ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বন্যার্তদের পাশে শিক্ষার্থীরা

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৭ আগস্ট ২০১৭

বন্যার্তদের পাশে শিক্ষার্থীরা

‘গানের বিনিময়ে ত্রাণ’ ॥ খুর্শিদ রাজীব ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন কিংবদন্তি প-িত রবী শংকর, ওস্তাদ আলী আকবর খান, কিংবদন্তি রক ব্যান্ড ‘দ্য বিটলস’ এর জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানরা। ঠিক তার ৪৬ বছর পর আগস্ট মাসেই বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের প্রায় সব কয়টি জেলা। খাবার, পানির তীব্র সঙ্কটে আশ্রয়হীন বন্যার্ত মানুষদের আহাজারি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) এসে পৌঁছল, বসে থাকতে পারল না ক্যাম্পাসের সংস্কৃতিকর্মীরা। গিটার, ইউকুলেলে, কাহন, ঢোল, দোতারা আর ত্রাণ বাকশো নিয়ে এই ‘রবী শংকর’, ‘জর্জ হ্যারিসন’রা নেমে পড়লেন গানের বিনিময়ে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহে। ‘গানের বিনিময়ে ত্রাণ’ ধারণাটা কিভাবে এলো, জানালেন নাট্যকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমামুল বাকের এ্যাপোলো। তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যা দেখে মনে হলো কিছু করা দরকার। ফেসবুকে ডাকা ক্যাম্পাসের সংস্কৃতিকর্মীদের আড্ডায় ‘গানের বিনিময়ে ত্রাণ’র ধারণাটা মাথায় এলো। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, সঙ্গীত মানুষের ভেতরের মানবতাকে জাগিয়ে তোলে। পরদিন থেকেই ‘বন্যার্তদের পাশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়’ স্লোগানকে সামনে রেখে কাজ শুরু করে দিলাম। সাংস্কৃতিক কর্মীদের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমরা এ কর্মসূচী শুরু করেছি। এতে ব্যাপক সাড়াও পেয়েছি। মাত্র তিন দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে ক্যাম্পাসসহ এর আশপাশের এলাকা এবং রাজশাহী শহরের বিভিন্ন স্থানে মানুষদের গান শুনিয়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকা তুলেছেন। সে টাকায় দিনাজপুর জেলার ২৫০টি বন্যার্ত পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছেন তারা। ‘জর্জ হ্যারিসন’দের এ ত্রাণ কার্যক্রম দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন ক্যাম্পাসের অন্য স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠন এবং বিভিন্ন জেলা সমিতিগুলো। তারাও এগিয়ে আসছেন বন্যার্তদের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের তীর্থক নাট্যচক্রের সভাপতি আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, আমাদের সংগৃহীত টাকার পরিমাণ বন্যার ভয়াবহতার তুলনায় নিহায়তই কম। কিন্তু আমরা চাইছিলাম, আপদকালে দেশের প্রত্যেকটা মানুষ যেন প্রত্যেক মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। কারণ সমাজের প্রতি প্রত্যেকের দায়বদ্ধতা আছে। আমরা হয়ত কিছুটা সফল, কারণ অনেকেই আমাদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এভাবে সবাই যদি সবার পাশে দাঁড়ায় তাহলে সঙ্কটকালে আমাদের কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। গানের বিনিময়ে ত্রাণের এই দলটিতে সংস্কৃতিকর্মীর বাইরেও সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ছিলেন। যে যার মতো ত্রাণ কর্মসূচীতে সহায়তা করেছেন। এমন মহৎ উদ্যোগের জন্য রাবির এই ‘জর্জ হ্যারিসন’রা ক্যাম্পাসে ও দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষের কাছে অভিনন্দন পাচ্ছেন। অনেকে দূর থেকে তাদের টাকা পাঠিয়েও সহায়তা করেছেন। তারা জানালেন, জীবন তাদের যেখানেই নিয়ে যাক, তারা এভাবে সবসময় মানবতার পাশেই থাকবেন। উদ্বুদ্ধ করে যাবেন মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ‘হাসিমুখ’ ॥ মো. নাবিল তাহমিদ চারপাশে শুধু পানি আর পানি। দূরে কিছু কিছু গাছ দেখা যায়। তবে পুরো গাছ নয় শুধু পাতা দেখা যায়। ভাসমান গাছগুলো দেখলে মনে হয় যেন সোয়াম্প ফরেস্টে চলে এসেছি। কিন্তু আসলে তা না। চারপাশে শুধু বন্যার পানি। যেখানে কদিন আগেও আবাদি জমি ছিল সেখানে এখন পানি থৈ থৈ করছে। সব কিছু বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। ইসলামপুরের চিনাডুলি ইউনিয়নে একটা বড় ব্রিজের ওপর প্রায় শ খানেক মানুষ ও শিশু তাদের গরু ও ছাগল নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ব্রিজের মাত্র ২ ফুট নিচ দিয়ে বন্যার পানি বয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর সামনেই কিছু বাড়ি। বাড়িগুলো হয় পানিতে ডুবে গেছে না হয় বাড়ির চারপাশে পানি। কোথাও বিশুদ্ধ খাবার পানি নেই। মানুষদের কাজ নেই, খাবার কেনার টাকা-পয়সা নেই। প্রতিদিন প্রতি বেলায় তারা অপেক্ষা করে কোন ত্রাণভর্তি নৌকার আসার অপেক্ষায়। হয়তো কখনও দু’বেলা খাবার জোটে, কখনও না খেয়েই দিন কাটাতে হয়। এরকম অসংখ্য বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা। বন্যার্তদের সাহায্যার্থে বাকৃবির শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের মূল বেতন থেকে এক দিনের সমপরিমাণ অর্থ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সংগৃহীত অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে প্রদান করা হবে এবং অবশিষ্ট অর্থ বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের সাহায্যার্থে ত্রাণ সামগ্রী হিসাবে বীজ, সবজি চারা, ধানের চারা, খাদ্য (চাল, চিড়া, চিনি, আলু), গো-খাদ্য, পশু চিকিৎসা সামগ্রী, স্যালাইন, পানি শোধন ট্যাবলেট, ওষুধ ইত্যাদী সামগ্রী সরাসরি দেওয়া হবে। দেশের বন্যা পরিস্থিতিতে যখন চরমে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এবং শিক্ষার্থীরা নিজেদের সাধ্যমতো বন্যার্তদের সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অসংখ্য উদ্যমী তরুণ এগিয়ে আসছে এই অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে। শুধু বড় বড় সংগঠনই নয়, ক্ষুদ্র সংগঠনগুলোও এগিয়ে আসছে এই কাজে। বন্যার্তদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছে বাকৃবির একটি সংগঠন ‘হাসিমুখ’। জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়নের প্রায় ১০০ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে তারা ত্রাণ বিতরণ করেন। প্রতি পরিবারকে চাল, ডাল, চিরা, গুড় ও স্যালাইন প্রদান করা হয়। দুস্থ, অসহায় ও সুবিধা-বঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফুটানোই ‘হাসিমুখ’ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য। বাকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্র্থীদের উদ্যোগে ওই সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে ভেটেরিনারি অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের ড. এ.এস. মাহফুজুল বারি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ভেটেরিনারি অনুষদের ইফতেখার জাহান ভূইয়া। বর্তমানে সংগঠনটির সদস্য প্রায় ৩০ জন। এবং তারা নিরলসভাবে আর্তমানবতার কাজ করার চেষ্টা করছেন। হাসিমুখ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার জাহান ভূইয়া বলেন, আমরা হাসিমুখ পরিবার চিনাঠুলি ইউনিয়নের পরিবারগুলোর জন্য ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে মনে হল এটা তাদের জন্য খুবই সামান্য। আরও অনেক ক্ষুধার্ত পরিবার আছে যাদের আমরা সাহায্য করতে পারিনি। যখন না দিতে পেরে ফেরত আসতেছিলাম তখন মনের ভিতর ভীষণ ব্যথা অনুভুত হচ্ছিল। সবাইকে সাহায্য করতে পারলে অনেক ভাল লাগত। কিন্তু একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে এর বেশি করা সম্ভব হলো না। বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষদের বন্যার কবল থেকে বাঁচাতে সরকার ও সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
×