ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

৫ মে ২০১৩ হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৭ আগস্ট ২০১৭

৫ মে ২০১৩ হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব

(গতকালের পর শুরু) এদিকে আমরা জানতে পারি যে, হেফাজত প্রধান মাওলানা শফী আগের দিন বিকেলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে লালবাগ মাদ্রাসার ভবনের ভিতরে তার প্রধান সহযোগীদেরসহ অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তার ওই দিন বিকেল ৩টায় শাপলা চত্বরে গিয়ে ৬টার মধ্যে হেফাজতের সমাবেশ সমাপ্ত করার নির্দেশ দেয়ার কথা। এই লক্ষ্যে তিনি একটি লাল জীপে চড়ে বিকেল ৪.৩০-এর দিকে পল্টনের দিকে অগ্রসর হন। সে সময়কার গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী পথিমধ্যে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির তরফ থেকে তাকে শাপলা চত্বরে গিয়ে সমাবেশ সমাপ্ত না করার জন্য এবং ফলত হেফাজতীদের সমাবেশ বিরতিহীনভাবে টেনে নিয়ে খালেদা জিয়ার বিক্ষোভ সমর্থন ও সরকারের পদত্যাগের ৪৮ ঘণ্টার চরমপত্র সংশ্লিষ্ট দাবির সঙ্গে একীভূত হওয়ার ঘোষণা দিতে অনুরোধ করা হয়। এই প্রেক্ষিতে তাকে আমাদের তরফ হতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয় যে, মতিঝিল এলাকায় তিনি গেলে তার নিরাপত্তার জন্য পুলিশ দায়ী থাকবে না। এর প্রেক্ষিতে মাওলানা শফী বিকেল ৪টার দিকে পলাশীর মোড় থেকে লালবাগ মাদ্রাসায় ফিরে যান। তাকে পুলিশ দিয়ে বেষ্টিত রেখে মোবাইল ফোনে আমি তাকে চট্টগ্রামে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানাই। পুলিশ প্রহরায় তিনি সে রাত লালবাগ মাদ্রাসায়ই অতিবাহিত করেন এবং পরদিন চট্টগ্রাম ফিরে যাওয়ার জন্য তাকে সহায়তা করতে আমাদের অনুরোধ করেন। আমি সে এলাকার পদায়িত উপ-পুলিশ কমিশনার হারুন-অর-রশিদকে তাকে বিমানযোগে চট্টগ্রামে ফিরিয়ে নেয়ার অনুশাসন দেই। এই অনুশাসন অনুযায়ী বিকেল ৩টার দিকে উপ-পুলিশ কমিশনার হারুন-অর-রশিদ তাকে তার ২ সহযোগীসহ ঢাকা বিমানবন্দরে নিয়ে আমাদের টাকায় রিজেন্ট এয়ারের চট্টগ্রামগামী একটি ফ্লাইটে তুলে দেন। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর সংবাদিকরা হেফাজতে ইসলামের আমির শফীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আগের দিনের শাপলা চত্বরের ঘটনা কিংবা হেফাজতীদের আন্দোলন নিয়ে কোন কথা বলতে অস্বীকার করেন। বলা হয় নিষ্প্রয়োজন নয় যে, মাওলানা শফী ও তার ২ সহযোগী এখনও তাদের বিমান টিকেটের মূল্য পরিশোধ করতে ভুলে রয়েছেন। রাত ৮টার পর খবর আসে যে, হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে কয়েকশত জামায়াতে ইসলামের অনুসারী ও তাদের ছাত্র সংগঠন শিবিরের কর্মীরা একত্রিত হয়েছে। আমি এসব দুর্বৃত্তকে হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে মিলিত না হতে দেয়া এবং সেই লক্ষ্যে যথা প্রয়োজন শক্তি প্রয়োগ করার নির্দেশ দেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় প্রতি ঘণ্টায় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জনগণের প্রতি তার আনুগত্য, সরকার পরিচালনায় দৃঢ়তা এবং সহযোগীদের প্রতি সহৃদয়তার পরিচয় দেন। বলা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর মাঝ পর্যায়ের দু’জন সদস্য গুজব ছড়ান যে, আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পরিস্থিতির ওপর তত্ত্বাবধায়ক দৃষ্টি না রেখে নগরের এক বিলাসী পান্থশালায় বিনোদনে ব্যাপৃত আছি। এদের দু’জনকেই আমি পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের