ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যানবাহন নিয়ন্ত্রণের চেয়ে মামলায় মনোযোগ বেশি ট্রাফিক পুলিশের

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৬ আগস্ট ২০১৭

যানবাহন নিয়ন্ত্রণের চেয়ে মামলায় মনোযোগ বেশি ট্রাফিক পুলিশের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীতে যানবাহনের বিরুদ্ধে ট্রাফিক পুলিশের মামলা দিন দিন বাড়ছে। কে কত বেশি মামলা দিতে পারে, এ নিয়ে চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার পেছনে কাজ করে সিনিয়রদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়ানোর মানসিকতা। ট্রাফিক পুলিশের কর্মদক্ষতা নির্ধারণে মামলার সংখ্যাও এখন একটি মানদ- হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে যানজট নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক দায়িত্বের পাশাপাশি মামলার সংখ্যা বাড়াতেও মনোযোগ দিতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের। মামলা বাড়ানোর বিষয়ে কোনও কোনও ক্ষেত্রে চাপ হয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি ট্রাফিক সার্জেন্টদের। তারা বলছেন, মামলার পেছনে ছুটতে গিয়ে যান নিয়ন্ত্রণের কাজে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। একই অভিযোগ পরিবহন মালিক ও চালকদেরও। তাদের দাবি, সামান্য কারণেই মামলা দিচ্ছে। যানজট নিয়ন্ত্রণের তুলনায় মামলার সংখ্যা বাড়াতেই বেশি তৎপর ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্টরা। ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ট্রাফিক আইন না মানায় রাজধানীতে মামলা হয়েছে ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭টি। এতে জরিমানার আদায় হয়েছে ১৮ কোটি ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৯৫০ টাকা। ২০১৬ সালে মামলা হয়েছে ৮ লাখ ৯২ হাজার ৭১৩টি। জরিমানা আদায় হয়েছে ৪১ কোটি ২৫ লাখ ১৩ হাজার ৭৫৪ টাকা। আর ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৬ লাখ ৭০ হাজার ৯১৫টি। জরিমানা হয়েছে ২১ কোটি ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৮৯০ টাকা। সব কাগজ ঠিক থাকার পরও সামান্য কারণে গাড়ি রেকার করা হয় বলে অভিযোগ চালকদের। রাজধানীর পান্থপথে এমন অভিযোগ করেন চালক ইমরান মিয়া। তিনি বলেন, ‘সার্জেন্টরা মামলা দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন। শমরিতা হাসপাতালের সামনে স্যারকে (গাড়ির মালিক) নামানোর সঙ্গে সঙ্গে সার্জেন্ট এসে হাজির। কাগজপত্র সব ঠিকঠাকই ছিল। কাগজে কোনও সমস্যা না পেয়ে বলা হয়, রং পার্কিং করেছিস। এ জন্য রেকারিং করা হবে।’ সামান্য কারণেই মামলা করা হয় বলে দাবি মোটরসাইকেল চালক সৈকতের। তিনি বলেন, ‘আমার বাইকের হেডলাইটে কালো দাগ না থাকার জন্য একটা মামলা দেয়া হয়েছে। সার্জেন্ট প্রথমে আমাকে দাঁড় করিয়ে আমার সব কাগজ চেক করলেন। দেখার পর কোনও ত্রুটি কিংবা সমস্যা না পেয়ে বাইকের হেডলাইটের একটি সমস্যা খুঁজে বের করলেন। এরপর মামলা দিয়ে দিলেন। যদিও ওনার বাইকের হেডলাইটের নিচে কোনও কালো দাগ নেই।’ যানজট নিয়ন্ত্রণের তুলনায় মামলার প্রতি সার্জেন্টদের বেশি মনোযোগ বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘গণপরিবহনে যে অবস্থা, সেখানে সবাই যে নিয়ম-নীতি মেনে চলে, তা আমি দাবি করছি না। এভাবে যদি গণহারে মামলা হয়, তাহলে মালিকদের আর কিছু থাকে না। সার্জেন্টরা যান নিয়ন্ত্রণের তুলনায় মামলা করতেই বেশি মনোযোগী বলে মনে হচ্ছে।’ ট্রাফিক সার্জেন্টরা রেকারের অপব্যবহার করেন দাবি করে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘বিভিন্ন পরিবহনের বিরুদ্ধে বেশি মামলা করা হচ্ছে। বিআরটিএ সাতটি ও ডিএমপি একটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। তাদের প্রধান টার্গেট থাকে গণপরিবহন। এরপর যদি ট্রাফিক পুলিশ এই হারে মামলা দেয়, তাহলে গণপরিবহন মালিকরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। এমনিতেই সঙ্কট চলছে। পুলিশের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, অহেতুক হয়রানি ও রেকারের ব্যবহার যেন না হয়। মামলা বাড়াতে ট্র্রাফিক সার্জেন্টদের প্রতিযোগিতার বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও ওপরের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে একটা চাপ থাকে বলে জানান ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘সব বিষয় আমাদের মাথায় রেখেই কাজ করতে হয়। রাস্তার চাপ সামলানোর পাশাপাশি উর্ধতনদের চাপও সামলাতে হয়। কিন্তু কাউকে অহেতুক হয়রানি করা হয় না।’ গত জুন মাসে ট্রাফিকের শ্রেষ্ঠ বিভাগ নির্বাচিত হয়েছে ট্রাফিক-উত্তর বিভাগ। শ্রেষ্ঠ সিনিয়র সহকারী পুলিশ বাড্ডা ট্রাফিক জোনের, সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ফেরদৌসি রহমান, শ্রেষ্ঠ ট্রাফিক ইন্সপেক্টর-রামপুরা ট্রাফিক জোনের টিআই বিপ্লব ভৌমিক ও শ্রেষ্ঠ টিএসআই মতিঝিল ট্রাফিক জোনের সুশান্ত কুমার। শ্রেষ্ঠত্বের কারণ জানিয়ে রামপুরা ট্রাফিক জোনের টিআই বিপ্লব ভৌমিক বলেন, ‘আমাদের মূল কাজ হচ্ছে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখা। পাশাপাশি কেউ আইন অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া। এছাড়া সবার মধ্যে ট্রাফিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কাজ করে যাচ্ছি।’ দিন দিন মামলার সংখ্যা ও জরিমানা আদায়ের পরিমাণ বাড়ার প্রসঙ্গে ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (ট্রাফিক এ্যাডমিন এ্যান্ড রিসার্চ) জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একটা সময় নগরীতে প্রচুর অনিবন্ধিত গাড়ি চলাচল করত। সেগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রচুর অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘একটা নগরীতে যান চলাচলের জন্য ২৫ ভাগ রাস্তা থাকা থাকা দরকার। আমাদের আছে মাত্র ৭ দশমিক ৮ ভাগ। এছাড়া বিআরটিএ হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে ২৮০টি নতুন গাড়ি যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু কতগুলো শহর ছেড়ে যাচ্ছে বা নষ্ট হচ্ছে সেই হিসাব নেই। তবে নষ্ট হওয়া বা ঢাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া গাড়ির সংখ্যা প্রতিদিন যুক্ত হওয়া গাড়ির তুলনায় অনেক কম। রাজধানীর এই সীমিত সড়কে যান নিয়ন্ত্রণ করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। কিন্তু আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’ হয়রানি নয়, আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হচ্ছে দাবি এই ট্রাফিক কর্মকর্তার। তিনি বলেন, ‘স্বল্প সড়কে অতিরিক্ত যানবাহন ট্রাফিক আইন না মেনে চললে তা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। ট্রাফিক বিভাগ এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে কাজ করে যাচ্ছে। পরিবহনগুলোর চালক-মালিকদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। তাদের সচেতন করার কাজ চলছে। কিন্তু এরপরও যারা রাস্তায় ট্রাফিক আইন ভেঙ্গে চলাচল করে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হচ্ছে।’
×