ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিকেটার সানির সেই স্ত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টার নেপথ্যে-

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৭ আগস্ট ২০১৭

ক্রিকেটার সানির সেই স্ত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টার নেপথ্যে-

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আলোচিত ক্রিকেটার আরাফাত সানির আত্মহত্যা চেষ্টাকারী স্ত্রীর জ্ঞান ফিরেছে এবং তিনি এখন কেবিনে আছেন। অচেতন অবস্থায় তাকে ধানমণ্ডির রেনেসাঁ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছিল। শনিবার বিকেলে জ্ঞান ফিরলে তাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বলে নাসরিন সুলতানার ছোট বোনের দাবি। তবে সানির পরিবারের দাবি, আরেক স্ত্রীকে তালাক দিতে রাজি না হওয়ার জের ধরে ঘটনাটি ঘটতে পারে। ধানম-ি মডেল থানার ওসি আব্দুল লতিফ জনকণ্ঠকে জানান, ক্রিকেটার আরাফাত সানির স্ত্রী নাসরিন সুলতানা মোহাম্মদপুর থানা এলাকার বাসিন্দা। তিনি সেখানকার একটি বাসায় থাকেন। বৃহস্পতিবার রাতে মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে তারই পরিবারের সদস্যরা। রাতেই তাকে অচেতন অবস্থায় ধানম-ি থানাধীন রেনেসাঁ হাসপাতালের আইসিইউতে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের প্রাণান্তকর চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত শনিবার বিকেলে তার জ্ঞান ফেরে। বিকেলেই তাকে হাসপাতালটির একটি কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে আরাফাত সানির স্ত্রী সম্পূর্ণ আশঙ্কামুক্ত। এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ করা হয়নি। অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে বিষয়টি তারা নজরদারির মধ্যে রেখেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে সজাগ আছেন বলে জনকণ্ঠকে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার। এদিকে নাসরিন সুলতানার ছোট বোন শারমিন সুলতানা সাংবাদিকদের জানান, তার বোন পারিবারিক কলহের জের ধরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে বোনজামাই আরাফাত সানির সঙ্গে বাগ্বিত-ার এক পর্যায়ে তার বোন রাগ করে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। রাতেই তাকে দ্রুত রেনেসাঁ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ব্যাপারে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জনকণ্ঠকে জানান, আরাফাত সানির স্ত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টার বিষয়ে শনিবার বিকেল পর্যন্ত কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পাওয়া গেলে আইন মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে আরাফাত সানির ভাই ফয়সাল জনকণ্ঠকে বলেন, আরাফাত সানি আদালতের নির্দেশে নাসরিন সুলতানাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়। সে মোতাবেক আরাফাত সানি দুই স্ত্রীর সঙ্গেই বসবাস করে আসছে। কিন্তু নাসরিন সুলতানা বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না। তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা সানিকে তার বাড়িতে থাকা আরেক স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন। কিন্তু সানি তাতে রাজি নয়। তারই জের ধরে সানির সঙ্গে নাসরিন সুলতানার পারিবারিক কলহ চলছে। সেই কলহের জের ধরেই নাসরিন সুলতানা আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি নাসরিন সুলতানা তথ্য-প্রযুক্তি আইনে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় আরাফাত সানির বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল, সাত বছর আগে পরিচয়ের পর সানির সঙ্গে তার প্রেম হয়। ২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বরে তারা পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করেন। বিয়ের বিষয়টি পরিবারকে জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেয়ার কথা থাকলেও সময় ক্ষেপণ করছিল সানি। স্ত্রী হিসেবে তাকে তুলে নিতে চাপ দিলে সানি ফেসবুকে একটি ভুয়া এ্যাকাউন্ট খুলে ম্যাসেঞ্জারে তাদের কিছু অন্তরঙ্গ ছবি পাঠিয়ে নানাভাবে তাকে হুমকি দিচ্ছিল। এ মামলায় সানিকে একদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পরবর্তীতে নাসরিন যৌতুকের দাবিতে মারধরের অভিযোগ এনে সানির বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে আরেকটি মামলা দায়ের করেছিলেন। ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনে করা ওই মামলায় ২০ লাখ টাকা যৌতুক না দেয়ায় নাসরিনকে মারধর করার অভিযোগ আনা হয়েছিল সানির বিরুদ্ধে। সানির সঙ্গে বিয়ের পর নাসরিনকে নিয়ে তারা বাসা ভাড়া নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করেছেন। একসঙ্গে তারা বিদেশে বেড়াতেও গিয়েছিলেন। থানায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ ইয়াহিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, আরাফাত সানির বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তদন্তে সানির দোষ প্রমাণিত হয়। পরে দাখিলকৃত চার্জশীটে সানিকে অভিযুক্ত করা হয়। আর যৌতুকের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়। আদালত ওই মামলায় সানিকে স্ত্রী হিসেবে নাসরিন সুলতানাকে মেনে নেয়ার আদেশ দেন। সেই আদেশ মোতাবেক সানি স্ত্রী নাসরিনের সঙ্গে বসবাস করছেন। পাশাপাশি আগের স্ত্রীর সঙ্গেও সানি বসবাস করে আসছেন। মামলা চলাকালে নাসরিন পরিবারের সঙ্গে মোহাম্মদপুরের ১১০ নম্বর কাঁটাসূরের বাড়িতে বসবাস করতেন। তিনি মোবাইল ফোনে জনকণ্ঠকে বলেছিলেন, ২০০৯ সালে এক বন্ধুর মাধ্যমে আরাফাত সানির সঙ্গে তার পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম। দীর্ঘ দিন প্রেম করেন। দেশে এবং দেশের বাইরে দু’জনে ঘুরেছেন। সর্বশেষ তারা থাইল্যান্ড ঘুরেন। তাদের দু’জনের ভিসা একসঙ্গে লাগানো। ২০১৫ সালে তিনি একবার আরাফাত সানির বাড়িতে যান। তখন সানির মা তাকে বাড়ি থেকে মারধর করে বের করে দেন। বাড়িতে না গেলে সানি যে বিবাহিত, তা হয়তো কোনদিনই তিনি জানতেন না। জন্মসূত্রে সানি ঢাকা জেলার সাভার থানাধীন আমিনবাজারের সোজানগরের সরকার বাড়ি এলাকার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের জি ব্লকের ১/২ নম্বর সড়কের ৫৪ নম্বর বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। তার পিতার নাম আব্দুর রহিম (মৃত)। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। মা নারগিস বেগম গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সানি দ্বিতীয়। সানির পরিবার জানায়, স্থানীয় মিরপুর মফিদ-ই-এম স্কুল এ্যান্ড কলেজের স্কুল শাখার দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। ২০০৩ সালে তার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্রিকেটের কারণে তার আর পড়াশোনা হয়নি। সানির মা নারগিস আক্তার জনকণ্ঠকে জানান, ২০১৫ সালে একবার একটি মেয়ে এসেছিল। তখন বিষয়টি বুঝতে পারেননি। মামলা করার পর তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন। ওই সময় কোন ঝামেলা হয়নি বলেও তিনি দাবি করেন। আরাফাত সানির স্ত্রী আফসানা জনকণ্ঠকে জানান, তার বাড়ি আমিনবাজারের পাশের বড়দেশী গ্রামে। ২০১০ সালের ২০ জানুয়ারি পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে তার চমৎকার সম্পর্ক। প্রায় দুই বছর আগে একজন নারী তাকে ৪/৫ বার ফোন করেছিল। ফোনে দু’জনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছিল। মামলা দায়েরের পর তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন। স্বামীর ভুলকে তিনি ক্ষমা করে স্ত্রী হিসেবে বসবাস করছেন। তবে সানির পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের অভিযোগ, এমন ঘটনার জন্য মূলত সানিই দায়ী। কারণ সানির সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেম হয়েছে। বিয়ে করেছে। তারা একত্রে দেশ বিদেশে ঘুরেছে। সেটি হতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই। সানির উচিত ছিল পবিরারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা। আলোচনা করলে হয়তো সানিকে আজ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না। কারণ সানির সঙ্গে যখন আফসানার বিয়ে হয়, তখন সানি নাসরিন সুলতানার সঙ্গে থাকা প্রেমের বিষয়ে তার ও আফসানার পরিবারের কাউকে কিছুই জানায়নি। আবার একই ঘটনা ঘটিয়েছে নাসরিন সুলতানাকে বিয়ে করার সময়। নাসরিন সুলতানাকেও আফসানা নামের আরেক মেয়েকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করার বিষয়টি জানায়নি। যে কারণে এখন তিন পরিবারে কলহের সৃষ্টি হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলে বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে অভিষেক হয়েছিল সানির। দেশের হয়ে সর্বশেষ তিনি ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেন। তার আগে ২০১৫ সালের নবেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে দেশের হয়ে শেষ ওয়ানডে খেলেন। বর্তমানে তিনি শর্তসাপেক্ষে ঘরোয়া ক্রিকেটে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে অংশ নিয়েছিলেন।
×