ করছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরেও রাখাইনে মংডু কাউয়ারবিলে পুলিশ পোস্টে হামলার ঘটনায় সরকার দায়ী করেছিল ওই সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে। রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সশস্ত্র বহু সংগঠন রয়েছে। তবে আরসা’র আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী। তাদের দাবি কয়েক হাজার সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) গোষ্ঠীতে। এটির আগেকার নাম ছিল ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’। এদিকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলছে, সশস্ত্র ওই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রোহিঙ্গা জিহাদীরা মিয়ানমারকে অশান্ত করে তুলছে। ওই গোষ্ঠীর বেশির ভাগ জঙ্গী বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। সন্ত্রাসী ওই সংগঠনের নেতৃত্বে আছে ‘আতাউল্লাহ’ নামে এক রোহিঙ্গা। ঐ আতাউল্লাহ ‘আবু আমর জুনুনি’ নামেও পরিচিত। তার ঐ দলে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, আরসা নেতা আতাউল্লাহ বর্তমান পরিস্থিতি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সূত্র জানায়, সংগঠনটির নেতৃত্ব কাঁধে নিয়ে ২০১২ সালে মিয়ানমারে ঢুকে পড়ে আতাউল্লাহ ‘আবু আমর জুনুনি’ ও তার সহযোগীরা। ২০১০ সালে সৌদি আরবে বসবাসকারী ধনাঢ্য ৩০ রোহিঙ্গা নেতার পরামর্শে মক্কায় সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। নিজেদের মাতৃভূমি বার্মাকে (মিয়ানমার) স্বাধীন করতে তারা শপথ নিয়ে ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ সংগঠনটি গঠন করে। মোঃ আতাউল্লাহ সৌদি আরবের মাদ্রাসায় পড়ালেখা করলেও আরবি এবং বার্মিজ ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। সৌদিতে থাকা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে শিখেছেন মিয়ানমারের রাখাইন ভাষা। সশস্ত্র এ জঙ্গী গোষ্ঠীর ক্যাডারদের আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ রয়েছে বলে সূত্র দাবি করেছে। আরএসও, এআরইউ, এআরএনও, নোপাসহ বহু রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠন ইতোপূর্বে রোহিঙ্গাদের নামে বিদেশী সাহায্য এনে সামান্যটুকু বিলি-বন্টনের ভিডিও বিদেশে পাঠিয়ে সিংহভাগ ত্রান (নগদ টাকা) আত্মসাত করেছে। এজন্য ওসব সংগঠনের চেয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আল-ইয়াকিন (আরসা) সংগঠনটির প্রতি সমর্থন রয়েছে বেশি। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা ‘আরসা’ ইন্টারনেটে সম্প্রতি দেয়া এক বিবৃতিতে বলেছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় তারা কাজ করছে। বিশ্বের কোন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করা হয়েছে।
×