ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘অপারেশন কিলিং’

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৭ আগস্ট ২০১৭

‘অপারেশন কিলিং’

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গাদের জঙ্গী ও ‘বাঙালী’ আখ্যা দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যজুড়ে যে রক্তাক্ত সেনা অভিযান গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হয়েছে তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। সেনাবাহিনীর এ অভিযানকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন কিলিং’ নামে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। সেনা অভিযানে মৃতের সংখ্যা দু’শতাধিক ছাড়িয়ে গেলেও মিয়ানমার সরকারপক্ষে এ সংখ্যা ৯৩ বলে স্বীকার করা হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রাণহানি ও দেশত্যাগের সংখ্যায় ভিন্নতা রয়েছে। কারণ সঠিক ঘটনা জানতে মিয়ানমার সরকার রাখাইনে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রেখেছে আগে থেকে। গত বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান শুরুর আগ থেকে রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি অঞ্চলে প্রথমে সেনা মোতায়েন ও পরে সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত কারফিুউ জারি করা হয়। কারফিউ বলবৎ থাকাবস্থায় এবং বর্তমানে এমনকি দিনে-দুপুরেও রোহিঙ্গাবিরোধী সামরিক অভিযানে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল পরিণত হয়েছে অগ্নিগর্ভে। সে দেশের সেনা সদস্যরা রোহিঙ্গাদের দেখলেই গুলি করছে। আবার কখনও তাদের ওপর বর্বরতম নির্যাতন চালাচ্ছে। সীমান্তের ওপারে গুলি ও মর্টার শেল বর্ষণের শব্দ সীমান্তের এপারে শোনা যাচ্ছে। এমনকি আকাশে হেলিকপ্টার টহলও পরিলক্ষিত হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ এলাকা থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যন্ত সীমান্ত এলাকাজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে। নিরাপত্তা জোরদারে বিজিবি সদস্য মোতায়েন বাড়ানো হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর শনিবার বাংলাদেশ সীমান্তে তুমব্রু বরাবর মিয়ানমার অভ্যন্তরে জিরো লাইনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে অপেক্ষারত রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি চালিয়েছে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। শনিবার দুপুর ১২টা নাগাদ নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ক্যাম্পের অদূরে সাধারণ মানুষের বসতি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। দুপুরের এ ঘটনার পর বিকেল ৩টা নাগাদ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার ঘুমধুম বরাবর মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়ায় অবতরণ করে। এর ঘণ্টাখানেক পর সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সেনা সদস্যরা আবারও গুলিবর্ষণ শুরু করে। শনিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত সে দেশের সীমান্ত এলাকা প্রকম্পিত হতে থাকে। এ ঘটনায় কোন হতাহতের খবর শনিবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান জানিয়েছেন, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির গুলিবর্ষণের ঘটনায় তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানানো হয়েছে বিজিবির পক্ষে। জবাবে বিজিপি ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছে। অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান আরও জানান, সীমান্তে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তিনি জানান, গুলিবর্ষণের ঘটনায় সীমান্ত এলাকার এপারের লোকজনের আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। বিজিবি সদস্যরা রয়েছে সার্বক্ষণিক সতর্ক অবস্থায়। তিনি আরও জানান, শনিবার ভোর থেকে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়াসংলগ্ন এলাকার নোম্যান্স ল্যান্ডে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা সদস্য অবস্থান নিয়েছে। বিজিবির কড়া প্রহরার কারণে তারা অবৈধভাবে প্রবেশ করতে পারছে না। বিজিবি সূত্র জানায়, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ কক্সবাজার সেক্টরের অধীনে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা মোট ১৩৪ কিলোমিটার। তন্মধ্যে স্থলসীমান্ত ৮০ কিলোমিটার ও জলসীমান্ত রয়েছে ৫৪ কিলোমিটার। আর কক্সবাজার বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধীনে বিওপির (বর্ডার আউট পোস্ট) সঙ্গে মিয়ানমারের স্থলসীমান্ত হচ্ছে ২৫ কিলোমিটার। রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের সমূলে বিতাড়িত করার প্রকাশ্য তৎপরতা চলছে বছরের পর বছর। ফলে গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে একদিকে যেমন প্রাণ হারিয়েছে অগণিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা, তেমনি বাস্তুভিটাছাড়া হয়েছে লাখ লাখ। এর মধ্যে সরকারী হিসাবে বাংলাদেশে আশ্রিত ও শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক। কিন্তু বেসরকারী পর্যায়ে এ সংখ্যা ইতোমধ্যে ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। গেল বছরের অক্টোবর মাসে সেনা অভিযানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে প্রায় ৯০ হাজার। গত বৃহস্পতিবার থেকে নতুন করে সেনা অভিযানে শনিবার পর্যন্ত সীমান্ত গলিয়ে এসেছে তিন হাজারেরও বেশি। এদের অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছে টেকনাফ-উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ও টালগুলোতে (বস্তি)। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের আনান কমিশনের রিপোর্ট পেশের চার ঘণ্টার মধ্যে রাত থেকে সশস্ত্র সেনা অভিযান শুরু হয়ে যায়। সেনা, পুলিশ, বিজিপি ও দুর্বৃত্তদের হিংস্র ছোবলে একের পর এক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের লাশ পড়ে। তবে মিয়ানমার সরকার বলেছে, আনান কমিশনের রিপোর্ট পেশের পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জঙ্গী সদস্যদের হামলায় আক্রান্ত হয় ৩৪টি পুলিশ চৌকি ও একটি সেনা ব্যারাক। এরপরই সেনা অভিযান শুরু হয়। সীমান্তের ওপার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সেনা অভিযানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। হেলিকপ্টার থেকে নিক্ষিপ্ত মর্টার শেলে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। রাখাইন রাজ্যে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন ও নির্যাতন শুরু হওয়ায় জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এ ঘটনার নিন্দা জানানো হয়েছে। পাশাপাশি সে দেশের সেনা-বিজিপির যৌথ অভিযান বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ ও আসিয়ানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মালয়েশিয়ার বেসরকারী সংস্থা ‘মাফিম’। মাফিমের সভাপতি মোঃ আজমি আবদুল হামিদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের উগ্র মৌলবাদীদের যৌথ হামলায় মংডু, বুচিদং ও রাচিদং এলাকায় বহু রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা জল-স্থলে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে, যাদের অধিকাংশ বাংলাদেশমুখী। এদিকে, বৃহস্পতিবার রাত থেকে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে চলছে সেনা সদস্যদের নানামুখী বর্বরতা। রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের কেউ এদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে। শনিবার সকালে তুমব্রু সীমান্তের এপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যদের পক্ষে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। লক্ষ্য ছিল এপারে আটকে থাকা রোহিঙ্গারা। এতে কয়েকজন রোহিঙ্গা আহত হয়েছে। একজন বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) জোয়ান আহত হওয়ার কথা শোনা গেলেও বিজিবির পক্ষ থেকে তা নাকচ করে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে, শুক্রবার রাতে সীমান্ত এলাকায় গুলিবিদ্ধ দুই রোহিঙ্গা সদস্যকে রাতেই নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এরা হলোÑ মোঃ মুছা (২৩) ও মোঃ মুক্তার (২৬)। শনিবার সকালে মোঃ মুছার মৃত্যু হয়। চমেক হাসপাতালের ইমার্জেন্সি সূত্রে জানানো হয়েছে, মুছা ও মুক্তারকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছিল। গুলিবিদ্ধ মুক্তারের চিকিৎসা চলছে। অপরদিকে, গত শুক্রবার দেড় শতাধিক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর পর শনিবার আরও ৭৩ জনকে পুশব্যাক করা হয়েছে। সীমান্তের টেকনাফের ঘুমধুম, থাইংখালি, উখিয়া-টেকনাফ, হ্নীলাসহ শাহপরীরদ্বীপ থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যন্ত সীমান্ত এলাকার জিরো পয়েন্টগুলোতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা এ দেশে