ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রকথন

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ২৮ আগস্ট ২০১৭

সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রকথন

‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?’- কবি তার কাব্যিক স্বাধীনতায় চাঁদকে বেনোজলে ভাসিয়ে দিতেই পারেন। আর তা শুনে হৈ হৈ করে ওঠা বিজ্ঞানীরা বলতেই পারেন, ‘এ কেমন ভাবনা কবি? চাঁদ ভাসিয়ে দেয়া! স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচার! কি হবে তবে পৃথিবীর!’ কাব্যিক চেতনার স্বাধীনতা আর যুক্তির লড়াই চলতে থাকুক। আমরা পা রাখি বাস্তবতায়। বাস্তবতা হলো একেবারে ভেসে না গেলেও জন্মলগ্ন থেকেই একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে চাঁদ তার প্রিয়তম পৃথিবী ছেড়ে। বর্তমানে এই সরে যাওয়ার পরিমাণ প্রতি বছর ৩ দশমিক ৮৭ সেন্টিমিটার। অন্যভাবে বলা যায়, প্রতি বছর আমাদের হাতের নখ যতটা বাড়ে ঠিক ততটা দূরে সরে যাচ্ছে চাঁদ। চাঁদের এই সরে যাওয়া সরাসরি প্রভাব ফেলে সূর্যগ্রহণে। সে দিন দূরে নয় যে, সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা কোন গ্রহণকে আর গ্রহণ করবে না আমাদের পৃথিবী। সূর্যগ্রহণ ও অতীতকথন প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ভয় ও কৌতূহল ভরা চোখে তাকিয়েছে আকাশ পানে। একালে গ্রহণের কারণ পৃথিবীবাসীর কাছে স্পষ্ট। কিন্তু ভাবা যাক সেই মানুষগুলোর কথা, কোন কারণ না জেনেই যারা দিনের আলোতে হারিয়ে যেতে যেতে দেখল সূর্য। হঠাৎ করেই ভরদুপুরে নেমে এলো অন্ধকার। প্রাচীন চীনজুড়ে সে মুহূর্তে চিৎকার, ‘ড্রাগন খেয়ে নিচ্ছে সূর্য।’ কেবল অতীতের চীনে নয়, সুপ্রাচীন মায়া সভ্যতায়ও প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে, সূর্যগ্রহণের সময় ড্রাগন খেয়ে নেয় সূর্য। যেমন আজটেক সভ্যতায় বলা হতো চন্দ্রগ্রহণের সময় খেয়ে নেয়া হয় চাঁদের এক টুকরা। প্রতিটি প্রাচীন সভ্যতায় সূর্য পেয়েছে দেবতার আসন। লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির এ্যাস্ট্রনমির অধ্যাপক ব্র্যাডলে শেফার বলেন, প্রাচীন মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল মহাকাশ। সে কারণে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সেখানে বাস করেন দেবতারা। আর সূর্যগ্রহণ মানেই ‘দেবতার মৃত্যু’। সূর্যগ্রহণ ও এই ভীতির প্রমাণ পাওয়া যায় ২৩০০-১৮০০ খ্রিষ্টপূর্ব মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মাটির ফলকে। তারা বিশ্বাস করত যদি সূর্যগ্রহণ হয় মারা যাবেন তাদের রাজা। আর রাজা শাসিত সমাজে এরচেয়ে বড় কোন বিপর্যয় ভাবা যেত না। তাই সম্ভাব্য মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে রাজা রাজপ্রাসাদে বাস করতেন কৃষকের ছদ্মবেশে। রাজমুকুট পরিধান করতেন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। এই প্রক্রিয়াটি চলত সূর্যগ্রহণের সম্ভাব্য ১০০ দিনকে মাথায় রেখে। সঙ্কট পেরিয়ে গেলে রাজা আবার ফিরে যেতেন মসনদে। তবে ব্যতিক্রম হয়েছিল একবার, ১৮৫০ খ্রিষ্টপূর্বে। কৃষকবেশী রাজার মৃত্যুতে সাজাপ্রাপ্ত আসামি স্থায়ী হয় সিংহাসনে। প্রচলিত কুসংস্কারে প্রথম আঘাত হানেন গ্রীক দার্শনিক এন্থাগোরাস, খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ শতকে। তিনি প্রথম বলেন, ‘সূর্যকে কেউ খেয়ে ফেলে না বা এটি কোন ঐশ্বরিক কীর্তি নয়।’ তিনি পদার্থবিদ্যা আর প্রাকৃতিক নিয়মের যোগসূত্রের কথা বলেন। আজ তাকে সূর্যগ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পথ প্রদর্শক বলা হলেও নিজ সময়ে তাকে বরণ করে নিতে হয় নির্বাসন দ-। নিসিয়াস সূর্যগ্রহণকে অভিহিত করেন, ‘ব্যাড ওমেন’ বলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যগ্রহণের ধারণাটি পরিষ্কার হয়েছে। ২০০০ বছর পূর্বে গ্রীকরা প্রায় নির্ভুলভাবে সূর্যগ্রহণের সময় আন্দাজ করতে পারত। তবে সময় লেগেছে ভীতি দূর হতে। মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূর্যগ্রহণ হিসাবে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেন ১৮৭৮ সালের ওয়াইল্ড ওয়েস্টের সূর্যগ্রহণকে, যার সাক্ষী ছিলেন তরুণ আলফা এডিসন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৮ সালের মে মাসে সূর্যগ্রহণ সুযোগ করে দিয়েছিল এ্যালবার্ট আইনস্টাইনের একটি তত্ত্ব প্রমাণের, যা তিনি প্রণয়ন করেন ১৯০৫ সালে। সে সময়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেন ইংরেজ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন। তারপর গত সোমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ উঠে এলো আলোচনা ও কৌতূহলের কেন্দ্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবারের সূর্যগ্রহণ সূর্যগ্রহণ হয় মূলত পৃথিবী আর তার একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের কারণে। সূর্যকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবী আর পৃথিবীকে চাঁদ। এই ঘূর্ণনের পথ বৃত্তাকার নয়, কিছুটা চ্যাপ্টা। এ কারণেই পৃথিবী থেকে চাঁদকে কখনও কখনও সূর্যের চেয়ে বড় দেখায়। ফলে চাঁদ পুরো ঢেকে দিতে পারে সূর্যকে। আবার কখনও চাঁদের চেয়ে বড় লাগে সূর্যকে। তখন আর চাঁদের পক্ষে সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়া সম্ভব হয় না। চাঁদ তার চলার পথে বছরে দুবার সূর্যের সামনে দিয়ে যায়। সে সময় পৃথিবী আর সূর্যের মাঝে সরলরেখায় দাঁড়ানো চাঁদের কারণে হয় পূর্ণগ্রাস বা বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ। আর ঠিক সরলরেখায় না হলে হয় সূর্যের খ-গ্রাস। আর আছে সংকর গ্রাস। অর্থাৎ কোথাও যখন দেখা যাচ্ছে পূর্ণগ্রাস তখন অন্যত্র হচ্ছে বলয়গ্রাস। সূর্যগ্রহণে চাঁদের পেছনে যে অংশটা পুরো ঢেকে যায় তাকে বলে ‘আমব্রা’ আর দু’পাশের আলোছায়া অংশগুলোকে বলে ‘পেন আমব্রা’। ১৯১৮ সালের পর এবার আমেরিকায় দেখা গেল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। নাসার মতে, এটি বিরলতম সূর্যগ্রহণ। চাঁদের ছায়ায় এবার পুরোপুরি মুখ ঢেকেছিল সূর্য। ৯৯ বছর পর পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা সাক্ষী হয়ে রইল এই বিরল দৃশ্যের। শুরুটা ওরেগনে, আমেরিকার স্থানীয় সময় দুপুর ১টায়। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকাজুড়ে। স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যায় সাউথ ক্যারোলিনায়। আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্বে দেখা যায় সূর্যের খ-গ্রাস। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমেরিকায় পরবর্তী পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে ২০২৪ সালের ৮ এপ্রিল। প্রায় সাড়ে চার মিনিটের এই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা ও পূর্ব কানাডায়। কেবল বিজ্ঞানীগণ নন, আমেরিকাজুড়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল এবারের গ্রহণ। ডিপো বে, অরিগনে মাঝদুপুরে ঝুপ করেই নেমে এলো অন্ধকার। গ্রীষ্মের বাতাসে শীতের ছোঁয়া। যেন নেমে এসেছে রাত্রি। শুক্রসহ তারাজ্বলা আকাশ। ভয়ার্ত চিৎকার ছেড়ে আকাশে উড়ছে সী’গাল। উপস্থিত সবার জানা ছিল কী হতে যাচ্ছে। তারপরও নিজ অনুভূতি প্রকাশে বাক্য খুঁজে বেড়াতে হয়েছে তাদের। ১৪ রাজ্যে এ গ্রহণ পরিষ্কার দেখা যাবেÑ বাজি ধরেছিলেন যে বিজ্ঞানী, আবহাওয়া তাকে নিরাশ করেনি। সূর্যগ্রহণ নিয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ জে প্যাসকফ বলেন, ‘এ দৃশ্য ছিল সত্যিই নিখুুঁত।’ তাই বলে সব রাজ্যের দর্শকরা অতটা ভাগ্যবান ছিলেন না। সাউদার্ন ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল স্টেডিয়ামে উপস্থিত ১৪০০০ দর্শক দেখেছেন মেঘ আর গ্রহণের লুকোচুরি খেলা। রোদের আকাশে হঠাৎ করেই ঘন মেঘের আনাগোনা। দর্শকদের ব্যাকুল প্রার্থনা মেঘ সরে যাক। একেবারে শেষ মুহূর্তে তাদের প্রার্থনা শুনেছেন ঈশ্বর। কয়েক মুহূর্তের জন্য তারা দেখেছেন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের বিরল দৃশ্য, যেটিকে তারা মানছেন তাদের জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত বলে। এবারের গ্রহণ ছুঁয়ে গেছে ৫০ রাজ্য। নিউইয়র্কে দেখা গেছে ৭০% সূর্যগ্রহণ। হোয়াইট হাউসের ট্রুম্যান ব্যালকনি থেকে ৮১% গ্রহণ দেখেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, পত্নী ম্যালেনিয়া ও পুত্র ব্যারন। কোন রকম রোদ চশমা ছাড়াই খালি চোখে প্রেসিডেন্টের প্রথম দর্শন। পরে অবশ্য রোদ চশমা ব্যবহার করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস থেকে মেইনে পরবর্তী সূর্যগ্রহণ এপ্রিল ৮, ২০২৪। চাঁদের সরে যাওয়া, সঙ্কটে গ্রহণ আমরা যতই নিজের কলঙ্ক ঢাকার চেষ্টা করি চাঁদের কলঙ্কের কথা বলে, চাঁদ কিন্তু অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর জন্য। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর জন্ম ৪৫০ কোটি বছর আগে। চাঁদের জন্ম তারও ৫০ বছর পরে। তখন পৃথিবী থেকে চাদের দূরত্ব ছিল সাড়ে বাইশ হাজার কিলোমিটার। বলা যায় হাতের নাগালে। আজ পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব জন্মলগ্নের ১৮ গুণ। চাঁদের এই দূরে সরে যাওয়ার কারণেই বেড়ে গেছে দিনের দৈর্ঘ্য। সাড়ে চার শ’ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে দিনের দৈর্ঘ্য ছিল সাড়ে ছয় ঘণ্টা। ৩শ’ কোটি বছর আগে ৮ ঘণ্টা। ৬২ কোটি বছর আগে দিনের দৈর্ঘ্য বেড়ে দাঁড়ায় ২২ ঘণ্টায়। আজ থেকে ৬৫ কোটি বছর পর দিনের দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ২৭ ঘণ্টায়। এটা আজ প্রমাণিত যে, চাঁদ আছে বলেই অনেক বেশি দিনের আলো দেখছে পৃথিবী। পৃথিবীর ঘূর্ণন খুব জোরে হলে দিন বা রাত দুটোর দৈর্ঘ্যই যেত কামে। চাঁদ তার অভিকর্ষ বলের প্রভাবে এই ঘোরার গতি কমিয়ে রেখেছে এতদিন। আর এখনও দূরে চলে যেতে যেতে সে তার কাজ করে যাচ্ছে যথাযথ। বর্তমান পৃথিবীতে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয় ২৮%। কিন্তু ৪শ’ কোটি বছর আগে যখন চাঁদ জন্মাল, তখন এই গ্রহণ ছিল ৫০%। ৫০ কোটি বছর পরে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে মাত্র ২%। ৬৫ কোটি বছর পরে পৃথিবীতে থাকবে না কোন গ্রহণ। পৃথিবী সর্বশেষ পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখবে ৫৭ কোটি বছর পর। আর এজন্য দায়ী অভিমানী চাঁদের ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাওয়া। আরেকটি দিক হলো, চাঁদই কিন্তু পৃথিবীকে তার কক্ষপথে ২২.১ ডিগ্রী ঝুলিয়ে রাখত। চাঁদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে পৃথিবী তার কক্ষপথে ঝুঁকে পড়বে ২৪ ডিগ্রী। সেদিন দূরে নয় সময়ের সঙ্গে দিনের আয়ু যাবে বেড়ে। কমে যাবে জোয়ার-ভাটার টান। নিশ্চিতভাবেই লম্বা ক্লান্তিকর রোদ ঝলসানো দিনে চাঁদের বিরহে নতুন কবিতা লিখবে কবি। রাতের অন্ধকার গাঢ় হবে আরও। যারা আঁধারে ভয় পান তারা সেই অন্ধকার কল্পনায় জপতে পারেন ইষ্টনাম। আর এভাবেই একদিন সূর্যের গ্রাসে চলে যাবে চাঁদ। প্রায় ৫শ’ কোটি বছর ধরে সূর্যের মুখ ঢেকে দেয়ার যে বেয়াদবি তার বদলা নেবে সূর্য। চাঁদের কারণেই কমে আসতে পারে বছরে দিনের সংখ্যা। কে জানে হয়ত হারিয়ে যাবে কোন মহামানবের জন্মদিনটি। পাঁজি-পুঁথি, দিনপঞ্জিকার হিসাব যাবে বদলে। সংস্কার-কুসংস্কার নিয়ে ব্যবসায়ীরা করবেন হায় হায়। চাঁদি ঝলসানো রোদের নিচে দাঁড়িয়ে মানুষ ক্ষমা চাইবে চাঁদের গায়ে কলঙ্ক লেপনের। বিরহী কবির দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে উঠবে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস। তবে আশার কথা, কবির কাব্যিক চেতনাগত স্বাধীনতায় বাধা প্রদানকারী বিজ্ঞানীরা হয়ত কবিকেই পাঠিয়ে দেবেন চাঁদে বসত করতে। বিজ্ঞান যে গতিতে এগোচ্ছে তাতে আশা করাই যায় বিজ্ঞানীরা হারাতে দেবেন না চাঁদকে। নিশ্চয়ই তারা কোন ব্যবস্থা করবেন। হাতে সময়ও আছে ৬৫ কোটি বছর। আশাবাদী হতে দোষ কী? মানুষের সম্ভাবনা তো অপার। লেখক : সাংবাদিক
×