ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

৫ মে ২০১৩ হেফাজতে ইসলামের তান্ডব

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ২৮ আগস্ট ২০১৭

 ৫ মে ২০১৩ হেফাজতে ইসলামের তান্ডব

(গতকালের পর) এরা এ সময় সোনালী ব্যাংক ভবনের প্রধান ফটক ভেঙ্গে ফেলে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হেফাজতি সদস্যরা যাতে পুলিশ, র‌্যাব ও বিডিআর-এর সক্রিয়তার ফলে জসীম উদ্দীন রোড ও দক্ষিণে ইত্তেফাক মোড়ের দিকে বিস্তৃত সড়ক ধরে পিছু হটতে বা পালাতে পারে সে জন্য এ দুটি সড়ক খোলা রাখা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহসিক ও দৃঢ় পদক্ষেপের পরিচয় পেয়ে হেফাজত ঐ দুটি পিছু হটার পথ ধরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সমাবেশ থেকে এভাবে পালিয়ে যাওয়া হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে কয়েকশ’ মাদ্রাসার কিশোর ছাত্রকেও দেখা যায়। ফলত রাত ৩টার সময় আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী শাপলা চত্বরের পূর্ণাঙ্গ দখল নিতে সক্ষম হয়। রাত ৪.৩০-এর মধ্যে পুরো এলাকা হেফাজতীশূন্য হয়ে যায়। দক্ষিণ দিক দিয়ে পলায়নের পথে হেফাজতের কয়েকজন নেতা-কর্মী বঙ্গভবনের নিকটস্থ পিপলস ইন্স্যুরেন্স ভবনে লুকিয়ে থাকে। তারা সেই ভবনের সামনে একজন পুলিশের হাবিলদারকে তার দল থেকে একটু এগিয়ে থাকা অবস্থায় আক্রমণ করে। পুলিশের এই সদস্য পরে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে মারা যান। পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যবৃন্দ এ সময় শাপলা চত্বরের চারদিকের স্থাপনা থেকে আহত হেফাজতীদের ও ছাত্রশিবিরের কর্মীদের ছাদ থেকে নামতে সহায়তা করে সহৃদয়তার পরিচয় দেন। পুলিশ ও র‌্যাবের অফিসার এবং সদস্যদের সাহস ও কর্তব্যবোধের কাছে হেফাজতীরা পরাজয় স্বীকার করে। এই অভিযানে সশস্ত্র পুলিশ ব্যাটেলিয়ানের একজন এসআইসহ ৮ জন বিক্ষোভকারী মারা যায় বলে জানা যায়। হেফাজতীরা কর্তব্যরত একজন পুলিশ সার্জেন্ট ও ২ জন কনস্টেবলকে পিটিয়ে মারাত্মœকভাবে আহত করে। এই রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণের অভিযোগে পুলিশ ৬৫ জনকে গ্রেফতার করে। আমি গ্রেফতারকৃত সকলের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যথা প্রযোজ্য আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ, লুটপাট ও হত্যার মামলা দায়ের করার নির্দেশ দেই। গ্রেফতারকৃত বিক্ষোভকারীদের মধ্যে জুনায়েদ বাবুনগরীও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। হেফাজতীদের এই তা-বলীলায় সেই দিন ও রাত ওই এলাকার হকার এবং ব্যবসায়ীদের প্রায় ১৮ কোটি টাকা লোকসান হয় বলে বায়তুল মোকাররম এলাকার ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন। সব ধরনের লোকসান হিসাবে নিয়ে দেখা যায় যে, হেফাজতীদের এই উচ্ছৃঙ্খল সমাবেশ রাষ্ট্রের ও জনগণের প্রায় ৬০ কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছিল। ৬ মে ভোর ৪.৩০-এর দিকে মতিঝিল ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় সর্বত্র পরিস্থিতি পূর্ণাঙ্গভাবে নিয়ন্ত্রণ ও শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত মজেনা আমার বাসায় ছুটে এসে আমাকে অভিনন্দন জানান। সকাল ৭টার দিকে আমি নিজে বায়তুল মোকাররম থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় হেফাজতীদের তা-বলীলা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। আমার মনে দৃঢ় প্রতীতি জন্মে যে, এসব হেফাজতী ও তাদের অনুসারীদের দেশ বা জনগণের প্রতি কোন আনুগত্য নেই। আমি নিঃসন্দেহ হই, হেফজতীদের ৫ তারিখের বিক্ষোভ ও সমাবেশ যদি এভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং দমন না করা যেত তা হলে সারাদেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। এতদসত্ত্বেও বিএনপি এবং অন্যান্য স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী হেফাজতীদের সমর্থন করে বিবৃতি দেয় এবং বিক্ষোভের কর্মসূচী গ্রহণ করে। ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা বলেন যে, শাপলা চত্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কত নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন তা নির্ধারণ করার জন্য বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি নিয়োগ করবে। বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নয়াপল্টনে সহযোগী ১৮ দলসহ শাপলা চত্বরে তাদের কথিত হেফাজতে ইসলামীর নিহত কর্মীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে গায়েবানা জানাযা আদায় করে। আমার নির্দেশে এখানে বেআইনী সমাবেশ ও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন বাধা দেয়নি। নির্ভেজাল মিথ্যার মোড়কে মৃত ব্যক্তিদের জানাজা সত্যাশ্রয়ী ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আদায়করণ ধর্মশিক্ষা অনুগামী কিনা তা তারা অবশ্য খতিয়ে দেখেনি। জোটের এই জানাজা ও সংশ্লিষ্ট কর্মসূচীতে যোগ দিয়ে বিকল্প ধারার প্রধান অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ৩ দিনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেআইনী কর্মকা- শনাক্তকরণের লক্ষ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি করেন। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকীও গামছা গলায় এই জানাজায় যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন যে, ৫ মের নির্মম হত্যাকা- বিনা প্রতিবাদে ও বিনা বিচারে মেনে নেয়া যায় না। সাদেক হোসেন খোকা মিথ্যার বেসাতি করে দাবি করেন যে, বিবিসি ও সিএনএন-এর খবর অনুযায়ী ৫ ও ৬ মে রাতে শাপলা চত্বরে ৩০০০ এর বেশি নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন (দ্রষ্টব্য, প্রথম আলো ৭.৫.২০১৩)। অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে বলেন যে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ জোটের শরিকরা হেফাজতের ৫ ও ৬ মের সেই সমাবেশের নিয়ন্ত্রণ ৫ মে দুপুর থেকেই গ্রহণ করেছিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবুনগরী পুলিশের কাছে স্বীকার করেন যে, সেদিন রাতে যা কিছু করা হয়েছে তা বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে ও চাপেই করা হয়েছে। বিদিত হয়েছে যে, বিএনপি ঘরানার ১৮ দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত ৪টি দল যথা ইসলামী ঐক্যজোট, নিজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস ও জামায়াতে ওলামা ইসলাম হেফাজতে ইসলামের সহযোগী। এর বাইরে ১৮ দলীয় জোটের পক্ষে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া দায়িত্বহীনতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করেছিলেন। এই সমর্থন দেয়ার সময় তিনি সকল ঢাকাবাসীকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে হেফাজতের অনুকূলে এগিয়ে আসার ডাক দেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিএনপি ঘরানার ডক্টরস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট এলাকায় কেবল হেফাজত কর্মীদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করে। তাদের এই পক্ষপাতমূলক সেবা কাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বাধা দিতে আমি নিষেধ করি। ১৮ জোটের কথা অনুযায়ী সেই রাতে যদি ৩০০০ লোক মারা যেত তাহলে তাদের মা-বাবা ও আত্মীয়রা তাদের লাশ নিতে বা খোঁজ করতে শাপলা চত্বরে বা হাসপাতালে জমায়েত হতেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ প্রকাশ্যে তখন বলেছেন যে, বিএনপি কথিত হাজার হাজার লোক সে রাতে মারা গেলে লাখ লাখ স্বজন জমায়েত হওয়ার কথা। যেহেতু তেমন কেউ লাশ শনাক্ত করতে আসেননি, সেহেতু এই অভিযানে অনেক লোক মারা গেছে বলে বিশ্বাস করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই (দ্রষ্টব্য: প্রথম আলো ৬.৫.১৩)। ৬ মে সকালে শাপলা চত্বর অবমুক্ত হওয়ার পর বিএনপি তার চিরাচরিত জনস্বার্থবিরোধী কর্মসূচীর আওতায় ৮ ও ৯ মে তাদের ভাষায় সরকার কর্তৃক শাপলা চত্বরে গণহত্যা চালানোর প্রতিবাদে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে। বিএনপির তরফ থেকে তাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন যে, শাপলা চত্বরে হাজার হাজার আলেমকে হত্যা করে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের মাথা নত করা হয়েছে। চলবে... লেখক : সাবেক সচিব ও মন্ত্রী
×