প্রবেশের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। বিজিবি সূত্রে জানানো হয়েছে, মিয়ানমারে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা যাতে এ দেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে লক্ষ্যে চূড়ান্ত সতর্ক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুরো সীমান্ত এলাকাজুড়ে বিজিবি সদস্যদের ২৪ ঘণ্টা টহল চলছে। অপরদিকে, শনিবার সার্কিট হাউসে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে এক সভায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের চার জেলার ৩১ উপজেলায় ভোটার নিবন্ধনকালে যাতে রোহিঙ্গাদের নাম কোনভাবে অন্তর্ভুক্ত না হয় সেজন্য চূড়ান্ত সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব উপজেলা হলোÑ রাঙ্গামাটির ৮, বান্দরবানের ৭, চট্টগ্রামের ৮ ও কক্সবাজারের ৮টি। এসব উপজেলায় রোহিঙ্গাদের অবৈধ বসতি রয়েছে বলে সভায় উল্লেখ করা হয়। সীমান্তের ওপার থেকে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী সে দেশের রাখাইন রাজ্যের অন্যতম শহর বুচিদং তংবাজার, নাইক্ষ্যান্দং, লাবাদকসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে হেলিকপ্টার থেকে মিয়ানমারের সৈন্যরা বিস্ফোরক, গোলাবারুদ নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দিয়েছে শত শত ঘরবাড়ি। শুক্রবার বিকেলে সেনা কপ্টারগুলো কয়েকবার রোহিঙ্গা পল্লীর ওপর চক্কর দিলে সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত হয়ে পাহাড়ে ও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে নাফ নদীর পাড়ে ভিড় জমায়। মিয়ানমারে শনিবার পর্যন্ত শতাধিক রোহিঙ্গার মৃতদেহ স্বজনরা উদ্ধার করেছে বলে জানা গেছে। আনান কমিশন রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এ্যাডভাইজরি কমিশনের সদ্য প্রকাশিত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের দাফতরিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার। এনএলডি নেত্রী ও স্টেট কাউন্সিলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আউং সান সুচির অফিস থেকে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে বিভিন্ন বার্তা সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাখাইনের সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়, এজন্য সময়ের প্রয়োজন। দেশটিতে বসবাসরত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বিশ্বাস, ভ্রাতৃত্ব এবং মনস্তাত্ত্বিক উন্নতি সাধনের জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তবে আনান কমিশনের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার পরামর্শ দিলেও এ বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করেনি স্টেট কাউন্সিলর দফতর। দুই পৃষ্ঠার এ বিজ্ঞপ্তিতে কৌশলে এড়িয়ে গেছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ইস্যুটি। আগামী সপ্তাহে সরকারের পদক্ষেপগুলোর বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রকাশ করা হবে বলেও জানানো হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে। উল্লেখ্য, আনান কমিশন গঠনের পর এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচির সরকার বলেছিল, কফি আনান কমিশনের তদন্তে যা বের হয়ে আসবে, তা-ই মেনে নেয়া হবে। তবে প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় সরকারের দায়সারা মনোভাব অপ্রত্যাশিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ বলছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান ‘নাগরিকত্ব প্রদানের’ বিষয়ে আনান কমিশন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করলেও মিয়ানমার সরকার বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ‘রোহিঙ্গা’ নামে আলোচনা সভায় কোন এজেন্ডা দিতে সম্পূর্ণ অপারগতা জানিয়েছে বহু আগে থেকে। আগে তারা বলেছিল, রাখাইনের মুসলিম জনগোষ্ঠী আর বৃহস্পতিবারের পর থেকে বলা হচ্ছে ‘বাঙালী’। বিশেষজ্ঞ সূত্রে এ বিষয়টিকে তারা রোহিঙ্গাবিরোধী নতুন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মনে করছেন। উল্লেখ্য, ২৩ আগস্ট মিয়ানমার সরকার প্রধানের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট আনান কমিশন। প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের ‘বিশ্বের একক বৃহত্তম রাষ্ট্রহীন সম্প্রদায়’ হিসেবে অভিহিত করে তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে তাগাদা দেয় কমিশন। রাখাইন রাজ্যের গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতি তদন্তে গত বছর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে প্রধান করে এই উপদেষ্টা কমিশন গঠন করে দিয়েছিলেন স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি। এদিকে, শুক্রবার রাতেও মিয়ানমার অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে গুলিবর্ষণ করেছে সরকারী বাহিনী। দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অফিস থেকে বলা হয়েছে, যারা মারা পড়েছে তারা সবাই জঙ্গী এবং ‘বাঙালী সন্ত্রাসী’। সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর রাখাইন রাজ্যে পড়ছে লাশের পর লাশ। বসতঘর, খামারবাড়ি, পাহাড়-পর্বত আর ফসলি জমি থেকে শনিবার পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ১১০ রোহিঙ্গা নর-নারীর লাশ। এ সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে বলে খবর আসছে। হত্যাকা-ের শিকার রোহিঙ্গাদের মধ্যে নারী, শিশুসহ সব বয়সী মানুষ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের সমস্যা নিয়ে কাজ করে এমন বিভিন্ন সূত্রের দাবি, রাখাইনে ৩০টি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামের অন্তত দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। উদ্ধারকৃত মৃতদেহগুলোর কোনটি ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, কোনটি বুলেটে ফুটো হওয়া আর কোনটি আগুনে দগ্ধ। কোনটি আবার ধারালো অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারা ক্ষতবিক্ষত। অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে ২৫টি গ্রামের শত শত বাড়িঘর। হেলিকপ্টার থেকে মর্টার নিক্ষেপ করায় পৃথক পৃথক স্থানে বহু বসতবাড়ি পুড়ে গেছে। ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে ১০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। এদের কিছু বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে গেলেও অন্যরা পাহাড়ে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে এদের মানবেতর জীবন শুরু হয়েছে। খাদ্যাভাবে, অনাহারে এদের জীবন চূড়ান্ত শঙ্কায় রয়েছে। রোহিঙ্গাদের দেখলেই সে দেশের সেনা সদস্যরা গুলি করছে। সেনা অভিযানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাখাইনের রাচিদংয়ের শিলখালী গ্রাম। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত সেখানে গণহত্যা চালায় সেনারা। গ্রামটিতে সেনাদের দেয়া আগুনে পুড়ে মারা গেছে বহু রোহিঙ্গা নর-নারী। সরকারী বাহিনীর সদস্যরা এখনও (শনিবার) রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো ঘিরে রেখেছে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করতে পাঁচ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা সীমান্তের ওপারে জিরো লাইনে অপেক্ষা করছে বলে জানা গেছে। সীমান্ত রক্ষায় ও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি জওয়ানরা টহল বৃদ্ধি করেছে। রাচিদং এলাকায় কারফিউ জারির পর থেকে রোহিঙ্গাদের অবরোধ করে রাখে সামরিক বাহিনী। তাদের খাদ্য সরবরাহ ও রোহিঙ্গা পল্লীর দোকানপাট বন্ধ করে দেয়। এপারে থাকা এক রোহিঙ্গা নেতা জানান, আনান কমিশন মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার সুপারিশ করায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে সে দেশের সেনাবাহিনী সরকারী নির্দেশে। সেনা সদস্যদের এমন বর্বরোচিত আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গা যুবক শ্রেণীর বড় একটি অংশ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বেপরোয়া হত্যাকা- চালাচ্ছে সেনা সদস্যরা। তাদের জঙ্গী ও বাঙালী বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবির পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারির কথা বলা হলেও কৌশলে মিয়ানমার থেকে আহতদের পাশাপাশি নতুন করে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১২ জনের বেশি কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বিজিবির পক্ষে শনিবার রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের কথা অস্বীকার করা হয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে দালাল চক্র মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুক্রবার ভোর রাতে পাহাড়ের পাশে ১৭টি পুলিশ পোস্ট ও ৭টি সেনা ক্যাম্পে আল ইয়াকিন (আরসা) রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠনের সশস্ত্র জঙ্গীরা হামলা চালিয়েছে। গোপনে বিচ্ছিন্নভাবে