আমলে সৃষ্ট চাকরি সংক্রান্ত প্রতিকূলতা থেকে প্রতিরক্ষণ দিয়ে চাকরির মই ধরে এগুনোর সুযোগ দিয়েছিলাম। মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য এবং জাতীয় পার্টি ও বিএনপির তরফ থেকে কয়েকজন নেতা আবারও আমাকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য সামরিক বাহিনীকে নিয়োগ করার পরামর্শ দেন। উত্তরে আমি আবারও তাদেরকে বলি যে, হেফাজতীদের ধ্বংসাত্মক কাজ ও বিক্ষোভ মোকাবেলা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরণে রাষ্ট্রের সুশীল বাহিনী যথা পুলিশ, র‌্যাব এবং নবগঠিত বর্ডার গার্ডের সদস্যরাই যথেষ্ট এবং এই প্রেক্ষিতে আমি জাতীয় পার্টি ও বিএনপির ঐসব নেতাকে অনুরোধ করি তারা যেন জনস্বার্থে তাদের কর্মীদেরকে হেফাজতীদের সমাবেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেন। বলাবাহুল্য, তারা আমার এই অনুরোধ রাখেননি। রাত ১১টার দিকে ঢাকায় পদায়িত যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনা আমাকে ফোন করে বলেন যে, তাদের বিবেচনায় যথাসম্ভব দ্রুততা ও দৃঢ়তার সঙ্গে নৈরাজ্য দমন করতে হলে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নেয়া ঈপ্সিত হবে। আমি হেসে তাকে বলি যে, আমাদের সেনাবাহিনী দেশকে বহিঃশত্রু থেকে রক্ষার কাজে সাহসিকতার সঙ্গে নিবেদিত আছে। দেশের অভ্যন্তরে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য আমাদের গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য সুশীল বাহিনী যথা পুলিশ, র‌্যাব ও বর্ডার গার্ড যথেষ্ট এবং দেশের অভ্যন্তরে সকল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য জনসমর্থিত গণতান্ত্রিক সরকারের ভূমিকার সক্ষমতা ও নিপুণতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। রাত ১২টার দিকে সমাবেশে অবস্থানকারী হেফাজতী ও তাদের সমর্থকদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। এ সময় এদের জন্য খাবারের প্যাকেট বহনকারী কয়েকটি ট্রাক পুলিশ আটকে দেয়। রাত ২টা ৩০ মিনিটে আমরা জানতে পারি যে, শাপলা চত্বরে ও তার চার ধারে প্রায় ৫০ হাজার হেফাজত কর্মীরা অবস্থান নিয়েছে। তারা চত্বরের চারদিকে মানব প্রাচীর তৈরি করে তাদের দাবি আদায়ের জন্য শহীদ হওয়ার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে হটিয়ে দেয়ার জন্য প্রায় ৫ হাজার পুলিশ, র‌্যাব ও বিডিআর সদস্যকে প্রযুক্ত করা হয়। রাত ২টা ৪৫ মিনিটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব সদস্য শাপলা চত্বরের দিকে উত্তরে নটর ডেম কলেজ এবং পশ্চিমে জনতা ব্যাংকের সামনে দিয়ে অগ্রসর হয়। মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদের তত্ত্বাবধানে ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মারুফ হাসান ও র‌্যাবের লে. ক. জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে উত্তরে নটর ডেম কলেজ এবং পশ্চিমে জনতা ব্যাংক ইমারতের দিক থেকে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, আওয়াজী গ্রেনেড ও শটগানের গুলি ছুড়তে ছুড়তে পুলিশ এবং র‌্যাব বাহিনী হেফাজতীদের মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। ফলে প্রায় ১৫ মিনিটের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হেফাজত কর্মী সেখান থেকে উত্তর-পূর্ব দিকের জসীম উদ্দীন সড়ক এবং দক্ষিণ দিকের ইত্তেফাক এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত খোলা রাখা সড়ক ধরে পালিয়ে যায়। অন্যরা পশ্চিমের সোনালী ব্যাংক ভবন এবং তার পার্শ্ববর্তী ইমারতের বারান্দায় ও দেয়ালের পিছনে আশ্রয় নেয়।
×