ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৭ জীবন বীমা কোম্পানির দেড় হাজার কোটি টাকা অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২৭ আগস্ট ২০১৭

১৭ জীবন বীমা কোম্পানির দেড় হাজার কোটি টাকা অনিয়ম

মশিউর রহমান খান ॥ শুধু আইনের আওতাধীন না হওয়ায় জীবন বীমা খাতের ১৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দেড় হাজার কোটি টাকার অনিয়মের প্রমাণ পেয়েও কোন প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ব্যবস্থাপনার নামে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু দুদক আইনের সীমাবদ্ধতা থাকায় বাধ্য হয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে দুদকে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান দল। এর আগে দুদকের পক্ষ থেকে দেশের কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ার পরও কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে ২০০৯-১৫ সাল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনার নামে অবৈধভাবে এ পরিমাণ অতিরিক্ত ব্যয় করেছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, অভিযুক্ত জীবন বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রমাণ পেলেও এ ব্যাপারে সরাসরি কোন পদক্ষেপ নিতে পারবে না দুদক। কারণ হিসেবে জানা গেছে, দুদক আইনে সরকারী বীমা প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কমিশনের সরাসরি আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু আইনে বেসরকারী বীমা কোম্পানিগুলোর অপরাধের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে নেই। বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, দুদক এসব বেসরকারী জীবন বীমা কোম্পানিকে দুদক আইনে অপরাধের আওতায় আনতে ও বীমা কোম্পানিকে তাদের তফসিলভুক্ত অপরাধের তালিকাভুক্ত করার জন্য আইডিআরএ কর্তৃপক্ষকে প্রায় এক মাস আগে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে আজ পর্যন্ত আইআরডিএ কর্তৃপক্ষ দুদকের দেয়া চিঠির কোন উত্তর দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। জানা গেছে, বীমা কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত ব্যয় বা সঠিক ব্যয় ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার আজ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নীতিমালা তৈরি করেনি। ফলে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো লিমিটেড কোম্পানির মতো নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ব্যয় ব্যবস্থাপনা করে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবন বীমা কোম্পানিগুলো ১৯৫৮ সালের ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিধি অনুযায়ী চলছে। তাই এ সংক্রান্ত নতুন ব্যয় ব্যবস্থাপনা বিধি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। তবে পুরনো বিধি অনুযায়ীই বীমা কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ ব্যবস্থাপনা ব্যয় দেখিয়েছে, তা অবাস্তব ও অসঙ্গতিহীন। তাই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশনের পরামর্শ প্রয়োজন। দুদকে দেয়া অভিযোগ অনুসন্ধানে ২০১৬ সালের ২১ জুন সংস্থাটির উপপরিচালক মোঃ জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে দুদকের দুই সদস্যের একটি টিম মাঠে নামে। এ সময় কাজের অংশ হিসেবে অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), কোম্পানি সচিব, প্রধান হিসাব কর্মকর্তা ও বিপণন প্রধানদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়ে প্রধান নির্বাহীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদক কর্তৃপক্ষ কোম্পানির চেয়ারম্যান বা পরিচালনা পর্ষদের কাউকে কমিশনে ডেকে পাঠাননি। চেয়ারম্যান-পরিচালকদের দাবি কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাদের কোন দায় নেই। এর জন্য মূল ব্যক্তি হবেন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী। সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে কোম্পানি ব্যবস্থাপনার নামে অবৈধভাবে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের প্রমাণ পান অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। ফলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন অনুযায়ী কি করণীয় তা জানতে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান করা অভিযোগে বলা হয়েছে, পুরনো ১৭টি জীবন বীমা কোম্পানি ২০০৯-১৫ সাল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনার নামে অবৈধভাবে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। তবে আইডিআরএর হিসাব অনুযায়ী, জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পরিমাণ দুদকের হিসাবের চেয়েও অনেক বেশি। বর্তমান নিয়মেই দীর্ঘ বছর যাবত ব্যয় ব্যবস্থাপনা করে আসছে বেসরকারী বীমা কোম্পানিগুলো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০০৩ অনুযায়ী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতারণা ও জালিয়াতির অপরাধগুলো দুদকের তফসিলে রাখা হয়েছে। কিন্তু এ আইনে ও দুদকের আইনে বীমা কোম্পানিকে তফসিলভুক্ত অপরাধের তালিকায় রাখা হয়নি। তবে বীমা খাতকে দুদকের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতেই অনুসন্ধান শেষে দুদক টিম বিশেষ সুপারিশ করেছে। সুপারিশ কার্যকর হলে বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও দুদক আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে। ফলে অনুসন্ধান দল আইডিআরএর মাধ্যমে অভিযুক্ত বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এছাড়া ২০১০-এ নতুন বীমা আইন পাস হলেও জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয়-সংক্রান্ত কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। এ অবস্থায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে মান্ধাতা আমলের সেই ১৯৫৮ সালের বিধি মানতে হচ্ছে। ওই বিধি অনুযায়ী, একটি জীবন বীমা কোম্পানি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ৯০ শতাংশ ও নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা বাবদ ব্যয় করতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের অনুসন্ধান তদারককারী ডেস্ক প্রধান ও দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, অভিযোগ অনুযায়ী কোম্পানিগুলো যে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে, তার তথ্যসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান দল যাচাই শেষে ইতোমধ্যে একটি প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে এটি সহ ভবিষ্যতের বীমা সংশ্লিষ্ট সৃষ্ট সকল সমস্যা সমাধানে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কমিশন কোন প্রকার সিদ্ধান্ত প্রদান করেনি। তাই কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এদের বিরুদ্ধে পরবর্তী প্রয়োজনীয় সুপারিশ বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×