সশস্ত্র রোহিঙ্গারা অবস্থান নেয়ার খবরে রোহিঙ্গাদের অভিযুক্ত করে কয়েকটি গ্রাম অবরুদ্ধ করে রাখে সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের মংডু, রাচিদং ও বুচিদং এলাকার কয়েকটি গ্রামে থেমে থেমে গুলিবর্ষণের ঘটনায় রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ৮-১০টি হেলিকপ্টার আকাশে চক্কর দেয়ার দৃশ্য দেখে রোহিঙ্গারা বিচ্ছিন্নভাবে উখিয়া-টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তের জিরো পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ওসব সীমান্ত পয়েন্টে বিজিবি অতিরিক্ত জওয়ান মোতায়েন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অবস্থান নিয়েছে। উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের বিজিবির পাশাপাশি রহমতের বিল সীমান্তে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উখিয়া থাানর ওসি মোঃ আবুল খায়ের। একশ্রেণীর দালাল মুঠোফোনে যোগাযোগ করে নাফ নদী পার করিয়ে নিয়ে আসছে কিছু কিছু রোহিঙ্গা পরিবারকে। শুক্রবার বিকেলে উখিয়া বালুখালীর নতুন রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নিতে যাওয়া মিয়ানমারের খৈয়ারবিল গ্রামের মৃত আবদুল হাকিমের পুত্র মোঃ ইব্রাহিম, আবু নছর, বলি বাজার এলাকার নুরুল আলম, আবদুল শুক্কুর, হোছন আলী ও কেয়ারি প্রাং গ্রামের নুরুল আলম ও তার স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগম জানায়, মিয়ানমারের নাইছাদং, মেদাই, ফকিরা বাজার, বলি বাজার, কুমির খালী, জিম্মংখালী, শিলখালী, রাংবাইল্ল্যা, কেয়াংমং, চালিপ্রাং, নারাইশং, নাগপুরা, চাকমাকাটাসহ অন্তত ২৫টি গ্রাম মিয়ানমার সেনাবাহিনীরা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। শুক্কুর জানায়, তার ভাই মোহাম্মদ হাশেমকে শুক্রবার দুপুরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীরা ধরে নিয়ে গেছে। শুক্রবার বিকেলে ঘুমধুম সীমান্তের রেজু আমতলি পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশকৃত ৪টি রোহিঙ্গা পরিবার বালুখালী বস্তিতে এসেছে। তাদের মধ্যে আবু ছিদ্দিক জানান, মিয়ানমারের সৈন্যরা অপর রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে জেনে আমরা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসি। এজন্য দুইজন দালালকে মাথাপিছু এক হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। গত বছরের ৯ অক্টোবর সেনা ও রাখাইন উগ্রবাদীদের হাতে রোহিঙ্গা নির্যাতনে অনুপ্রবেশকৃত প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গাসহ বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসরত প্রায় ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার ব্যাপারে সরকার বিহীত ব্যবস্থা নেয়ার আগেই ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে জেনে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুরুল হাসান খান জনকণ্ঠকে জানান, কক্সবাজার বিজিবির আওতাধীন সীমান্ত এলাকা দিয়ে কোন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে বিচ্ছিন্ন ও অনাকাক্সিক্ষতভাবে কিছু রোহিঙ্গা গোপনে চোরাই পথে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা প্রতিহত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ বিজিবি অধিনায়ক এসএম আরিফুল ইসলাম। কুতুপালং বস্তির রোহিঙ্গা সিরাজুল হক, বালুখালী নতুন বস্তির আয়ুব মাঝি ও লালু মাঝি জানায়, রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করে বালুখালী ও কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে। উখিয়ার কুতুপালং এবং বালুখালী নতুন বস্তিতে অন্তত ৫ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে আশ্রয় নিয়েছে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে মংডু তমবিল গ্রামের দিল মোহাম্মদ, তার স্ত্রী ছখিনা, তাদের চার শিশু সন্তান মোঃ তাহাদ, মোঃ আনাছ, মোঃ হাসান ও মোঃ হোসেন সেনাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শুক্রবার বিকেলে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। সেনা অভিযান বন্ধে মাফিমের আহ্বান আরাকানে নতুন করে শুরু হওয়া সেনা-বিজিপির যৌথ অভিযান বন্ধে উদ্যোগ নিতে জাতিসংঘ এবং আসিয়ানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মালয়েশিয়ান বেসরকারী সংস্থা মাফিম। শুক্রবার সংস্থাটির সভাপতি মুহাম্মদ আজমি আব্দুল হামিদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমার সরকার ও মগ উগ্রপন্থীদের যৌথ হামলায় মংডু, বুচিদং এবং রাচিদং অঞ্চলের বিভিন্ন রোহিঙ্গা পল্লী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুক্রবার রাতের সেনা-বিজিপির যৌথ অভিযানে হতাহত এবং রোহিঙ্গা পল্লীতে অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে দুঃখজনক আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে তা বন্ধ করতে আহ্বান জানায় সংগঠনটি। এই হামলাকে ২০১৬ সালের অক্টোবরের ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের’ মতো বলে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। মাফিম সভাপতি বলেন, কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর নতুন করে গণহত্যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনভাবেই মেনে নেবে না। অবিলম্বে এই সমস্যা সমাধানে আসিয়ানভুক্ত দেশ, জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিল এবং ওআইসির হস্তক্ষেপ কামনা করা হয় বিবৃতিতে। গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবি পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারির কথা বলা হলেও কৌশলে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা আহতদের পাশাপাশি নতুন করে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১২ জনের বেশি কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তবে বিজিবি অনুপ্রবেশের কথা অস্বীকার করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মিয়ানমারের মংডুর ইসমাইলের পুত্র মোহাম্মদ মুছা ও গোল মোহাম্মদের পুত্র মোহাম্মদ মোক্তার দুই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করার পর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানো হয়। শনিবার সকালে মোঃ মুছার মৃত্যু হয়। শনিবার সকালে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এমএসএফ হল্যান্ড কর্তৃক পরিচালিত হাসপাতালের গেটে গিয়ে দেখা মেলে মিয়ানমারের ধুমবনিদা গ্রামের আবু আহমদের পুত্র কামাল হোসেনের। গুলিবিদ্ধ এ রোহিঙ্গা জানায়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সদস্যরা রোহিঙ্গা পাড়া ঘিরে রেখে সামনে যাকে পাচ্ছে- গুলি করার পাশাপাশি নানাভাবে নির্যাতন করছে। তাকেও লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। পুরো একরাত পাহাড় অতিক্রম করে পালিয়ে এসেছে উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হল্যান্ড হাসপাতালে। কুতুপালং বস্তিতে বসবাসকারী মোঃ শফি জানায়, গত দুই দিনে গুলিবিদ্ধসহ নানাভাবে আহত ১২ জন রোহিঙ্গা যুবক এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছে। তাদের অনেককেই চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কুতুপালং বস্তিতে নতুন করে অনুপ্রবেশ করেছে পাঁচটি পরিবার। তার দেয়া তথ্যমতে, কথা হয় পালিয়ে আসা কয়েক রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। যাদের বেশিরভাগ নারী। উখিয়ার বালুখালী বরাবর মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া থেকে পালিয়ে আসা নুর নাহার, রফিক, কহিনুর জানায়, মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা নির্বিচারে হত্যাসহ নির্যাতন করছে। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান জানান, সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে বিজিবি সদস্যরা। টেকনাফ দিয়ে বিজিবি ও কোস্টগার্ড শনিবার সকালে ৭৩ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর কথা নিশ্চিত করেছেন। দফায় দফায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চেষ্টা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের বান্দরবান সীমান্তের কাঁটাতারের পাশে এবং পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গারা। এরা দফায় দফায় চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছে বিজিবি। শুক্রবার ভোর রাতে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকটি পোস্টে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা হামলা চালানোর পর সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ায় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা কাঁটাতারের বেড়ার কাছে এবং আশপাশের পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছে। তারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাখাইনে পরিস্থিতি অবনতির পর বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি সতর্কতা জারি করেছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজার সীমান্তের ক্যাম্পগুলোতে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে নিরাপত্তা জোরদার করেছে বিজিবি। বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল আহসান খান জানিয়েছেন, ভোর থেকে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে জিরো লাইনে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছেন অনুপ্রবেশের জন্য। তবে বিজিবির কড়া প্রহরার কারণে তারা অনুপ্রবেশ করতে পারছে না। বিজিবি কর্মকর্তারা জানান, গভীর রাতে গোলযোগের পর থেকে আতঙ্কিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশেরে চেষ্টা করছে। তারা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার পাশে পাহাড়ী এলাকাগুলোতে (মিয়ানমার অভ্যন্তরে) অবস্থান নিয়েছে। বিজিবির টহল জোরদার করায় তারা অনুপ্রবেশ করতে পারছেন না। জিরো লাইন পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে শুরু করে টেকনাফের শাহপরীররদ্বীপ পর্যন্ত সীমান্তের অসংখ্য জিরো পয়েন্ট (নো-ম্যানস ল্যান্ড) রয়েছে। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে (মিয়ানমার অভ্যন্তরে) কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও বাংলাদেশ অভ্যন্তরে কোথাও কাঁটাতারের বেড়া নেই। ওসব পয়েন্টে বিজিবি হেঁটে অথবা নৌযান নিয়ে টহল দিয়ে থাকে। নাফ নদীর জলসীমান্ত ছাড়াও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু এলাকার স্থল সীমান্ত দিয়ে অনেক সময় হেঁটে বিভিন্ন সময়ে বহু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ইতোপূর্বে করেছে এবং এখনও করছে পাশাপাশি আরও প্রবেশের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। হেঁটে রোহিঙ্গারা যেসব সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করে থাকে, ওইসব পয়েন্ট হচ্ছে- ঘুমধুম পূর্বপাড়া, জলপাইতলী, তেঁতুলগাছতলা, বাঁশবাগান, তুমব্রু পশ্চিমকুল, বাজারপাড়া, চাকমাপাড়া, বাজাবনিয়া, মধ্যমপাড়া, উত্তরপাড়া ও রেজু আমতলী। নৌকা দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করতে যেসব পয়েন্ট ব্যবহার করে থাকে সেগুলো হচ্ছে- উখিয়ার বালুখালী, রহমতেরবিল, আঞ্জুমানপাড়া, টেকনাফের উলুবনিয়া, হোয়াইক্যং, কাঞ্জরপাড়া, উনচিপ্রাং, হ্নীলা, নয়াপাড়া, খারাংখালী, লেদা, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, সাবরাং, নয়াপাড়া ও শাহপরীরদ্বীপের প্রত্যন্ত এলাকা। ১১০ মৃতদেহ উদ্ধার শুক্রবার ভোর রাত থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘কিলিং অপারেশন’ শুরু করার পর হাজার হাজার রোহিঙ্গা গ্রাম ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে গহীন অরণ্যে ঢুকে পড়েছে। দিনের বেলা রোদে পুড়ে আর রাতে বৃষ্টিতে ভিজে নাজুক অবস্থায় পাহাড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে পালাচ্ছে তারা। অনাহারে অর্ধাহারে থাকা শিশু ও নারীদের আহাজারি চলছে পাহাড়ে। সৈন্যদের বুলেটের আঘাতে স্বজন হারানোর বেদনায় ভেঙ্গে পড়েছে অনেকে। সূত্র জানিয়েছে, সেনা আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম রাচিদং শহরের নিকটবর্তী শিলখালীর প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা পাহাড়ে বর্তমানে অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ নারী ও শিশু। সৈন্যরা অগ্নিসংযোগ করে গ্রামটিকে সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দিয়েছে। এতে ৪টি মসজিদ ও মক্তব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ওই গ্রামে প্রায় ২ শতাধিক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে ২ নারী। সরকারী গাড়িতে করে লাশ নিয়ে যেতে দেখেছে অনেক রোহিঙ্গা। শনিবার সন্ধ্যার আগ থেকে পূর্ববর্তী ৩৬ ঘণ্টায় আরাকানের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১১০টি রোহিঙ্গার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলছে। হত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের মধ্যে নারী, শিশুসহ সব বয়সী মানুষ রয়েছে। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছে অসংখ্য। এদিকে শনিবার সন্ধ্যায় উখিয়ার রাজা পালং ইউনিয়নের দরগাহ বিল ও হাটিমুড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশকালে পুলিশ ৬৭ জন রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশুকে আটক করে। উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, আটককৃতদের আজ রবিবার পুশব্যাক করা হবে।
×